কেন একই ভাগ্য নাছির-খোকনের

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০, ০২:৩২ পিএম

ঢাকা : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকনের ভাগ্যবরণ করতে হলো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে। দ্বিতীয় দফায় মেয়রপদে নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি তিনিও।

ডিএসসিসির পর শূন্য হওয়া ঢাকা-১০ সংসদীয় আসনেও দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পেলেন না খোকন। তাদের মনোনয়ন না পাওয়া নেতাকর্মীদের কাছে শুধু ‘বিস্ময়করই’ নয়, নানা আলোচনার ও প্রশ্নেরও জন্ম দিচ্ছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব বিশেষ বিবেচনায় দুই সিটির নির্বাচনে প্রথমবারের মতো দলীয় মনোনয়ন দিলেও মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তারা দলের ভাবমূর্তি বাড়াতে পারেননি, উল্টো বিতর্কিত করেছেন।

তাদের ওপর দল যে আস্থা রেখেছিল, তা তারা পূরণ করতে পারেননি। মনোনয়ন চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়া ছাড়াও বিতর্ক, দলীয় কোন্দল ও জনদুর্ভোগ লাঘবে ব্যর্থতাসহ আরো কিছু দিক থেকে দুই মেয়রের মধ্যে মিল আছে।

নিজের নির্বাচনি এলাকায় একক আধিপত্য তৈরির চেষ্টা, কেন্দ্রীয় ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন না করার মতো আচরণ দুই মেয়রই করেছেন বলে ব্যাপক অভিযোগ আছে।

ফলে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাছির এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে খোকনের বড় পরিসরে আপাতত ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকছে না। দলীয় রাজনীতিতে দুজন ক্রমেই ‘গুরুত্বহীন’ হয়ে পড়ছেন। দুজনের ‘রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ’ নিয়ে অনুসারীদের মধ্যে নানা প্রশ্ন আছে। নাছির দলের কোনো পদে নেই আর খোকনকে ‘রাজনৈতিক কৌশলের’ কারণে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হলেও তা নামেমাত্র।

ডিএসসিসির সবশেষ নির্বাচনে ফজলে নূর তাপস মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়ার পর সাঈদ খোকন আওয়ামী লীগের সভাপতির ধানমন্ডি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, তার রাজনৈতিক জীবনের এখন ‘সবচেয়ে কঠিন সময়’। সেই ‘কঠিন সময়’ পার করতে না করতেই আবারো কঠিন সময়ে খোকন পড়তে যাচ্ছেন বলে সরকারি দলের নীতিনির্ধারক সূত্র জানায়।

তথ্যমতে, আগামী ২৯ মার্চ অনুষ্ঠেয় চসিকের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি আ জ ম নাছির। মেয়র পদে এবার দলটির মনোনয়ন পেয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী। অনেকটা নাটকীয়ভাবে তিনি মেয়র পদে মনোনয়ন পেলেন। মনোনয়ন দৌড়ে তিনি ছিলেন একেবারে পেছনের দিকে।

গত শনিবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলের সংসদীয় ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের যৌথসভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। দেশের শূন্য হওয়া পাঁচটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীও ওই যৌথসভায় চূড়ান্ত হয়।

শূন্য হওয়া ঢাকা-১০ আসনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন। নানা কারণে আওয়ামী লীগের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ওই আসনের উপনির্বাচনে দলটির মনোনয়ন পেলেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।

ডিএসসিসির মেয়র পদে মনোনয়ন না পাওয়ার পর খোকন ব্যর্থ হন ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে দলের নজর কাড়তে। গত ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ডিএসসিসির নির্বাচনে অংশ নিতে ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন ফজলে নূর তাপস।

সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত চসিক নির্বাচনে দলের মনোনয়নে মেয়র প্রার্থী হতে চান সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তখন মহিউদ্দিনকে গণভবনে ডেকে এনে তাকে দলের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে বা মন্ত্রিসভায় আসার প্রস্তাব দেন।

দলের অন্য কাউকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়ে চট্টগ্রামে দলের নেতৃত্ব সৃষ্টি করার পরিকল্পনার কথাও প্রধানমন্ত্রী তখন জানান মহিউদ্দিনকে। ওই সুযোগে তখন মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান নাছির উদ্দীন। মেয়র হিসেবে নির্বাচিতও হন তিনি।

মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাসখানেক পরই নাছির দ্বন্দ্বে জড়ান দলের প্রবীণ নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে। দলের অনেক নেতাকর্মী মনে করেন, তাদের দ্বন্দ্বের মূল কারণ চট্টগ্রাম বন্দর। বন্দরের শ্রমিক রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাতে। আর বন্দর-সংক্রান্ত ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন মেয়র নাছির। তাদের দ্বন্দ্ব অনেকদূর গড়ায়।

২০১৭ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তার অনুসারীদের সঙ্গে স্নায়ু-দ্বন্দ্ব তৈরি হয় মেয়র নাছিরের।

সর্বশেষ গত বছর একটি অনুষ্ঠানে মহিউদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিনকে মঞ্চ থেকে অশোভনভাবে নামিয়ে দেওয়ার বিতর্ক সেই স্নায়ুযুদ্ধকে অনেকটা প্রকাশ্য রূপ দেয়।
এছাড়া সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী, আখতারুজ্জামান চৌধুরীর অনুসারী ও আবদুচ ছালাম— এমন সব বলয়ের সঙ্গে নাছিরের দূরত্ব বাড়ে। মেয়র নির্বাচিত হয়ে নাছিরের দলের জ্যেষ্ঠ ও শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ানো ও তাদের প্রকাশ্যে অবমূল্যায়নের বিষয়গুলো ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ইতিবাচকভাবে নেয়নি।

চট্টগ্রামের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ সিটির মেয়রদেরও প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হলেও আ জ ম নাছিরের মুকুট ছিল শূন্য। মেয়াদের প্রায় পুরো পাঁচ বছরেই ‘অতিরিক্ত সচিব’ পদমর্যাদায় মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন নাছির উদ্দিন।

গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রামভিত্তিক উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর প্রায় সবই সিটি করপোরেশনকে না দিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়। ফলে নগরের জলজটসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতেও ব্যর্থ হন নাছির। নগরীর শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যর্থতার পাশাপাশি যথাযথ উন্নয়ন করতে না পারাই কাল হয় তার।

অন্যদিকে ২০১৫ সালে সাঈদ খোকন ডিএসসিসির মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পেছনে নিজের চেয়ে তার প্রয়াত বাবার অবদানই বেশি কাজ করেছে। তার বাবা ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ বড় রাজনীতিক ছিলেন।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময় নিজের জীবন বাজি রেখে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার জীবন রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাবার কারণে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও নিজের উন্নয়ন ঘটাতে পারেননি খোকন।

নিজে রাজনীতিক হিসেবে দলে প্রভাব ফেলতে পারেননি।

ঢাকার জনগণও তাকে ভালোভাবে নেয়নি। দুই বছর আগে ঢাকার আজিমপুরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক কর্মসূচি পণ্ড করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে। ওই কর্মসূচিতে অতিথি ছিলেন দলের কয়েক কেন্দ্রীয় নেতা।

তিনি মেয়র পদে নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর কেন আবার ঢাকা-১০ আসনের মনোনয়ন চাইলেন, তা বুঝতে পারছেন না আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই।
তাদের মতে, ব্যবসায়ী নেতা শফিউল ইসলাম মনোনয়ন চাওয়ার পর সাঈদ খোকনের বোঝা উচিত ছিল শফিউল নিশ্চয়ই কোনো ইঙ্গিত পেয়েই নেমেছেন।

কিন্তু তারপরও খোকন কেন, কার কথায় মনোনয়ন চেয়েছেন, তা তারা বুঝতে পারছেন না। মেয়র পদে দ্বিতীয়বারের মতো মনোনয়ন না পাওয়ার পর সাঈদ খোকনকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয়।

মনোনয়ন না পেলেও ডিএসসিসির নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ফজলে নূর তাপসের পক্ষে যেন মাঠে থাকেন, এমন ‘কৌশলের’ অংশ হিসেবে খোকনকে সদস্য করা হয় বলেও কেউ কেউ মনে করেন।

খোকনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ব্যর্থতার দায় ছিল। গত বছরের এপ্রিলে ঢাকায় শুরু হয় ডেঙ্গুর প্রকোপ। দক্ষিণ সিটি মশা নিধনে সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। দক্ষিণ সিটির ভেতরে দুর্নীতির অভিযোগও বিস্তর। খোকন-ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তিকে এখন দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) ডাকছে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে।

সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতায় সমালোচিত সাঈদ খোকন যে এবার আর আওয়ামী লীগের টিকিট পাচ্ছেন না, সে আভাস গত ২৬ ডিসেম্বরও পাওয়া গিয়েছিল।

গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ এবং দুদকের নজরদারি ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতিতে অনিয়মের অভিযোগও আলোচনায় আছে বেশ শক্তভাবে। দুই সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ বিবেচনায় নিয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

সোনালীনিউজ/এমটিআই