বিএনপি ‘এক নেতার এক পদ’ নিয়ে দোটানায়

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০১৭, ০২:৪৫ পিএম

ঢাকা : বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মধ্যে ‘এক নেতার এক পদ’ ছিলো অন্যতম। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অন্য ব্যাপারে নমনীয় মনোভাব পোষণ করলেও ‘এক নেতার এক পদ’ সিদ্ধান্তে ছিলেন অনড় এবং কঠোর। তাই এই নীতি বাস্তবায়নে একাধিকবার ‘ডেডলাইন’ দিলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এরই মধ্যে একাধিক পদে থাকতে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘বিশেষ ক্ষমতা’র সুযোগ নিতে চায় কেউ কেউ।

জানা গেছে, সম্প্রতি দলের হাইকমান্ড নির্দেশ দেয়- যাদের একাধিক পদ আছে, তারা যে কোনো একটি রেখে বাকি পদগুলো ছেড়ে দেন। এর জন্য তাদেরকে ‘ডেডলাইন’ও বেঁধে দেয়া হয়। পাশাপাশি একাধিক পদে থাকা দলের ১৯ জন নেতাকে চিহ্নিত করে চিঠি পাঠানো হয়। তবে সবাই চিঠির উত্তর দিলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা কার্যকর করার কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। উল্টো রুহুল কবির রিজভীকে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতির এই সিদ্ধান্ত অকার্যকরের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য অনেকেই দায়ী করছেন। কারণ সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হওয়ার পরও দলের ‘দফতর’-এর পদ ধরে রাখায় তাঁকেই এ ক্ষেত্রে সবাই উদাহরণ হিসেবে সামনে টেনে আনছেন।

প্রসঙ্গত, পূর্ণাঙ্গ মহাসচিবের দায়িত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সভাপতি ও কৃষক দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির পদ ছেড়ে দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আর দলের যুগ্ম মহাসচিবের পদ পাওয়ার পর যুবদলের সভাপতির পদ ছেড়ে দেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। শুধু এই দুই নেতা নন, দলের অসংখ্য নেতা আছেন। যারা নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সর্বশেষ পাওয়া ‘মর্যদাপূর্ণ’ পদটি রেখে আগের পদ ছেড়ে দেন। কেউ কেউ আবার আগের পদটিকে শ্রেয় মনে করে ছেড়ে দেন নতুন পাওয়া পদটি।

তবে এ ক্ষেত্রে রুহুল কবির রিজভী একটু বেশি যেন ব্যতিক্রম। কারণ দলের গুরুত্বপূর্ণ ‘সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব’ পদটি পাওয়ার পরও দফতর সম্পাদক-এর পদটি ছাড়েননি তিনি। এ নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে দীর্ঘদিন ধরে চলছে নানা আলোচনা, সমালোচা, অসন্তোষ ও হৈ-চৈ। এছাড়া বিএনপি ঘরোনার বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবীরাও প্রকাশ্যে রুহুল কবির রিজভীর এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন পদ দখলের সমালোচনা করেন। তবুও এক অদৃশ্য কারণে সব কিছুই নীরবে সয়ে যাচ্ছেন রিজভী। এবার আর তিনি একা নন। সঙ্গে পেয়ে গেছেন আরেক যোগ্য সঙ্গী। তিনি দলের অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব হাবীব-উন-নবী খান সোহেল। সম্প্রতি তাকে দেয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) বিএনপির দায়িত্ব। এখন থেকে কেন্দ্রের যুগ্ম মহাসচিব পদটির পাশাপাশি বিএনপির মহাগুরুত্বপূর্ণ আরেকটি পদ ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) বিএনপির সভাপতিও তিনি।

এই যখন অবস্থা- তখন দলের ভেতরেই প্রশ্ন উঠছে, ‘এক নেতার এক পদ’ নীতিতে অন্যদের বেলায় কঠোর অবস্থান নিলেও রিজভী-সোহেলের ক্ষেত্রে এতোটা নমনীয় কেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া? এই দুই নেতাকে কেন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালেন তিনি?

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রুহুল কবির রিজভীকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়ার পর তারেক রহমানের আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত দলের সাবেক সহ-দফতর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনিকে দফতর সম্পাদকের পদে বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। কারণ বিএনপি এবং শহীদ জিয়া পরিবার প্রশ্নে আবদুল লতিফ জনির ভূমিকা সবসময় আপোষহীন। এছাড়া দলের সাংগঠনিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জনির ইতিবাচক ভূমিকা বিএনপির ভেতরে-বাইরে বেশ প্রশংসনীয়। তাই দলের দফতরের কার্যক্রমে গতিশীলতা বাড়াতে আবদুল লতিফ জনিকে দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপির হাইকমান্ড। এমন খবরে ‘মাথায় আকাশ ভেঙে’ পড়ে রুহুল কবির রিজভীর। তিনি ছুটে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে। কাকুতি-মিনতি করে রিজভী বলেন, অনেক ঝড়-ঝাপ্টার মধ্যেও তিনি রাজধানীর নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছাড়েননি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের সদর দফতরকে আগলে রেখেছেন। যতোদিন রাজনীতি করবেন, ততোদিন নয়াপল্টন কার্যালয় ছাড়বেন না তিনি। দলের চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নাছোরবান্দা রুহুল কবির রিজভীর এই আবদার উপেক্ষা করতে পারেননি খালেদা জিয়া। ফলে নিজের নেয়া ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি কার্যকরের সিদ্ধান্ত রিজভীর ক্ষেত্রে শিথিল করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

অবশ্য দলের বেশিরভাগ সিনিয়র নেতা মনে করেন, দফতর সম্পাদকের পদটি ধরে রাখার জন্য খালেদা জিয়াকে ‘মেন্টাল ব্ল্যাকমেইল’ করেছেন রিজভী। তবে এই ঘটনার পর সেসময় এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে রুহুল কবির রিজভী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ম্যাডমের (খালেদা জিয়া) দেয়া দায়িত্ব আমি পালন করছি। ম্যাডাম যদি মনে করেন, এ দায়িত্ব অন্য কাউকে দেবেন, তাহলে আমি সরে যাবো।

এদিকে দলীয় অপর একটি সূত্র জানায়, হাবীব-উন-নবী খান সোহেলের বিষয়টি একটু ভিন্ন মাত্রার। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক এ সভাপতিকে অত্যন্ত স্নেহ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পাশাপাশি সোহেলের সাংগঠনিক দক্ষতাকে দলের জন্য কাজে লাগাতে চান তিনি। তরুণদের নেতৃত্বে আনার মিশনে যাদেরকে তিনি যোগ্য মনে করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন হাবীব-উন-নবী খান সোহেল। দক্ষ এ সংগঠককে নিয়ে খালেদা জিয়ার পরিকল্পনাও নাকি দীর্ঘদিনের।

এছাড়া, সোহেলের মধ্যে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বগুণ দেখে তরুণ বয়সে রংপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব করেছিলেন খালেদা জিয়া। এরই ধারাবাহিকতায় কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) বিএনপির সভাপতি করেছেন সোহেলকে। সর্বশেষ সোহেলের এই পদায়নের পর দলের চেয়ারপারসন সরে এসেছেন ‘এক নেতার এক পদ’ নীতির সিদ্ধান্ত থেকে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি তো দলের প্রয়োজনেই। আবার দলের প্রয়োজনেই যদি এ সিদ্ধান্তের নড়চড় করতে হয়, সেটি করার এখতিয়ার দলীয় প্রধান সংরক্ষণ করেন।

জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাকে কোন পদে রাখা হলে দল উপকৃত হবে সে বিষয়ে বিএনপির হাইকমান্ডই বিভ্রান্তিতে আছে। আবার সংশ্লিষ্ট নেতারাও এ প্রশ্নে আছেন দোটানায়। ফলে অনেকেই দুই পদ ধরে রেখেছেন। এ অবস্থায় গত ২০ মার্চ একটি পদ ছেড়ে দেয়ার জন্য রুহুল কবির রিজভী অনেককে চিঠি দিয়েছেন। তবে অভিযোগ উঠেছে, ওই চিঠিও রিজভী তাঁর পছন্দের অনেক নেতাকে দেননি; যাঁরা এখনো দুই পদ ধরে রেখেছেন।

এছাড়া রিজভী নিজেও দুই পদ ধরে রাখায় অন্যকে বাড়তি পদ ছাড়ার জন্য চিঠি দিতে পারেন কি না, এ নিয়েও দলের সব মহলে প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে, এটি একই দলের মধ্যে দুই ধরণের বিধান চালুর প্রচেষ্টা। তবে বাস্তবতা হলো, রিজভী নিজেই ওই পদ আঁকড়ে থাকতে চাইছেন। উদ্দেশ্য, দফতর থেকে পুরো দলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।

এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্য হলো, নিজে দুই পদে বহাল থেকে অন্যকে পদ ছাড়তে বলা অনৈতিক। রিজভী যদি এটি করে থাকেন, তাহলে সেটি মোটেই উচিত হয়নি। তাঁর মতে, এটাই বিএনপির সমস্যা। তিনি বলেন, বিশেষ বিবেচনা কখনো বিধান হতে পারে না। তা ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন দলের সবার নেত্রী। সুতরাং ওই বিবেচনা সবাই দাবি করতে পারেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই