সালাম : পারস্পরিক সম্প্রীতির অন্যতম মাধ্যম মুফতি

  • নাঈম কাসেমি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২০, ১০:১৮ পিএম

ঢাকা : প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.)। শুরুর জীবনে তিনি ইহুদি ছিলেন। থাকতেন মদিনায়। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত সম্পর্কে তার জানাশোনা ছিল প্রচুর। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরতের পর তিনি ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এক হাদিসে তিনি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় আগমন করলেন, বাঁধভাঙা স্রোতের মতোই মানুষ তাঁর দিকে ছুটতে শুরু করল। তারা বলাবলি করতে লাগল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চলে এসেছেন। তাঁকে দেখার জন্যে মানুষের ভিড়ের মাঝে আমিও গেলাম। আমি তাঁর চেহারা দেখেই তাঁকে চিনতে পারলাম আর তখনই বুঝতে পারলাম এ চেহারা কোনো মিথ্যুকের চেহারা নয়। সেদিন আমি তাঁকে প্রথম যে কথাটি বলতে শুনেছি তা হলো- হে মানুষেরা! তোমরা সালামের বিস্তার ঘটাও, মানুষকে খাবার খাওয়াও এবং যখন অন্য মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন নামাজ পড়, তাহলে তোমরা শান্তিতে ও নির্বিঘ্নে জান্নাতে যেতে পারবে (জামে তিরমিজি : ২৪৮৫)। হাদিসটির প্রেক্ষাপট ও উপস্থাপন আমাদের সামনে সালামের গুরুত্ব দিবালোকের মতো স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রিয় জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করে এসে মানুষদের প্রথম উপদেশ দিচ্ছেন তোমরা সালামের অধিক প্রচলন কর!

দেখা-সাক্ষাতে একে অন্যকে শুভেচ্ছা-অভিবাদন জানানো মানুষের একটি সহজাত গুণ। মানবসমাজে এ প্রথা চলে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই। কোনো কোনো এলাকায় প্রচলন ছিল সম্মানিত ব্যক্তিদের মাথা নুইয়ে সম্মান জানানোর রীতি। ইসলামপূর্ব যুগে আরবের লোকেরা পরস্পর দেখা-সাক্ষাতে ‘তোমার সকাল সুন্দর হোক’, ‘আল্লাহ তোমার চোখ শীতল করুন’ এ-জাতীয় শব্দ ব্যবহার করত। গুডমর্নিং বা শুভ সকাল তো একালেরও প্রচলিত অভিবাদন। কিন্তু ইসলাম আমাদের দিয়েছে এক অভূতপূর্ব অভিবাদন-রীতি, যা কোনো ধর্মে কিংবা কোনো দেশে প্রচলিত ছিল না। মানের বিচারেও তা অন্য সবকিছু থেকে শ্রেষ্ঠ। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে- দুই মুসলমান যখন মিলিত হয় তখন যেন একে অন্যকে সালাম দেয়। অর্থাৎ একজন বলবে, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। অর্থ- তোমার ওপর শান্তি ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আর অপরজন বলবে, ওয়া আলাইকুমুস সালামু ওয়ারাহমাতুল্লাহ। অর্থ- তোমার ওপরও শান্তি ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। স্থান-কালের বন্ধন থেকে মুক্ত করে একে অন্যের জন্যে আল্লাহর রহমত ও শান্তি কামনা; এর চেয়ে উত্তম শুভেচ্ছা আর কী হতে পারে! এ সালাম আমাদের অহংকার, আমাদের স্বকীয়তা।

সালাম যে কেবল অভিবাদন আর শুভ কামনা এমন নয়, কিংবা সালাম কেবল মহব্বত-ভালোবাসার প্রকাশই নয়। বরং এ সালামের মধ্য দিয়ে ভালোবাসার দাবিটুকুও আদায় করা হয়। একজন আরেকজনের জন্যে প্রার্থনা করে আল্লাহ তোমাকে শান্তি ও নিরাপদে রাখুন, তোমার ওপর বর্ষিত হোক পরম করুণাময়ের দয়া ও অনুগ্রহের বারিধারা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপে দয়াময় আল্লাহ তোমাকে সবরকমের বিপদ ও শঙ্কা থেকে মুক্ত রাখুন। সাক্ষাতের সঙ্গে সঙ্গে একে অন্যের জন্যে এ প্রার্থনার মধ্য দিয়ে যেন একথাও মনে করিয়ে দেয়া হয় আমরা একে অপরের যে সহযোগিতা আর উপকার করতে চাই, তা কেবল আল্লাহর ইচ্ছাই হতে পারে। সালামের মাধ্যমে একে অপরকে আল্লাহর কথাও মনে করিয়ে দেয়। আর কেউ যখন অন্য কারো জন্যে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রার্থনা করে, সে যেন এই অঙ্গীকারও করে- আমার পক্ষ থেকেও কোনো অনিষ্টতায় তুমি আক্রান্ত হবে না। আমার দিক থেকে তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ। পারস্পরিক ভালোবাসার দাবি পূরণের চেয়ে সুন্দর পন্থা আর কী হতে পারে! কেউ যখন কাউকে সালাম দেয়, তখন এর উত্তর দেওয়া ওয়াজিব। এ আদেশ সরাসরি আল্লাহর। ইরশাদ হয়েছে- ‘যখন তোমাদের সালাম দেয়া হয় তখন তোমরা এর চেয়ে উত্তম পন্থায় সালামের উত্তর দাও কিংবা (অন্তত) ততটুকুই বলে দাও’ (সুরা নিসা ৪ : ৮৬)।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘সালাম’ দেওয়াকে একজন মুসলমানের অন্যতম সেরা আমল হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এক সাহাবি প্রশ্ন করলেন- ইসলামের শ্রেষ্ঠ আমল কোনটি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তুমি মানুষকে খাবার খাওয়াবে আর তোমার পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেবে’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১২)।

এ হাদিসে স্পষ্টভাবেই সালাম ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে পরিচিত-অপরিচিত সবার মাঝে। পরিচিত কাউকে যখন সালাম দেওয়া হয়, আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব কিংবা অন্য যে কোনো সূত্রেই হোক, সালামের মাধ্যমে সেই পরিচয়ের সূত্র আরো ঘনিষ্ঠ হয়। আর অপরিচিত কাউকে যখন কেউ সালাম দেয় তখন এ সালামের মধ্য দিয়েই সূচিত হতে পারে গভীর আন্তরিকতা। জীবনে কখনো দেখা হয়নি এমন কারো সঙ্গেও যখন কথাবার্তার শুরুতে সালামের আদান-প্রদান হয়, তখন অকৃত্রিম হূদ্যতা ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। এক অপার্থিব শান্তি ও নিরাপত্তা অনুভূত হয়। মোটকথা, সালাম বিনিময়ের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। হূদ্যতা ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। ভালোবাসা ও সম্প্রীতির এ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সামাজিক বন্ধন যেমন সুদৃঢ় হয়, তেমনি পরকালীন মুক্তিও এর সঙ্গে জড়িত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেহেশত লাভের জন্যেও পারস্পরিক এ ভালোবাসার শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা ঈমান না আনা পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর তোমাদের ঈমান ততক্ষণ পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ না তোমরা একে অন্যকে ভালোবাস। আমি কি তোমাদের এমন একটি আমলের কথা বলব, যখন তোমরা তা করবে, তখন একে অন্যকে ভালোবাসবে। তোমাদের মাঝে সালামের প্রচলন ঘটাও’ (সহিহ মুসলিম : ৫৪)।

সালামের প্রচলন কীভাবে ঘটানো যায়, তার একটি রূপরেখাও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি (সা.) বলেছেন : তোমাদের কেউ যখন তার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তখন যেন সে সালাম দেয়। এরপর কোনো গাছ কিংবা কোনো পাথর বা দেয়ালের আড়াল থেকে এসে যখন আবার তার সঙ্গে দেখা হয় তখনো যেন তাকে সালাম দেয় (সুনানে আবু দাউদ : ৫২০০)। সালামের আরেক সুফল সালাম মানুষকে অহংকার থেকে মুক্ত রাখে। তবে এজন্যে শর্ত হলো- আগে সালাম দেওয়া। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : যে আগে সালাম দেয় সে অহংকার থকে মুক্ত (বায়হাকি :  ৮৪০৭)।

মানুষ যখন বড় হয়, তা বয়সের বিবেচনায়ই হোক, কিংবা যশ-খ্যাতি সম্মান বা অর্থসম্পদের দিক দিয়েই হোক, আর পদমর্যাদা ও ক্ষমতা দিয়েই হোক, সে চায় তার অধীনস্থরা কিংবা তার চেয়ে ছোট যারা তারা তাকে সম্মান করুক। অন্যদের সম্মানে সে তৃপ্তি পায়। কেউ বড় হয়ে গেলে ছোটদের নিয়ে এ মানসিকতা অনেকেরই থাকে যে, আমি কেন তাকে সালাম দেব, বরং সে আমাকে সালাম দেবে! এ মানসিকতা থেকেই অহংকারের সূচনা হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মানসিকতাকেই শেকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলেছেন। তাঁর বাণী ও শিক্ষা অনস্বীকার্য যে যত বড়ই হোক, সামাজিকভাবে যত উচ্চ মর্যাদার অধিকারীই হোক, আগ বেড়ে সে যখন অন্য কাউকে সালাম দেবে তখন তার মন থেকে অহংকার বিদায় নিতে বাধ্য।

প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) ছিলেন মদিনা মুনাওয়ারার বিদ্বান সাহাবিদের অন্যতম। তাঁকে কেন্দ্র করে সেখানে গড়ে ওঠে হাদিস চর্চার পাঠশালা। অথচ তিনি হাদিসের মজলিস রেখে মাঝে মাঝেই বাজারে ঘুরে বেড়াতেন। উদ্দেশ্য- অধিক সংখ্যক মানুষকে সালাম দেওয়া। তাঁর শিষ্য হজরত তোফায়েল ইবনে উবাই ইবনে কাবের বক্তব্য শুনুন- ‘আমি একদিন আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-এর কাছে এলাম। তিনি তখন আমাকে নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিলেন। আমি তাকে বললাম, বাজারে গিয়ে আপনি কী করবেন? আপনি তো কোনোকিছু কেনাবেচা করেন না। কোনো পণ্য সম্পর্কে কিছু জানতেও চান না। কোনো কিছু নিয়ে দামাদামিও করেন না। কারো সঙ্গে কোনো বৈঠকেও শরিক হন না, তবু কেন আপনি বাজারে যাবেন? আপনি এখানে বসুন, আমরা হাদিস শুনব। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) তখন বললেন, ‘আরে শোনো, আমরা তো কেবল সালাম দেওয়ার জন্যেই বাজারে যাই। যার সঙ্গে দেখা হয় তাকেই আমরা সালাম দিয়ে থাকি’ (মুয়াত্তা মালেক :  ১৭২৬)। সালামকে যদি আমরা এভাবে আমাদের সমাজে ছড়িয়ে দিতে পারি এবং যদি সালামের মর্ম আমরা আমাদের জীবনে ধারণ করতে পারি, তাহলে একদিকে আমাদের পরকালীন পুঁজি বৃদ্ধি পাবে। সমাজে বয়ে যাবে আন্তরিকতা আর সম্প্রীতির স্নিগ্ধ হাওয়া। আমাদের পার্থিব জীবনও হয়ে উঠবে শান্তি ও কল্যাণময়।

লেখক : পরিচালক, জামিয়া শায়খ আরশাদ মাদানী বাংলাদেশ