মক্কায় নবী করিম (সা.) এর নেতৃত্বসুলভ ভূমিকা

  •  ধর্মচিন্তা ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ১৩, ২০১৯, ১০:০৩ এএম

ঢাকা: মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে মহানবী (সা.) ‘হরবে ফুজ্জার’-এ অংশগ্রহণ করেন। তিনি নিজের গোত্রের পক্ষে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মহানবী (সা.) এর যুদ্ধের এই স্তরটিই পরবর্তী সময়ে তার নেতৃত্বের ভিত্তি হয়ে যায়। বহু প্রমাণাদির আলোকে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, বিশ্বনবী (সা.) এর যুগে মক্কায় প্রচলিত অর্থে নিয়মতান্ত্রিক কোনো রাজত্বের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল না। এ জন্যই কোরাইশি গোত্রগুলোর ভূমিকা সীমাবদ্ধ ছিল। এর বিপরীতে মহানবী (সা.) তার মক্কী জীবনেই একজন দূরদর্শী এবং আদর্শ নেতার ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। এর কয়েকটি দৃষ্টান্ত আমরা তুলে ধরছি : 

এক. হিলফুল ফুজুল প্রাগৈতিহাসিক জাহেলি যুগের ভারসাম্যহীনতা, গোলযোগ ও শৃঙ্খলাহীনতার স্মারক। এই চুক্তি মক্কায় রাজনৈতিক অনুপস্থিতি, অস্থিতিশীলতা ও সামাজিক বিভ্রান্তির কারণেই আত্মপ্রকাশ করেছিল। হিলফুল ফুজুলের চুক্তিতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মাত্র বিশ বছর বয়সে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই চুক্তি আবদুল্লাহ ইবনে জাদআনের ঘরে সম্পাদিত হয়েছিল। এতে বনি হাশিম, বনি মুত্তালিব, বনি আসাদ জুহরা বিন কিলাব ও বনি তাইম ইবনে মুররাও অংশগ্রহণ করেছিলেন। এমন একটি ঐতিহাসিক চুক্তিতে মাত্র বিশ বছর বয়সে বিশ্বনবী (সা.) এর অংশগ্রহণ আপন স্থানেই বিস্ময়কর! এরপর এটাও বাস্তব যে, মহানবী (সা.) সারাজীবন এই চুক্তিতে অংশগ্রহণ করতে পারায় গর্ববোধ করতেন! এ বিষয়টি মহানবী (সা.) এর মহত্ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, মানবপ্রেম, দুঃখী জনতার পাশে দাঁড়ানো, শান্তি ও নিরাপত্তাকামী হওয়ার বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তোলে!
যদি মক্কার পুণ্যভূমিতে রাজনৈতিক মেলবন্ধন শক্তিশালী ও সুদৃঢ় হতো, তা হলে এই চুক্তি ও সংগঠনে আরবের সবগুলো গোত্রই অংশগ্রহণ করত। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, এই চুক্তিতে শুধু পাঁচটি গোত্র অংশগ্রহণ করেছিল। 

দুই. হাজরে আসওয়াদ স্থাপনকে কেন্দ্র করে আরবের গোত্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ সাজ পরিলক্ষিত হয়েছিল। এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, মৌলিকভাবেই আরবে কোনো রাজনৈতিক শৃঙ্খলা বিদ্যমান ছিল না। প্রতিটি ব্যক্তি এবং প্রত্যেকটি গোত্র নিজ নিজ ডঙ্কা বাজাত এবং নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে প্রকাশ করতে চাইত। কিন্তু মহানবী (সা.) এর বিদ্যমানতায় তাদের নিম্নতর মনে হচ্ছিল। মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের শিরস্ত্রাণ শুধু মহানবী (সা.) এর শিরেই মানানসই বলে দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। তাই আল্লাহ তায়ালা হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের সময় মহানবী (সা.) এর বড়ত্ব ও মনোনীত হওয়ার বিষয়টি সাব্যস্ত করে দেন। এ সময় গোত্রগুলোর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা মহানবী (সা.) এর ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বকে নেতা হিসেবে মেনে নিতে হৃষ্টচিত্তে সম্মত হয়ে যায়। আর এভাবেই মহানবী (সা.) সব সর্দারের উপস্থিতিতে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করে অভ্যন্তরীণ অর্থে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন!

তিন. মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে মহানবী (সা.) ‘হরবে ফুজ্জার’-এ অংশগ্রহণ করেন। তিনি নিজের গোত্রের পক্ষে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মহানবী (সা.) এর যুদ্ধের এই স্তরটিই পরবর্তী সময়ে তার নেতৃত্বের ভিত্তি হয়ে যায়। 
চার. এটাও মহানবী (সা.) এর নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্বই ছিল যার অনুমতি পেয়ে মক্কার নিপীড়িত, নির্যাতিত মুসলমানরা হাবশায় হিজরত করেন। এ সময় মহানবী (সা.) হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশীর কাছে যে পত্র লেখেন তার প্রতিটি অক্ষরই এ বিষয়ের সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এই পত্রের প্রেরক বহু গুণের আকর এক সুমহান সত্তা! 

পাঁচ. ইসলামের আহ্বায়ক ও দায়ী হিসেবে মহানবী (সা.) কে বহু ধৈর্যের ঘাঁটি অতিক্রম করতে হয়েছিল এবং মক্কার মুশরিকরা সবসময় সত্যের আওয়াজের বিরোধিতা করে গিয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য আহলে ইয়াছরিব তথা মদিনাবাসীকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। এটাই ছিল ওই স্তর যার মাধ্যমে একদিকে এই সত্য স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ইসলাম কোনো স্থান ও কালের ধর্ম নয়, বরং তা সর্বকালীন ও সর্বজনীন ধর্ম। আর এই পবিত্র দ্বীন ও ধর্মের প্রতি আহ্বানকারী ব্যক্তিও চিরন্তন শ্রেষ্ঠত্ব ও নেতৃত্বের বিশেষণে বিশেষিত।

এ জন্যই মক্কাবাসীর ঔদ্ধত্য ও অহংকারের বিপরীতে মদিনাবাসী চিরন্তন এই ধর্মকে সাগ্রহচিত্তে গ্রহণ করে নিয়েছিল এবং এই দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে তারা মহানবী (সা.) এর সাহায্য ও সহযোগিতাকারী হয়ে গিয়েছিল। তৎকালীন যুুগে মদিনার অধিবাসীরা বিভিন্ন ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাসে নিরত ছিল। এখানে আরবের পৌত্তলিকরা থাকত। থাকত ইহুদিরাও। আর অল্প সংখ্যক খ্রিষ্টানও সেখানে বিদ্যমান ছিল। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুশরিকদের দুটি বড় গোত্র আওস ও খাযরাজের যুবকদের বিশ্বনবী (সা.) এর সাহায্যকারী আনসার বানিয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে যখন আকাবার বাইআত সংঘটিত হয়েছিল তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মদিনার পরিবেশে মৌলিক পরিবর্তনের ভিত্তি সূচিত হয়ে গিয়েছিল। এভাবে মহানবী (সা.) এর নেতৃত্বের আলো অধিক পরিমাণে উজ্জ্বল হয়ে দীপ্তি বিকিরণ করছিল।

এসব অবস্থা এবং প্রতিভার স্ফুরণ ও বিচক্ষণতা এ বিষয়ের স্পষ্ট প্রমাণ যে, যখন আল্লাহ তায়ালা রাসুলুল্লাহ (সা.) কে সর্বশেষ নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন তখন কেয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য তার পবিত্র সত্তাকে হেদায়েত ও সৌভাগ্যের আদর্শ বানিয়েছেন। আর কেয়ামত পর্যন্ত সময়ে মানুষ ও মানবতার জন্য প্রতিটি যুগ ও সভ্যতার কল্যাণে সব ধরনের দিকনির্দেশনার জন্য তাকেই আলোর মিনার সাব্যস্ত করা হয়েছে। মহানবী (সা.) এর এই মর্যাদা এবং শ্রেষ্ঠত্বই সামনে অগ্রসর হয়ে মদিনা শরিফে সর্বপ্রথম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হয়ে গিয়েছিল। 

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এসআই