নারীদের সর্বাঙ্গ পর্দার অন্তর্ভুক্ত

  • কাজী সিকান্দার | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ৮, ২০২১, ১১:৫৯ এএম

ঢাকা : ইসলামের সমস্ত বিধান মানুষের কল্যাণে। নিরাপত্তা, শৃংখলা, শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে রচিত ইসলামের রীতি-নীতি। মানুষের বুঝে আসুক বা না আসুক ইসলামের বিধানে রয়েছে শান্তির ফল্গুধারা। নিরাপত্তার গ্যারান্টি। সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের মূলমন্ত্র। সফল রাষ্ট্র তৈরির অবকাঠামো। তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বিধান দিয়েছেন তা বিনা বাধায়, প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নিতে হবে। নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। এটিই ঈমানের দাবি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন কিংবা মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অবকাশ থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অমান্য করলে সে স্পষ্টতই পথভ্রষ্ট হবে।’ (সুরা আহযাব, আয়াত-৩৬) ইসলামের রীতি-নীতির মধ্যে অন্যতম ফরজ বিধান হলো পর্দার বিধান। পর্দা পালনের মাধ্যমে যেমনভাবে শরিয়তের হুকুম পালন করা হবে তেমনিভাবে সাওয়াবের অধিকারী হবে। এটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য স্বস্তি ও পবিত্রতার রক্ষাকবচ হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এ বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ।’ (সুরা আহযাব, আয়াত-৫৩)

পবিত্রতার কারণে যে বিধান সেই বিধান হলো পর্দার বিধান। আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা যখন নারীদের (তাঁর স্ত্রীদের) কাছ থেকে কিছু চাইবে তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটা তোমাদের ও তাদের মনের অধিকতর পবিত্রতার জন্য খুবই উপযোগী (সুরা আহযাব, আয়াত-৫৩) অন্য আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে, মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। নামাজ কায়েম করবে, জাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র রাখতে।’ (সুরা আহযাব, আয়াত-৩৩) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নারী হলো সতর, তথা আবৃত থাকার বস্তু। (আলমুজামুল আওসাত ও তাবারানী) এমন আরো অনেক আয়াত ও হাদিস রয়েছে পর্দার ব্যাপারে।

মুহরিম ব্যতীত অন্য মহিলার দিকে দৃষ্টি দেওয়া, তাকানো জায়েজ নেই। আল্লাহতায়ালা বলেন, আপনি ঈমানদার পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে। এটাই হচ্ছে তাদের জন্য উত্তম পন্থা। কেননা তারা তাদের চোখ ও লজ্জাস্থান দিয়ে যা করে আল্লাহতায়ালা সে সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গভাবে অবহিত রয়েছেন।’ (সুরা নূর, আয়াত-৩০) এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, কোনো পুুরুষ অন্য মহিলার দিকে তাকাতে পারবে না। তা নাজায়েজ ও হারাম। যদি অনিচ্ছা সত্ত্বে হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যায় তখনকার বিধানে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হে আলী! নারীদের প্রতি প্রথম দৃষ্টির পর দ্বিতীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করো না। কেননা, প্রথম দৃষ্টি অনুমতি আছে দ্বিতীয়বারের অনুমতি নেই।’ (আহমাদ, মিশকাত পৃ-২৬৯)  হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে হজরত জাবের (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) হঠাৎ যদি দৃষ্টি পড়ে যায় তা হলে কী করবো? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাৎক্ষণিক দৃষ্টি ফিরিয়ে নিও।’ (আবু দাউদ) বুঝা গেলো যাদেরকে দেখা হারাম তাদের দিকে কোনোভাবে তাকানো যাবে না। হঠাৎ অনিচ্ছায় পড়ে গেলে সাথে সাথে ফিরিয়ে নিতে হবে। হঠাৎ যে দৃষ্টি পড়ে গেলো তা ইচ্ছার বাইরে তাই তার জন্য আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। আর যদি হঠাৎ দৃষ্টি পড়ার পর সাথে সাথে চোখ ফিরানো হয় তার জন্য আল্লাহতায়ালা পুরস্কারও রেখেছেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যখন কোনো মুসলমানের দৃষ্টি হঠাৎ বেগানা কোনো নরীর সৌন্দর্য্যের প্রতি পড়ে যায় অতঃপর সে তার চক্ষু বন্ধ করে নেয়, তাহলে আল্লাহতায়ালা তাকে এমন ইবাদতের সুযোগ সৃষ্টি করে দেন, যার স্বাদ সে অনুভব করতে পারে।’ (আহমাদ, মিশকাত :  পৃ-২৭০)

শিক্ষার ক্ষেত্রেও পর্দা করা অপরিহার্য। পীর, মুর্শিদ, শিক্ষক যেই হোক মুহরিম ব্যতীত সবার সাথে পর্দা ফরজ। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম বাইয়াতের সময় তাঁর (নবী সা-এর) হাত কখনো কোনো নারীর হাত স্পর্শ করেনি। তিনি শুধু মুখে বলতেন, তোমাকে বাইয়াত করলাম। (বুখারি ২/১০৭১)

মহিলাদের মুখসহ পূর্ণাঙ্গ পর্দা : মহিলা যখন ঘর থেকে বের হবে বা অন্য কোনো পুরুষের সামনে যাবে তখন তার পুরা শরীর ঢেকে রাখতে হবে। মুখসহ পুরো শরীর পর্দার অন্তর্ভুক্ত। কোনো অঙ্গই খোলা রাখতে পারবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সুরা আহযাব, আয়াত-৫৯) এ আয়াত দ্বারা বুঝে আসে মহিলা পুরো শরীর ঢেকে বের হবে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহতায়ালা মুমিন নারীদের আদেশ করেছেন যখন তারা কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে তখন যেন মাথার ওপর থেকে ওড়না/চাদর টেনে স্বীয় মুখমণ্ডল আবৃত করে। আর চলাফেরার সুবিধার্থে, শুধু এক চোখ খোলা রাখে। (ফাতহুল বারী ৮/৫৪,৭৬,১১৪) ইবনে সীরিন বলেন, আমি (বিখ্যাত তাবেয়ী) আবীদা (সালমানী রাহ.) কে উক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, কাপড় দ্বারা মাথা ও চেহারা আবৃত রাখবে এবং এক চোখ খোলা রাখবে।

সূরা নূরের ৩১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘হে নবী! মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, তারা যেন সাধারণ যা প্রকাশ থাকে তা ছাড়া নিজেদের আভরণ প্রদর্শন না করে। এখানে যে বলা হয়েছে যে, ‘সাধারণত যা প্রকাশ থাকে’। এর ব্যাখ্যায় হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত আছে যে, সাধারণত যা প্রকাশিত এর অর্থ হচ্ছে, কাপড়। (তাফসিরে তাবারী ১৮/১১৯) অর্থাৎ কাপড় প্রকাশ থাকে তা সবাই দেখে আর কাপড়ের ভেতর থাকবে মহিলা। পুরো শরীর কাপড়ে ঢেকে মহিলা বের হবে। মুখ, হাত, পা সবই পর্দার অন্তর্ভুক্ত।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা যেন গ্রীবা ও বক্ষদেশ মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে। (সুরা নূর, আয়াত-৩১) যাকে আমরা ঘোমটা বলি, মাথার কাপড় দিয়ে মুখ, বক্ষদেশ পর্যন্ত যেন ঢেকে যায় এমন কাপড় দেওয়া। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা প্রথম শ্রেণীর মুহাজির নারীদের প্রতি দয়া করুন। আল্লাহ তাআলা যখন এ আয়াত নাজিল করলেন, তখন তারা নিজেদের চাদর ছিঁড়ে তা দ্বারা নিজেদের মুখ আবৃত করেছিলেন।’ (বুখারি ২/৭০০) এর ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন, ‘‘ফাখতামারনা’’ এর অর্থ তারা মুখমণ্ডল আবৃত করেছেন। (ফতুহুল বারী ৮/৩৪৭) আল্লামা আইনি রহ. বলেন ‘‘ফাখতামারনা বিহা’’ এর অর্থ হলো- যে চাদর তারা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন, তা দিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডল আবৃত করলেন। (উমদাতুল কারী ১৯/৯২) আল্লামা শানকীতী (রহ.) বলেন, এ হাদিস থেকে বুঝা যায়, উপরিউক্ত মহিলা সাহাবিগণ বুঝতে পেরেছিলেন, যে এই আয়াত আল্লাহতায়ালা তাদেরকে মুখমণ্ডল আবৃত করারও আদেশ করেছেন। তাই তারা আল্লাহতায়ালার আদেশ পালনার্থে নিজেদের চাদর ছিঁড়ে তা দিয়ে মুখমণ্ডল আবৃত করেছেন। এত বছর পর এসে এখন আমরা এতো বেশি বুঝি যে, বর্তমানে অনেকে ফতোয়া দিচ্ছেন- মহিলাদের মুখ ঢাকতে হবে না।

আর কত স্পষ্টভাবে বললে আমরা বুঝবো যে নারীর সর্বাঙ্গ পর্দা। ইফকের দীর্ঘ হাদিসে হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি আমার স্থানে বসে ছিলাম একসময় আমার চোখ দুটি নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল এবং আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল আসুসলামী ছিল বাহিনীর পেছনে আগমনকারী। সে যখন আমার অবস্থানস্থলের নিকট পৌঁছল তখন একজন ঘুমন্ত মানুষের আকৃতি দেখতে পেল। এরপর সে আমার নিকট এলে আমাকে চেনে ফেলল। কারণ পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার আগে সে আমাকে দেখেছিল। সে তখন ইন্নলিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বলে ওঠে। যার দরুন আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি এবং ওড়না দিয়ে নিজেকে আবৃত করে ফেলি। অন্য রেওয়াতে আছে আমি ওড়না দিয়ে আমার চেহারা ঢেকে ফেলি। (বুখারি, হাদিস নং-৩২০, মুসলিম, হাদিস নং-২৭৭০, তিরমিযি হাদিস নং-৯১৭৯)

মহিলাদের মুখ ঢেকে পর্দা করতে হবে। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমরা যখন রাসুল-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম তখন আমাদের পাশ দিয়ে অনেক কাফেলা অতিক্রম করত। তারা যখন আমাদের সামনাসামনি চলে আসত তখন আমাদের সকলেই চেহারার ওপর ওড়না টেনে দিতাম। তারা চলে গেলে আবার তা সরিয়ে নিতাম।’ (মুসনাদে আহমাদ ৬/৩০ ও ইবনে মাজা) এ ব্যাপারে হজরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলেন, আমরা পুরুষদের সামনে মুখমণ্ডল আবৃত করে রাখতাম। (মুসতাদরাকে হাকেম ১/৪৫৪)  কোরআন ও হাদিস দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত মহিলার পুরো শরীর পর্দার অন্তর্ভুক্ত, চেহরা, হাত ও পা ঢেকে বের হতে হবে। মহিলার শরীরের কোনো অংশই খোলা রাখা যাবে না। পর্দার ক্ষেত্রে কয়েকটি জিনিস জরুরি। (ক) মাথা থেকে পা পর্যন্ত সম্পূর্ণ শরীর আবৃত করে নেওয়া। তা চাই বোরকা হোক বা অন্য কোন পন্থায়। (খ) পরিহিত বোরকা বা কাপড় ফ্যাশনমূলক না হওয়া। (গ) পরিহিত কাপড় মোটা বা এমন হওয়া যাতে শরীরে আকৃতি অনুধাবন করা না যায়। (ঘ) কাপড় ঢিলেঢালা হওয়া। (আবু দাউদ ২/৫৬৭, মুসলিম ২/২০৫, তিরমিযি ২/১০৭)

লেখক : পরিচালক, ইসলাহ বাংলাদেশ, আশরাফবাদ, ঢাকা
Kayisikandar83@gmail.com