দুর্নীতি: নৈতিক অবক্ষয় ও আমাদের করণীয়

  • আহমদ আবদুল্লাহ | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২১, ১২:৫০ পিএম

ঢাকা : দুর্নীতি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুর্নীতির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, অসৎ হওয়া বা কাউকে অসৎ বানানো। ভুলপথে চালিত হওয়া বা কাউকে ভুলপথে চালিত করা। বিপথগামী বা বিকৃতি সাধন করা। ন্যায়ভ্রষ্ট, সত্যের বিপরীত, যুক্তির বিপরীত, ন্যায়পথ থেকে বিচ্যুতি, অস্বাভাবিকতার প্রতি প্রবণতা, পচন, দূষণ, কলুষ, অসদাচরণ নৈতিক পদস্খলন, দুঃশাসন, অসৎবৃত্তি, দুষ্কর্মা, অপকর্ম, কর্তব্যে অবহেলা, অধঃপাত, দুরাত্মা, দুরাচার, দুঃশীলতা, অন্তর্দুষ্ট, নষ্ট ব্যক্তি, মন্দ, ভ্রান্ত, অন্যায়, ক্ষতিকর, নীতিবিগর্হিত, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি। সাধারণভাবে দুর্নীতি বলতে আমরা বুঝি, প্রাপ্ত বা অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের বা কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করা।

দুর্নীতি মানুষের সহজাত কুপ্রবৃত্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এই ছয়টি রিপু মানুষকে দুর্নীতির দিকে ধাবিত করে এবং মানবজীবনে অন্যায়, অত্যাচার, পাপাচার, ব্যভিচার, নির্মমতা, পাশবিকতা, ধন-সম্পদের লোভ-লালসা, আত্মসাৎ প্রবণতা, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, হত্যাকাণ্ড, সুদ, ঘুষ, হিংসা-বিদ্বেষ, অনৈক্য ইত্যাদি উদ্ভব ঘটায়। দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে ক্ষমতা বা সুযোগের অপব্যবহার। ক্ষমতার সঙ্গে দুর্নীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। এ ক্ষমতা হতে পারে ব্যক্তি পর্যায়ে, পারিবারিক পর্যায়ে, সামাজিক পর্যায়ে, রাজনৈতিক পর্যায়ে ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, এমনকী আর্থিক পর্যায়েও। যাদের হাতে ক্ষমতা আছে তারা সবাই দুর্নীতি করে, তা বলা না গেলেও তবে যারা দুর্নীতি করে, তারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে থাকে।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে না, নীতি বহির্ভূত কাজ করে না, ন্যায়পথ থেকে বিচ্যুত হয় না অর্থাৎ দুর্নীতি করে না, বর্তমানে এমন ব্যক্তি বা দেশ পাওয়া দুষ্কর। ক্ষমতা ও সুযোগের কারণে অনেকেই দুর্নীতিবাজ হয়। দুর্নীতির অর্থ যদি হয় ন্যায়পথ থেকে বিচ্যুতি, দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও সততা তাহলে দুর্নীতিবাজ হওয়া থেকে অধিকাংশ মানুষই রেহাই পাবে না। সুযোগ পেলে অনেক রিকশাশ্রমিকও অধিক ভাড়া হাঁকে। কৃষি শ্রমিকও কাজে ফাঁকি দেয়। অফিসের পিয়ন, গৃহভৃত্য অপচয় ও অপব্যবহার করে। আর অস্বাভাবিকতার প্রতি প্রবণতা যদি দুর্নীতি হয় তাহলে একজন পেশাদার ভিক্ষুকের ভিক্ষা করাও দুর্নীতি। কারণ চুরি, ডাকাতি ও ঘুষের মতো ভিক্ষাও তো অস্বাভাবিক কাজ। অনুরূপভাবে আল্লাহতায়ালার ওপর ভরসার কথা বলে উট না বাঁধা কিংবা আল্লাহ খাওয়াবে বলে কাজ না করে অলস বসে থাকাও দুর্নীতি। কারণ, অসতর্কতা ও অলসতা কোনো স্বাভাবিক প্রবণতা নয়। সব ধরনের ভণ্ডামি, নষ্টামি এবং বাড়াবাড়িও দুর্নীতি। কারণ এসবও অস্বাভাবিক এবং নীতিবিগর্হিত কাজ।

দুর্নীতি মানবজীবনের জন্য একটি অন্তহীন সমস্যা। এর ক্ষতির পরিমাণ ও পরিধি এতো ব্যাপক যে, এর কালো থাবা থেকে কেউ রেহাই পায় না। দুর্নীতি একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সুশাসন, সুস্থ ও সহনশীল রাজনৈতিক বিশ্বাস ও স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। দুর্নীতি মানবজীবনে একটি প্রাচীন সমস্যা। দুর্নীতি দারিদ্র্য ও সবধরনের অবিচার বাড়ায়। দুর্নীতি মানুষের মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি করে। এর ফলে মানুষ তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। দুর্নীতি সমাজে অপরাধ প্রবণতা ও মানুষে অসন্তুষ্টি বৃদ্ধি করে। দুর্নীতি সমাজ বিকাশের ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেয়। এগুলোকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেয় না। দুর্নীতি সব ধরনের মূল্যবোধ ও ন্যায়নীতির প্রতি মানুষের অনীহা সৃষ্টি করে। দুর্নীতি মানুষের সহজাত কুপ্রবৃত্তিগুলোর অন্যতম হওয়ায় এর দমন ও রোধকল্পে যুগে যুগে বহু নবী-রাসুল ও সমাজ সংস্কারক এসেছেন। প্রণীত হয়েছে বহু আইন-কানুন ও নিয়ম-নীতি। গঠিত হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা।

দুর্নীতির কালো থাবা থেকে তারাই পরিত্রাণ পেয়েছেন, যারা রাসুলের প্রবর্তিত নীতি ও নৈতিকতার আদর্শ অনুসরণ করেছেন। সুতরাং কোনো দেশ ও জাতিকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হলে মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের স্ফুরণ ঘটাতে হবে। নবী-রাসুলগণ নীতি-নৈতিকতার যে শিক্ষা দিয়েছেন তার প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে। কোনো নবী-রাসুল মানুষকে দুর্নীতি ও অনৈতিকতা শিক্ষা দেননি। সপ্তম শতকে সারা বিশ্ব যখন জাহিলিয়াতের নিকষ কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত, পাশবিকতায় যখন সাড়া বিশ্ব আচ্ছন্ন, তখন বিশ্বনবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরব উপদ্বীপের পথভ্রষ্ট মরুচারী বেদুঈন সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও সততার যে খিলাফত কায়েম করেন, তার উদাহরণ পৃথিবী আর দ্বিতীয় প্রত্যক্ষ করেনি। খিলাফতের কোথাও দুর্বৃত্ত ও দুরাচারের এতটুকুও অবিশিষ্ট ছিল না। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিলো অলঙ্ঘনীয়। মানুষ ছিল মানুষের জন্য। কোথাও ছিল না শোষণ নির্যাতনের লেশমাত্র। দুর্নীতি, এ কোনো নতুন কিংবা দরিদ্র দেশের সমস্যা নয়। সমগ্র মানবজাতির জন্যই এটি একটি কঠিন সমস্যা। পৃথিবীর সব দেশেই দুর্নীতি কম-বেশি আছে। সমূলে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা কোনো কঠিন কাজ নয়। দরকার সদিচ্ছার।

আধুনিক রাষ্ট্রে জাতীয় সংসদ জনগণের পক্ষ হয়ে সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা করার দায়িত্ব পালন করে। এই সংসদ যদি দুর্নীতি আর কালো টাকার প্রভাবে গঠিত আর পরিচালিত হয়, তাহলে কখনই দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তাই যেসব দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠিত, সেসব দেশের নির্বাচন ও রাজনীতি থেকে কালো টাকা ও দুর্নীতির প্রভাব দূর করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। তারও আগে দরকার জনগণকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা। শিক্ষিত, সচেতন ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বলীয়ান নাগরিকরাই কেবল পারে দুর্নীতিকে ‘না’ বলতে। দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে ‘না’ বলতে হলে সে দেশের সংসদ, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসনের সাথে সাথে ব্যবসায়ী সমাজ এবং বড় বড় কোম্পানিগুলোকেও দুর্নীতিকে না বলতে হবে। ব্যবসায়ীরা দুর্নীতিকে ‘না’ বললে অন্যদের ‘হ্যাঁ’ বলার সুযোগ কমে যাবে। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকেই দুর্নীতি পরিপুষ্ট লাভ করে থাকে।

দুর্নীতি দ্বারা যা অর্জন করা হয়, চাই তা অর্থ-বিত্ত হোক কিংবা মানমর্যাদা হোক অথবা ক্ষমতা হোক, ইসলামে সম্পূর্ণরূপে হারাম। ইসলাম যেমন মন্দ ও দুর্নীতিকে নিষিদ্ধ করেছে, তেমনি মন্দ বা দুর্নীতি দ্বারা প্রাপ্ত সম্পদ ভোগ করাও নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকদের কাছে পেশ করো না।’ (সুরা আল-ইমরান, আয়াত-১৮৮) হজরত আনাস (রা.) থেকে  বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে গ্রামের উৎপাদিত পণ্য এককভাবে খরিদ করে নিয়ে শহুরেদের কাছে বিক্রয়  অবৈধ সিন্ডিকেট বা ব্যবসায়িক দুষ্টুচক্র ব্যবস্থা তৈরি করতে  নিষেধ করা হয়েছে।’ (বুখারি, হাদিস নং- ২১৬১) অপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, কোনো শহরবাসী এককভাবে অবৈধ সিন্ডিকেট বা ব্যবসায়িক দুষ্টুচক্র করে গ্রামবাসীর পণ্য বিক্রি করবে না। মানুষকে ছাড় দাও; যাতে তারা একে অপরের মধ্যে স্বাধীন লেনদেন করে রিজিক হাসিল করতে পারে।’ (তিরমিযি, হাদিস নং-১২২৩)  এমনিভাবে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দালালি করে পণ্যের দাম বাড়ানোকে প্রতারণামূলক কাজ বলেছেন এবং নিষিদ্ধ করেছেন। অনুরূপভাবে দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কৃষককে ঠকানোও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ১০/১৬৪)

কেউ যদি মনে করে থাকে যে, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ থেকে দান খয়রাত কিংবা মসজিদ বানিয়ে তার কাফফারা বা প্রায়শ্চিত্ত করবো তারও সুযোগ নেই। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ মানুষদের সম্পর্কে কঠিন হুঁশিয়ারি বাণী উচ্চারণ করেছেন। অনেক দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক, এমপি, মন্ত্রী, চাকুরিজীবী, আমলা, ব্যবসায়ী দুর্নীতি করছে আর ভাবছে কিছু দান-খয়রাত করলে কিংবা মসজিদ মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, এতিমখানায় টাকা দিলেই তা মাফ হয়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে দাতা হিসেবে স্বীকৃতিও লাভ করা যাবে। এসবই মহাভুল। মহাবিপদ ডেকে আনা ছাড়া কিছুই নয়। মহান রাব্বুল আলামীন এসব লোকদের দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করবেন না। অনেক ক্ষেত্রে এই ভুল অনুধাবন এবং মহাবিপদ প্রত্যক্ষ করার জন্য আখেরাত বা পরজীবন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। পৃথিবীর জীবনেই তা শুরু হয়ে যায়। দুর্নীতি হচ্ছে অমানুষের জীবন; তা কথায় হোক কিংবা কাজে হোক। দুর্নীতি মানুষকে হেয় করে, আর মনুষ্যত্বের স্তর থেকে তাকে করে বিচ্যুত। মানবসমাজে সে বসবাসের অনুপযুক্ত। মানুষ তার দ্বারা হয় প্রতারিত ও বঞ্চিত। দুর্নীতিকে ‘না’ বলার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ইহকালের সফলতা আর পরকালের মুক্তি।

লেখক : শিক্ষক, রসুলপুর জামিয়া ইসলামিয়া ঢাকা
ahmadabdullah7860@gmail.com