হজের ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ স্থানসমূহ

  • মাওলানা মুহাম্মদ জিয়াউল হক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ৭, ২০২২, ০১:০০ পিএম

ঢাকা : হজের এক বড় শিক্ষা ‘শাআইরুল্লাহ’ সম্মান। শাআইরুল্লাহ মানে আল্লাহর ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষ স্থান ও বস্তু। এগুলোর সম্মান করা তাকওয়া ও খোদাভীতির অংশ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, আর কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে সম্মান করলে এতো তার হূদয়ের তাকওয়ারই বহিঃপ্রকাশ। (সুরা হাজ, আয়াত-৩২) কাবা, আরাফার ময়দান, মিনা, মুজদালিফা, মাকামে ইবরাহীম, হাজরে আসওয়াদ, হেরা গুহা ইত্যাদি যে মুমিনের কাছে সম্মানিত তা মূলত আল্লাহরই নির্দেশ। সুতরাং আল্লাহর দীনের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয়াদির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং এগুলোর মর্যাদা রক্ষা হজের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। দীনের প্রতি এবং দীনের সাথে সম্পর্কযুক্ত প্রতিটি স্থান, বস্তু ও ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হচ্ছে ঈমান রক্ষার অতিপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ।

কাবা শরীফ : মুসলমানদের সর্বপ্রথম ইবাদতস্থল পবিত্র কাবা। রহমত ও বরকতপূর্ণ একস্থানের নাম কাবা। কাবা শরিফের উচ্চতা পূর্ব দিক থেকে ১৪ মিটার, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে ১২.১১ মিটার এবং উত্তর দিক থেকে ১১.২৮ মিটার। এর ভেতরের মেঝে রঙিন মার্বেল পাথরে তৈরি। এর সিলিংকে তিনটি কাঠের পিলার ধরে রেখেছে। প্রতিটি পিলারের ব্যাস ৪৪ সে.মি.। কাবা শরিফের দুটি সিলিং রয়েছে। এর ভেতরের দেয়ালগুলো সবুজ পর্দায় আবৃত। এই পর্দাগুলো প্রতি তিন বছর পর পর পরিবর্তন করা হয়। এর ছাদে ১২৭ সে.মি. লম্বা ও ১০৪ সে.মি. প্রস্থের একটি ভেন্টিলেটর আছে, যেটি দিয়ে সূর্যের আলো ভেতরে প্রবেশ করে। এটি একটি কাচ দিয়ে ঢাকা থাকে। যখন কাবাঘরের ভেতরে ধোয়া হয় তখন এই কাচটি খোলা হয়। কাবা ঘরের ভেতরে প্রতি বছর দুবার ধোয়া হয়, শাবান মাসের ১৫ তারিখে এবং মহররম মাসের মাঝামাঝি সময়। মেঝে ও দেয়ালে গোলাপ, আতর মিশ্রিত জমজমের পানি দিয়ে ধোয়া দেওয়া হয়। ধোয়ার পরে মেঝে এবং দেয়াল সাদা কাপড় ও টিস্যু দিয়ে মোছা হয়। এরপর দেয়ালগুলো পারফিউম দিয়ে সুগন্ধযুক্ত করা হয়। কাবা শরিফের কালো কাপড়ের আবরণটি প্রতি বছর ৯ জিলহজ পরিবর্তন করা হয়। কাবা শরিফকে কালো গিলাফ দ্বারা ঢেকে রাখা হয়। বর্তমানে গিলাফ কালো রেশমি কাপড় দিয়ে নির্মিত, যার ওপর স্বর্ণ দিয়ে লেখা থাকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’, ‘আল্লাহু জাল্লা জালালুহু, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম’ এবং ‘ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান’। ১৪ মিটার দীর্ঘ এবং ৯৫ সেমি প্রস্থ। ৪১টি কাপড়ের টুকরা জোরা দিয়ে গিলাফ তৈরি করা হয়। এর চার কোণায় স্বর্ণ দিয়ে সুরা ইখলাস লেখা হয়। রেশমি কাপড়টির নিচে মোটা সাধারণ কাপড়ের লাইনিং থাকে। একটি গিলাফে ব্যবহূত রেশমি কাপড়ের ওজন ৬৭০ কিলোগ্রাম এবং স্বর্ণের ওজন ১৫ কিলোগ্রাম। বর্তমানে এটি তৈরিতে ২৫ মিলিয়ন সৌদি রিয়াল বা ৫৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা সমমূল্যের অর্থ ব্যয় হয়।

আরাফার ময়দান : সুবিশাল সবুজ প্রান্তর। দৈর্ঘ্য দুই মাইল। প্রস্থ দুই মাইল। যার তিন দিকেই পাহাড়। দক্ষিণ দিকে নবনির্মিত মক্কা শরিফ। এর পাশেই অবস্থিত উম্মুল কোরা বিশ্ববিদ্যালয় নগরী। এই ময়দানেই ৯ জিলহজ হাজিরা ‘উকুফে আরাফা’ করেন, যা হজের অন্যতম ফরজ বা রোকন। মক্কার মুয়াল্লা থেকে আরাফাতের মক্কা সংলগ্ন পশ্চিম সীমান্তের দূরত্ব সাড়ে ২১ কিলোমিটার। ঠিক এ পশ্চিম সীমান্তেই, আরাফাতের সীমানা শুরুর স্থানে দুটো পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। আরাফাত সাগরের স্তর থেকে ৭৫০ ফুট ওপরে অবস্থিত। আরাফার ময়দানের পুরো অংশই হারাম এলাকার বাইরে অবস্থিত। আরাফার ময়দান এক সময় উত্তপ্ত বালুময় হলেও এখন অবস্থা পাল্টেছে। এখন সেখানে সবুজ বৃক্ষ আর শীতল ফোয়ার পানি সব সময় পরিবেশকে কিছুটা হালকা ও শীতল করে রাখে। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের পরামর্শে সেখানে নিম গাছের চারা রোপণ করা হয়। এসব এখন পুরো আরাফার ময়দানকে সবুজ ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। আরাফার ময়দান থেকেই হজের খুতবা দেওয়া হয়।

মিনা : আরাফার মতোই আরেকটি বিশাল ময়দানের নাম মিনা। মক্কা নগরীর এক পাশে কাবা শরিফ থেকে সামান্য দূরেই এটি অবস্থিত। পুরো ময়দানটিই সাদা রঙের স্থায়ী তাঁবু দিয়ে সাজানো। দূর থেকে এগুলোকে অসংখ্য গম্বুজ মনে হবে। হাজীদের ৮ জিলহজ জোহরের আগে মিনায় থাকতে হয়। এদিন জোহর থেকে পরের দিন ফজর পর্যন্ত এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া সুন্নত। ৯ জিলহজ হাজীদের মিনা থেকে আরাফাহ ময়দানে যেতে হয়। ১০ জিলহজ মুজদালিফায় রাত যাপন করে ১১ জিলহজ সকালে মিনায় ফিরে জামরায় পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। জিলহজের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ এই তিনদিন মিনায় অবস্থান করা সুন্নত। মিনার বর্তমান চিত্র খুবই সুন্দর ও পরিপাটি একটি শহর। এটাকে বিশ্বের বৃহত্তর তাঁবুর শহরও ধরা হয়। ১৮ টি সুবিশাল তাঁবু নিয়ে গঠিত এই তাঁবুর শহর। এখানকার তিন দিন অবস্থানকারী হাজীদের জন্য কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে তৈরি করা হয় এসব তাঁবু।

মুজদালিফা : আরাফা ও মিনার মাঝামাঝি একটি জায়গার নাম মুজদালিফা। ৯ জিলহজ হাজীদেরকে আরাফাহ থেকে সূর্যাস্তের পর মিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার পর এখানেই রাত্রি যাপন করে। হাজীরা এখানে মাগরিব ও এশার নামাজ একসাথে আদায় করেন। মুজদালিফার পূর্ব সীমানার পিলারে আল্লাহর কুদরতে হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) দুনিয়াতে আসার পর এক সাথে প্রথম মিলিত হয়েছেন বলে রেওয়ায়েত আছে। মুজদালিফাতে অবস্থিত মসজিদটিতে হজের সময় হাজীরা নামাজ আদায় করেন। মুজদালিফায় হাজীদের রাত যাপন করতে হয়। এরপর হাজীরা এখান থেকে কঙ্কর নিয়ে মিনার উদ্দেশে রওনা দেন। মুজদালিফায় রাত্রি যাপনকারীকে আল্লাহতায়ালা রহমতের চাদরে দ্বারা আবৃত করে নেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুজদালিফার বর্তমানে অবস্থিত মসজিদের স্থানে ফজরের নামাজের পর দোয়া ও জিকিরে ব্যস্ত ছিলেন এবং সূর্যোদয়ের আগে আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখেন।

মসজিদ আল কিবলাতাইন : প্রতিদিন পাঁচবার নামাজ আদায় করি আমরা। যে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করি তার নাম কিবলা। ‘কিবলাতাইন’ শব্দটি দ্বারা দুটি কিবলা বুঝানো হয়। একই মসজিদে একই নামাজে প্রথমে জেরুজালেম এবং পরে মক্কার দিকে কিবলা পরিবর্তন করার কারণে মদিনা নগরের মসজিদ আল কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতের দ্বিতীয় বছরে আরবি রজব মাসের মাঝমাঝি সময়ে কিবলা পরিবর্তনের এ ঘটনা ঘটে। হাদিসবিশারদদের মতে, ওইদিন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মসজিদে জোহর বা আসর নামাজ আদায় করছিলেন। দুই রাকাত নামাজ আদায়ের পর হজরত জিবরাইল (আ.) জেরুজালেম নগরীর পরিবর্তে মক্কা নগরী অর্থাৎ পবিত্র কাবামুখী হয়ে নামাজ আদায়ের জন্য আল্লাহর নির্দেশ পৌঁছে দেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে কিবলা পরিবর্তন করে কাবামুখী হয়ে অবশিষ্ট দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। মসজিদে উপস্থিত সাহাবাগণও একইভাবে নবীজিকে অনুসরণ করে কাবামুখী হয়ে নামাজ আদায় করেন। ফলে এই দিনে একই মসজিদে একই নামাজে দুটি কিবলামুখী হয়ে নামাজ আদায় করা হয়। এ ঘটনার পর থেকেই এ মসজিদটি ‘মসজিদ আল কিবলাতাইন’ বা দুই কিবলার মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে। যার বর্ণনা পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারা ১৪৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে। ইসলামের ইতিহাসে মসজিদ আল কিবলাতাইনের আবদান চির ভাস্বর। মদিনায় আগমনকারী দেশ-বিদেশের সব মুসলমান নবীজির স্মৃতিবিজড়িত এই মসজিদটি দর্শন করে এক অনন্য প্রশান্তি অনুভব করে থাকেন।

মাকামে ইবরাহীম : মক্কার আরেকটি নিদর্শনের নাম মাকামে ইবরাহীম। মাকামে ইবরাহীম একটি পাথর যা কাবা শরিফ নির্মাণের সময় ইসমাইল (আ.) নিয়ে এসেছিলেন। পাথরটির ওপর দাঁড়িয়ে ইবরাহীম (আ.) কাবাঘর নির্মাণ করেন। ইসমাউল (আ.) পাথর এনে দিতেন এবং ইবরাহীম (আ.) তাঁর পবিত্র হাতে তা কাবার দেয়ালে রাখতেন। ওপরে উঠার প্রয়োজন হলে পাথরটি আল্লাহর কুদরতিভাবে ওপরের দিকে উঠে যেত। মাচার প্রয়োজন হতো না। পাথরটিতে হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর পদচিহ্নের একটি ১০ সেন্টিমিটার গভীর ও অন্যটি ৯ সেন্টিমিটার। লম্বায় প্রতিটি পা ২২ সেন্টিমিটার ও প্রস্থে ১১ সেন্টিমিটার। এক মিলিয়ন রিয়েল ব্যয় করে মাকামের বক্সটি নির্মাণ করা হয়েছে। পিতল ও ১০ মিলি মিটার পুরো গ্লাস দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে এটি। ভেতরের জালে স্বর্ণের আবরণ দেওয়া হয়েছে। হাজরে আসওয়াদ থেকে মাকামে ইবরাহীমের দূরত্ব ১৪.৫ মিটার। তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহীমের পেছনে দুরাকাত নামাজ আদায় করতে হয়।

হেরাগুহা : ঐতিহাসিক আরেকটি স্থানের নাম ‘গারে হেরা’। ইসলামিক নিদর্শনের মধ্যে এটি অনন্য একটি স্থান। এখানে বসেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধ্যান করতেন। ধ্যানমগ্ন রাসুলের ওপর সর্বপ্রথম অহি নাজিল হয় এখানেই। এখানে হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়ত লাভ করেন। যে কারণে এ পাহাড় ও গুহাটির মর্যাদা অনেক বেশি। হেরা গুহা মক্কার উত্তর দিকে অবস্থিত। মসজিদে হারাম থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। আর গুহাটি যে পাহাড়ে অবস্থিত তার নাম নূর পাহাড়। এর উচ্চতা ২০০ মিটার এবং এটি একটি খাড়া পাহাড়। মক্কার এটিই সর্বোচ্চ পাহাড়। হেরা গুহাটি পাহাড়ের চূড়া থেকে ৫০ মিটার দূরে। গুহার প্রবেশ পথ উত্তরমুখী এবং এর উচ্চতা মধ্যম আকৃতির একজন মানুষের উচ্চতার সমান। এ গুহাতে এক সাথে ৫ জন লোক বসতে পারেন। এখানকার একটি পাথরে খোদাই করে লেখা আছে সুরা ‘আলাকে’র আয়াতগুলো।

লেখক : শিক্ষাবিদ, খতিব, মদিনা জামে মসজিদ, রায়পুরা, নরসিংদী