রাসূল (সা.) এর জীবনাদর্শ ও বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০১৮, ০১:৩৬ পিএম

ঢাকা : মানুষ জ্ঞান ও কাজের দিক থেকে সকল প্রাণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তাই মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানুষের এ শ্রেষ্ঠত্বের প্রধান কারণ হলো তার চরিত্র। চরিত্র বলতে একজন মানুষের আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, ধর্মবোধ, ন্যায়বোধ ইত্যাদির সমন্বিত রূপকে বুঝায়। আর মানুষের কথায়, আচরণে ও চালচলনে যে ভদ্রভাব, সৌজন্যবোধ ও শালীনতার পরিচয় পাওয়া যায়, তাকে সামগ্রিক অর্থে শিষ্টাচার বলা হয়। শিষ্টাচার মানবচরিত্রের অলঙ্কার। চরিত্রের সৌন্দর্যেই মানুষ আলোকিত হয়ে ওঠে এবং আদর্শ ও অনুকরণীয় হিসাবে অভিষিক্ত হয়ে থাকে। মানুষের মধ্যে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন, হযরত মুহাম্মদ (সা.)। যিনি আমাদের নবী ও রাসূল। আল্লাহর প্রেরিত মহামানব। যিনি ছিলেন বিশ্ববাসীর মুক্তির দিশারী। সবার জন্য এক অনুকরণীয় আদর্শ।
আল্লাহ বলেন, রাসূলের জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। (আল কুরআন)
হযরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও শ্রেষ্ঠ রাসূল। তিনি ছিলেন শেষ নবী। বিশ্ব মানবের ইতিহাসে মহানবী (সা.)-এর স্থান সবার উপরে। তাঁর তাকওয়া, অনুপম ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র মাধুর্য্য আমাদের সকলের জন্য অনুসরণযোগ্য।
রাসূল (সা.) ছিলেন আল্লাহর নবী একই সঙ্গে একজন মানুষ। এই উভয় পরিচয়ে তিনি সত্য ও সুন্দরকে ভালোবেসেছেন। তাঁর দৈনন্দিন জীবন আচরণ, অভ্যাসের মধ্যে আমরা চরিত্র গঠনের অনেক উপাদান খুঁজে পাই।
আজ নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে। ইসলাম নৈতিক শিক্ষার পাঠ দেয় পরিবার থেকেই। নবী জীবনে নৈতিক শিক্ষার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। তিনি সালাম দেয়ার প্রচলন করেন।
সালাম বিনিময় মুসলমানদের একটি সাধারণ রীতি। সালাম সম্ভাষণের মাধ্যমে আমরা একে অপরের শুভ কামনা করে থাকি। রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমরা সেইসব মুসলমানদের সালাম কর, যে তোমাদের নিকট পরিচিত। তাকেও সালাম কর, যে তোমার নিকট অপরিচিত।’
সালাম করার সময় বলতে হয়, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
অর্থাৎ- ‘তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক’। যিনি সালামের জবাব দিবেন তিনি বলবেন, ‘ওয়াআলাইকুমুস সালাম’। অর্থাৎ ‘তোমার উপরও শান্তি বর্ষিত হোক।
হযরত আনাস (রা.) বর্ণনায় জানা যায়, ‘রাসূল (সা.) যখন শিশুদের পাশ দিয়ে যেতেন তিনি তাদের অভিবাদন করতেন। বলতেন, সালামু আলাইকুম।’-এ ছিল তার স্বভাব।
সালাম দেয়া এমন একটি ভাল রীতি যা আনন্দঘন পরিবেশে কোন সুখী মানুষকে যেমন দেয়া যায় আবার তেমনি কষ্টকাতর কোন দুঃখী মানুষকেও সালাম দেয়া যায়। যা হয় অত্যন্ত সময় উপযোগী ও প্রাণবন্ত। শুভ কামনা করা হয় বলে সালাম আমাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে। সালাম সামাজিক সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। কোন ভালো কাজের শুরুতে আমরা বিসমিল্লাহ বলি। বিসমিল্লাহ অর্থ ‘আল্লাহর নামে শুরু করছি। হাদিস শরীফে কোন কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলার তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ আমাদের প্রভু। তিনি অতি উত্তম কার্য সম্পাদনকারী তাই কোন কাজের শুরুতে আমরা তার নামেই শুরু করবো। আবার শেষও করবো তাঁর প্রশংসা দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ (যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য) বলে। মনে রাখবে কোন অন্যায় কাজের শুরুতে ও শেষে বিসমিল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ বলা যাবে না। কেননা, এগুলো শয়তানের কাজ। আর আল্লাহর অনুগ্রহ কেবল ন্যায় ও সৎ কাজের সাথে থাকে। উল্লেখ্য, একটি বাংলা বাগধারা রয়েছে, ‘বিসমিল্লায় গলদ’-এ দ্বারা বুঝানো হয়ে থাকে কাজের শুরুতেই ভুল। আক্ষরিক অর্থ করলে দাঁড়ায় আল্লাহর নামে গলদ বা ভুল (নাউজুবিল্লাহ)। একজন মুসলমান এ ধরনের কথা বলতে পারে না। আমরা না বুঝেই এরূপ বলি। আমাদের বোধ-বিশ্বাস ও ইসলামী পরিভাষার সাথে বাংলা এই বাগধারাটি সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই এটি আমাদের কথায় ও লেখায় পরিহার করা উচিত। মুসলমানদের গৃহে প্রবেশের নিয়ম কত না শালীন ও সৌহার্দ্যপূর্ণ। হাদিসে এসেছে, ঘরে প্রবেশের সময় প্রথমে বিসমিল্লাহ বলবে। অতঃপর পরিবার-পরিজনকে সালাম বলবে। অপরদিকে অন্য কারো গৃহে প্রবেশকালে অনুমতি প্রার্থনা করবে এবং দরজার বাইরে থেকে অনধিক তিনবার সালাম দিবে। অনুমতি না পেলে ফিরে যাবে এ সময় নিজের নাম বলা উত্তম। (মুসলিম/মেশকাত)
মহানবী (সা.) দৈনন্দিন জীবনে কার্য উপলক্ষে অনেক দোয়া পড়েছেন এবং উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন। এসব মাসনুন দোয়ায় যেমন আল্লাহর স্মরণ রয়েছে, তেমনি চরিত্র গঠনের উপাদানও রয়েছে। আয়না দেখার সময় আল্লাহর রাসূল (সা.) শিখিয়েছেন, আয়নায় আপন চেহারা দেখে বলবে, “আল্লাহুম্মা আনতা হাসসানতা খালকী ফাহাসসিন খুলুকী।” অর্থ : “হে আল্লাহ আপনি আমার চেহারাকে সুন্দর করেছেন, অতএব আপনি আমার চরিত্রকেও সুন্দর করে দিন। বন্ধুরা! একটু গভীরভাবে খেয়াল কর এই দোয়ার ভিতর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও চরিত্র গঠনের গুরুত্ব কত না সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। কেউ যদি এই দোয়াটি বুঝে আমল করে তবে সে কখনও আল্লাহর অকৃতজ্ঞ বান্দা হতে পারে না। চরিত্রহীন কোন কাজও করতে পারে না। রাসূল (সা.) এর জীবন ছিল ভব্যতা-সভ্যতা ও শিষ্টাচারের এক অপূর্ব সমাহার।
তিনি (সা.) বলেছেন, “যারা আমাদের ছোটদের আদর করে না এবং বড়দের সম্মান করে না তাদের সাথে আমার সম্পর্ক নেই।”
রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, “কারো সাথে দেখা হলে একটু মিষ্টি করে হাসা উত্তম ছদকা।”
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আব্বা-আম্মাকে খুশি রাখার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, সন্তানের প্রতি পিতা খুশি থাকলে আল্লাহও খুশি থাকবেন। পিতা খুশি না থাকলে আল্লাহ খুশি থাকবেন না। মা-বাবার প্রতি সদাচরণ ও ভাল ব্যবহার করার জন্য মহান প্রভু আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। নবী জীবনের একটি ঘটনা থেকে আমরা পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি।
রাসূল (সা.) সাহবীদের এক সভায় আলোচনা রাখছিলেন। এমন সময় একজন ভদ্র মহিলা সেখানে আসলেন। রাসূল (সা.) উঠে গিয়ে তাকে সালাম জানালেন এবং নিজের গায়ের গেলাফ মাটিতে বিছিয়ে দিয়ে তাঁকে বসতে বললেন। সাহবীরা অদূরে বসে দেখছেন। ভাবছেন, কে এই সৌভাগ্যবান নারী যে বিশ্বনবীর (সা.) গায়ের চাদরে বসার স্পর্ধা দেখাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর আগন্তুককে বিদায় দিয়ে নবীজী (সা.) ফিরে এলেন মজলিসে। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর নবী কে এই মহিয়সী নারী? বিশ্বনবী (সা.) বললেন, উনি আমার দুধ মা বিবি হালিমা। মায়ের প্রতি ভালোবাসা, নারীর প্রতি সম্ভ্রম প্রদর্শনের এর চেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর কি হতে পারে। মিথ্যা না বলা, সত্যাশ্রয়ী হওয়া, ক্ষমা করা, ওয়াদা পালন, আমানতদার হওয়া সবক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল (সা.) এক অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন। একবার এক লোক এসে রাসূল (সা.) কে বললো, “আমি অনেক খারাপ কাজ করি। সব মন্দ কাজ আমার পক্ষে একবারে ত্যাগ করা সম্ভব নয়। আপনি আমাকে একটি পাপ কাজ ত্যাগ করার নির্দেশ দিন।” মহানবী (সা.) বললেন, “ঠিক আছে তুমি মিথ্যা কথা বলবে না।”
লোকটি বললো, এতো খুব সহজ কাজ। পরে দেখা গেলো, মিথ্যা কথা বলা ছাড়ার কারণে লোকটির পক্ষে- আর কোনো খারাপ কাজ করা সম্ভব হলো না। এই ছোট পরিসরে রাসূল (সা.) চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। রাসূল (সা.) বিদায় হজ্বে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তার অংশ বিশেষ তোমাদের সামান্য তুলে ধরতে চাই। বন্ধুরা! দেখবে সেখানে নবীজি (সা.) মানবতার উৎকর্ষ সাধনে কত মূল্যবান ও ভালো ভালো কথা বলে গেছেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন,
* হে মুসলিম, আঁধার যুগের সমস্ত ধ্যান ধারনাকে ভুলে যাও, নব আলোকে পথ চলতে শিখো। আজ হতে অতীতের সব মিথ্যা সংস্কার, অনাচার ও পাপ প্রথা বাতিল হয়ে গেল।
* মনে রাখবে- সব মুসলমান ভাই ভাই। কেউ কারো চেয়ে ছোট নয়। কারো চেয়ে বড় নয়। আল্লাহর চোখে সবাই সমান।
* নারী জাতির কথা ভুলে যেও না। নারীর ওপর পুরুষের যেরূপ অধিকার আছে, পুরুষের ওপর নারীরও সেরূপ অধিকার আছে। তাদের ওপর অত্যাচার করো না। মনে রাখবে, আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তোমাদের স্ত্রীগণকে গ্রহণ করেছো।
* প্রত্যেক মুসলমানের ধন-প্রাণ পবিত্র বলে জানবে। যেমন পবিত্র আজকের এই দিন, ঠিক তেমনি পবিত্র তোমাদের পরস্পরের জীবন ও ধন সম্পদ।
* দাস-দাসীদের প্রতি সর্বদা সদ্ব্যবহার করবে। তাদের ওপর কোনরূপ অত্যাচার করবে না। তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তাই খাওয়াবে। যা পরবে তাদেরকেও তাই পরাবে। ভুলোনা- ওরাও তোমাদের মত মানুষ।
* সাবধান! পৌত্তলিকতার পাপ যেন তোমাদের স্পর্শ না করে। র্শিক করবে না। চুরি করবে না, মিথ্যা কথা বলবে না। ব্যভিচার করবে না। সর্ব প্রকার মলিনতা হতে নিজেকে মুক্ত করে পবিত্রভাবে জীবনযাপন করবে। চিরদিন সত্যাশ্রয়ী হয়ে থাকবে।
* বংশের গৌরব করবে না। যে ব্যক্তি নিজ বংশকে হেয় মনে করে অপর এক বংশের নামে আত্মপরিচয় দেয়, আল্লাহর অভিশাপ তার ওপর নেমে আসে। (বোখারী-মুসলিম)
তাই বলবো, এসো আমরা রাসূল (সা.) কে জানি। তার আদর্শে জীবন গড়ি। তবেই কেবল আমাদের জীবন থেকে সকল দুঃখ-ক্লেশ জরা কুহেলিকা, কুসংস্কার দূরীভূত হবে। নেমে আসবে শান্তির ফল্গুধারা। এসো দরুদ পড়ি- “ইয়া রাব্বি সাল্লি ওয়া সাল্লিম দায়েমান আবাদান আলা হাবিবিকা খায়রিল খালকী কুল্লিহীম।”
সোনালীনিউজ/আরজে