ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারই লক্ষ্য

তিতাসে চলছে শুদ্ধি অভিযান

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ৯, ২০১৯, ০২:১৪ পিএম

ঢাকা : অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি কিংবা ঘুষ লেনদেন- এমন কোনো শব্দ নেই যে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে যোগ করা যায় না। তবে বদলে যেতে চায় রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি। হারিয়ে যাওয়া ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে ইতোমধ্যে ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, সরকারের সংশ্লিষ্টমহল থেকে চাওয়া তিতাসের দুর্নাম কমাতেই হবে। কমাতে হবে দুর্নীতির মহোৎসব। এ লক্ষ্য অর্জনে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একজন সৎ, পেশাদার ও মেধাবী কর্মকর্তাকে। সরকারের অতিরিক্ত সচিব মোস্তফা কামাল বর্তমানে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে রয়েছেন। সাধারণত তিতাসের এমডি পদে এত উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা আগে দায়িত্ব পালন করেননি। শুধু উচ্চ পর্যায়ের নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সাবেক এই মেধাবী শিক্ষার্থীর দক্ষতাও এরই মধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। তিনি একই সঙ্গে পেট্রোবাংলারও পরিচালক।

এ প্রতিবেদক প্রতিষ্ঠানটির এমডি মোস্তফা কামালের সঙ্গে কথা বলেন। জানতে চান প্রতিষ্ঠান নিয়ে তার কর্মপরিকল্পনা। তিনি বলেন, তিতাসের সুনাম বাড়াতে চাই। সরকারের চাওয়া তিতাস গ্রাহকবান্ধব ও দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সামনে আসুক। আমি সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, আমি বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এরই মধ্যে বেশ কিছু কার্যক্রম আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। সবার সহায়তা চাই। আমরা আরো ভালো কিছু কর্মকাণ্ড হাতে নিতে যাচ্ছি বলেও জানান তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান এমডি একজন পেশাদার কর্মকর্তা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সর্বস্তরে একটি বার্তা পৌঁছে গেছে, বর্তমান এমডি কোনো ধরনের অনিয়ম বরদাস্ত করবেন না। তাই প্রধান কার্যালয়সহ সর্বস্তরে কিছুটা সতর্কতা কাজ করছে। সম্প্রতি মোস্তফা কামালকে বদলির আদেশ দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় সংশ্লিষ্টরা এই কর্মকর্তাকে তিতাসের হাল ধরে রাখতে প্রস্তাব দিয়েছেন।

একজন করপোরেট গ্রাহক আলাপকালে বলেন, এমডির মনোভাব ইতিবাচক । আগে তিতাসে এলে আমরা শিল্প উদ্যোক্তারা অনেক সময় সঠিক সম্মানও পেতাম না। তিতাসের কর্মকর্তাদের মধ্যে একটা মনোভাব ছিল, গ্রাহকরা যেন জিম্মি। কিন্তু গ্রাহকের অর্থে তিতাস চলে। আমরা তিতাসের মূল্যবান গ্রাহক। আমরা গ্যাস কিনে শিল্পে ব্যবহার করি।

এই গ্রাহক বলেন, মোস্তফা কামাল গ্রাহকসেবাকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। গ্রাহকের সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত সেবা দিতে গিয়ে বিধি-বিধান বাধা হলেও তা প্রয়োজনে সংশোধন করতে উদ্যোগ নিচ্ছেন। আগে এমনটি হতো না। আইন ও বিধির কথা বলে দিনের পর দিন গ্রাহককে জিম্মি করে ঘুষ আদায় করা হতো। আর এখন এমডি প্রয়োজনে গ্রাহকের সঙ্গে নিজেই কথা বলেন। তার অফিসের দরজা ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে বড় গ্রাহকের জন্য সবসময় খোলা।     

তিতাসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, তিতাসের বাইরের কাউকে এর এমডি করায় কোম্পানিটির অভ্যন্তরে যেসব দলাদলি চলছিল, সেটিও এখন প্রায় কমে গেছে। অনেকটাই চুপসে গেছে শাস্তির ভয়ে। শুধু তা-ই নয়, তিতাসের দুর্নীতিবাজ ও তদবিরবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যেও ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। তারাও আপাতত মুখ চেপে বসে আছেন। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পদে যে রদবদল হয়েছে, তা নিয়েও তৈরি হয়নি কোনো বিশৃঙ্খলা।

গত কয়েক দিনে শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে একই দায়িত্বে দীর্ঘদিন থাকা তিন শতাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে বদলি করা হয়েছে নতুন দায়িত্বে। এর মধ্যে ৮১ জন প্রকৌশলীও রয়েছেন। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ৪ থেকে ২৪ বছর প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ এলাকার একই অফিসে কাজ করছিলেন। অভিযোগ আছে, একই কর্মস্থলে বছরের পর বছর থাকায় তারা শক্তিশালী ঘুষ-দুর্নীতির সিন্ডেকেটে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সম্প্রতি এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপর জ্বালানি বিভাগের আদেশে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার শুরু করে তিতাস।

জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানা রকম দুর্নীতির কারণে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা ক্ষুব্ধ।

দুর্নীতি বন্ধে তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, এমনকি তাদের সন্তান-সন্ততিদেরও সম্পত্তির হিসাব আদায় করবে; তাদের ব্যাংক হিসাব চেক করবে, প্রয়োজনে জব্দও করা হতে পারে আগামীতে।

জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তার মতে, তিতাসে যে নগ্ন দুর্নীতি হচ্ছে, তা সাধারণ মানুষের মধ্যে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এ নিয়ে মন্ত্রণালয় উদ্বিগ্ন। কারণ এর দায় জ্বালানি বিভাগের ওপরও বর্তায়। তবে যেভাবে পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে তাতে শিগগিরই গ্রাহকরা আরো প্রশংসা করবেন।

তিতাসে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হচ্ছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার মাধ্যমে। এর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জড়িত তিতাসের অঞ্চলভিত্তিক বিক্রয় বিভাগের কর্মকর্তারা। বিশেষ করে বিভিন্ন জোনে বিক্রয় বিভাগে ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে আছেন যারা। কোম্পানির সিবিএ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শীর্ষ কর্মকর্তারাও এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে অবৈধ সংযোগ অপসারণে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অবৈধ সংযোগ রয়েছে, এমন এলাকা চিহ্নিত করে গোড়া থেকেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া যেসব কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা অবস্থায় অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়েছে তাদের তালিকা প্রণয়ন করে বিচারের আওতায় আনা হবে।

এ ছাড়া যেসব কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকাকালীন তার অধীনস্থ জোনে বকেয়া বিল জমা হয়েছে সেসব কর্মকর্তারও তালিকা করা হবে। তাদের কাছে জবাবদিহিতা চাওয়া হবে। একই সঙ্গে বকেয়া বিল আদায়ে কঠোর অভিযান চালানো হবে। গ্যাসের সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করতে সব পর্যায়ের গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনা হবে। তিতাস গ্যাসের নিজস্ব অর্থায়নেই যেন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

গত এপ্রিলে তিতাসের অপেক্ষাকৃত ওপরের সারির কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির কাঠামোর বাইরে গঠিত ১৮টি ভিজিল্যান্স টিম বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এবার মধ্যম শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্মস্থল বদলে দিল প্রতিষ্ঠানটি।

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন, দুদকের প্রতিবেদন ধরে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। এরপর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন দুর্নীতি না করতে পারে সে বিষয়ে নজর রাখা হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অংশ হিসেবেই এই বদলি করা হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই