প্রতিদিনই শীর্ষে ঢাকা, বায়ুদূষণ রোধে পদক্ষেপ নেই  

  • নিজস্ব প্রতিবেদক    | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৩, ২০২১, ০৪:৫৯ পিএম

ঢাকা : বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। শীতের এ সময়ে রাজধানী হয়ে উঠেছে ধূলিময়। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। বাস্তবিক ও দৃশ্যমাণ একটি কারণ সহজেই সবাই বুঝতে পারেন; আর তা হলো উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়ি।

এদিকে বাতাসের মান যাচাইকারী আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপ বলছে, নতুন বছরের প্রথম মাস অর্থাৎ চলতি মাসের প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা দূষণের শীর্ষে উঠে আসছে। দূষণের মাত্রা এত বেশি যে সেটাকে দুর্যোগপূর্ণ বলা হচ্ছে। 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাইবিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর বায়ুমান সূচক (একিউআই) অনুযায়ী, ২১ জানুয়ারি সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত গড়ে ঢাকা প্রথম অবস্থানে ছিল এবং দূষণের সূচক ৩২৬ পর্যন্ত উঠেছিল। এর আগের দিনও সকাল ৯টায় শীর্ষে ছিল ঢাকা। একই অবস্থা ছিল গত মঙ্গলবার, সোমবারও। চলতি সপ্তাহে দিনের কোনো না কোনো সময়ে দূষণের এক নম্বরে ছিল ঢাকা।

অন্যদিকে বায়ুবিশেষজ্ঞরা বলছেন, সূচক ৩২৬ মানেই দুর্যোগপূর্ণ। এখনই দূষণ কমাতে পদক্ষেপ না নেওয়া হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিতে পারে বলে হুঁশিয়ারি তাদের। 

পরিবেশ মন্ত্রণালয় বায়ুদূষণের জন্য ২০টি কারণ চিহ্নিত করেছে। 

কারণগুলো হলো : ১. ইটভাটা, ২. রাস্তা নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ ও মেরামত, ৩. সেবা সংস্থাগুলোর নির্মাণকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ৪. বড় উন্নয়ন প্রকল্প (এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল), ৫. সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, ৬. সড়ক বা মহাসড়কের পাশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বালু উত্তোলন ও সংগ্রহ, ট্রাক বা লরিতে বালু, মাটি, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী উন্মুক্ত অবস্থায় পরিবহন, ৭. রাস্তায় গৃহস্থালি ও পৌর বর্জ্য স্তূপাকারে রাখা ও বর্জ্য পোড়ানো, ৮. ড্রেন থেকে ময়লা তুলে রাস্তায় ফেলে রাখা, ৯. ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে গিয়ে ধুলাবালি ছড়ানো, ১০. বিভিন্ন সড়কের পাশে থাকা অনাবৃত স্থান, ১১. ফুটপাত ও রাস্তার আইল্যান্ডের মাঝের ভাঙা অংশের মাটি ও ধুলা, ১২. ফিটনেসবিহীন পরিবহন থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর ধোঁয়া, ১৩. বিভিন্ন যানবাহনের চাকায় লেগে থাকা কাদামাটি, ১৪. বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি কলোনির ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো, ১৫. বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল ও বাণিজ্যিক ভবনের আবর্জনা ও ধুলাবালি রাস্তায় ফেলে দেওয়া, ১৬. ঢাকা শহরের দূষণপ্রবণ এলাকার ধুলা, ১৭. হাসপাতালের বর্জ্য রাস্তায় ফেলা, ১৯. অধিক সালফারযুক্ত ডিজেল ব্যবহার ও ২০. জনসচেতনতার অভাব।

পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ইটভাটা বন্ধে অভিযান চলছে। এর পরের অনেক কারণ নিয়ে আমরা সিটি করপোরেশন ও বিআরটিএর সঙ্গে আলোচনা করেছি। 

সিটি করপোরেশনের সঙ্গে রাস্তার পাশে ময়লা রাখা, সকালে ঝাড়ু দেওয়া, নির্মাণাধীন ভবনের ময়লা, হাসপাতালের বর্জ্যসহ যাবতীয় আবর্জনা সরানো ও পরিষ্কারের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা আমাদের জানিয়েছে নিয়মিত মনিটরিং করছে। 

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এবং মেট্রোরেল প্রকল্পকে নিজস্ব উদ্যোগে পানি ছেটানোর অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি যেসব যানবাহন দূষণের জন্য দায়ী সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিআরটিএকে বারবার বলছি। আমরা আমাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। অবশ্য তার এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত আছে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের। 

তারা বলেন, দূষণ রোধে দৃশ্যমান কোনো কাজ হচ্ছে না। অগ্রাধিকার না দিলে এ দূষণ কমবে না। ক্রমাগত শীর্ষেই থাকব আমরা। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে দেশের বহু মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরো ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে।

দূষণবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘কী কী কারণে দূষণ বাড়ছে তা আমরা বিভিন্ন সময়ে জানাচ্ছি। কীভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তাও বলছি। মন্ত্রণালয়ের সবাই জানে এগুলো। এখন আসল কাজ হচ্ছে দূষণ নিয়ন্ত্রণে যেসব উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে সেগুলো আদৌ বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা মনিটরিং করা। দীর্ঘমেয়াদে যে দূষণের ক্ষতি অনেক বেশি এটা সরকারকে বুঝতে হবে।’

বাপা কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ডা. আব্দুল মতিন বলেন, ‘দূষণ কেন হয়, কীভাবে হয়, কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তা সবাই জানে। তবে শুধু মুখে বললে তো হবে না। এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো কাজ দেখতে পাই না। মাঝে মাঝে দুয়েকটা অভিযান পরিচালনা করে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। দরকার অনেক বেশি অভিযান।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ২০২১ সালে পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ঠিক রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে কীভাবে শহর ও তার মানুষকে রক্ষা করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নির্মল বায়ুর প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। 

তিনি বলেন, আমাদের এখনো পুরনো পদ্ধতিতে খোঁড়াখুঁড়ি রয়ে গেছে। উন্নত শহরগুলোতে এর ধরন কিন্তু ভিন্ন। তাদের উন্নয়নকাজে ধূলাধূষণ একেবারেই হয় না। এছাড়া একদিকে উচ্ছেদ অন্যদিকে দখল খেলা চলছে। এগুলো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত থাকে। আমাদের দুই মেয়রকে এটা বন্ধ করতে হবে। তবেই শহরকে ধুলাদূষণ থেকে মুক্ত করা যাবে।

এই পরিকল্পনাবিদের মতে, ঢাকা শহরে যে পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে তা একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যথেষ্ট। কিন্তু এই উন্নয়নের সঙ্গে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সবুজায়ন বাড়াতে হবে। সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে ওয়ার্ডভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, বাসযোগ্য ঢাকা গড়তে হলে নতুন বছরে আমাদেরকে জনঘনত্ব বিবেচনা করে জোনিংয়ে হাত দিতে হবে। 

এছাড়া যানজট নিরসনে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিশ্চিত করতে হবে। সেটা হতে পারে মেট্রোরেল, বিআরটি বা অন্য কিছু। 

তৃতীয়ত, আমাদের অনেক জলাশয় ও লেক হারিয়ে গেছে। সিএস নকশা ধরে সেই হারিয়ে যাওয়া জলাশয় উদ্ধার করতে হবে। পাশাপাশি একটি ওয়াটার বেইজড নেটওয়ার্ক তৈরি করে একটি ত্রিমুখী যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলেই ঢাকা হবে পৃথিবীর সুন্দর শহরগুলোর মধ্যে একটি।

ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, আমাদের প্রতিটি সমস্যা চিহ্নিত। এখন শুধু সমাধান যাত্রা। আমরা সেই পথেই হাঁটছি। এজন্য নগর পরিকল্পনাবিদ ও নাগরিকদের সমন্বয়ে আমরা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আশা করি নতুন এটা আরো দৃশ্যমান হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই