লাশ নিচ্ছে না স্বজনরা, অবহেলায় মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু

হারিয়ে গেছে মমত্ব

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ৩১, ২০২০, ০১:২২ পিএম
ফাইল ছবি

ঢাকা : প্রতিদিন চারদিকে ঘটে যাওয়া মর্মন্তুদ ঘটনাগুলো যেন চোখভেজা কাহিনী হয়ে গেঁথে যাচ্ছে হূদয়ে হূদয়ে। প্রাণঘাতী করোনার প্রভাবে মানুষের সহজাত করুণাও উঠে যাচ্ছে। আপনজনের জন্য যে মানুষ জীবনবাজি রেখে উপার্জন করে, সেই মানুষই এখন নিজে বাঁচার জন্য অসুস্থ প্রিয়জন বা তাদের লাশ থেকেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এতে করে ভেঙে পড়েছে মানুষের পারস্পরিক মমত্ববোধ আর চিরন্তন ভালোবাসার অমোঘ নিয়ম। আগত ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষায় সবকিছু থাকার পরও মানুষ এখন নিঃস্ব ও স্বার্থপর।

গত ৫ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানের বেশ কটি ঘটনা নাড়া দিয়েছে দেশবাসীকে। সেবাদানকারী ডাক্তার আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। বলেছেন স্বজনদের এমন অমানবিক আচরণ কখনো দেখিনি। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও পুলিশই এখন শেষ ভরসা। লাশের পাশে থাকছে তারাই, জানাজাও পড়াতে হয় তাদেরই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম বলেছেন, মানুষ নিজের জীবনের চেয়ে এখন আর কিছুই ভালোবাসে না। আগে নিজের জীবনের চেয়েও মূল্যায়ন করত মানবতা, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। তার মতে—এই ক্ষয় একদিনের নয় দীর্ঘ সময়ের। ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রকৃতিই এর নেপথ্যে বলে মনে করেন এই বিজ্ঞানী।

সোমবার (৩০ মার্চ) ভোর চারটার দিকে যশোর জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন (করোনা) ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা ১২ বছরের এক মেয়েশিশুর মৃত্যু হয়েছে। গত রোববার বিকেল ৫টার দিকে যশোর সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামের ঠিকানা দিয়ে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি মেয়েটিকে হাসপাতালে ভর্তি করে। মেয়েটির জ্বর, সর্দি, কাশি থাকায় তাকে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।

যশোরের সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন জানিয়েছেন, মেয়েটিকে যে লোকটি হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন তিনি তার নাম-ঠিকানা, মোবাইল নম্বর না দিয়ে পালিয়ে গেছেন। তবে মেয়েটির স্বজনদের খোঁজ করে লাশ হস্তান্তর করা হবে, আর না পাওয়া গেলে সরকারিভাবে তার দাফন সম্পন্ন করা হবে।

এর আগের দিন ২৯ মার্চের ঘটনা আরো মর্মান্তিক। হাসপাতালে ৭০ বছরের বৃদ্ধকে ফেলে পালিয়েছেন স্বজনরা। কিশোরগঞ্জ বাজিতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঘটে এই ঘটনা।

ওই কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডা. জালাল উদ্দিন আহমেদ জানান, বিপ্লব সাহা পরিচয়ে এক ব্যক্তি পাঁচ দিন আগে (২৪ মার্চ) মুমূর্ষু অবস্থায় বৃদ্ধকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসেন। এ অবস্থায় মুমূর্ষু ওই রোগীকে ২৫০ শয্যার কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তরের কথা বললেও তিনি রাজি না হয়ে রেজিষ্টারে অঙ্গীকারপত্র দেন, রোগী মারা গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।

তিনি রেজিষ্টারে ইংরেজিতে তার নামও বিপ্লব সাহা লিখেছেন এবং তার মোবাইল নম্বর লিখতে বললে তা না লিখেই সুযোগ বুঝে বৃদ্ধকে ফেলে পালিয়ে যান। সঙ্গে আসা লোকটি যে রোগীর নিকটাত্মীয় ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রেজিষ্টারে লিপিবদ্ধ নাম-ঠিকানা অনুযায়ী চিকিৎসাধীন ওই বৃদ্ধ উপজেলার সরারচর ইউনিয়নের কামালপুর গ্রামের মৃত পরশ চন্দ্র সাহার ছেলে প্রদীপ সাহা। বয়স দেওয়া হয় ৫৮ বছর।

কিন্তু প্রকৃত অর্থে তার বয়স ৭০ বছরের বেশি হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি থানা-পুলিশকে জানায়। এরপর রেজিষ্টারে লিপিবদ্ধ নাম-ঠিকানার সূত্র ধরে স্বজনদের খুঁজে বের করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে এই ঠিকানার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, ভুল ঠিকানা দিয়ে স্বজনরা পালিয়েছে।

২৬ মার্চের ঘটনা রাজধানীর মালিবাগের। মালিবাগের ৩৮-বি চৌধুরী পাড়ার বাসার দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে পড়ে আছে যুবকের লাশ। কিন্তু করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে কেউই লাশের কাছে যাচ্ছে না। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় পুলিশ।

স্থানীয়রা জানায়, নিহত ব্যক্তির নাম রাজু (৩৫)। তিনি ওই বাসায় ব্যাচেলর রুমে থাকতেন। ওই ব্যক্তি ব্যবসা করতেন। ব্যাচেলর রুমে তিনি ছাড়াও তার এক রুমমেট ছিল। সে গ্রামে চলে গেছে। এরপর রুমে রাজু একাই ছিলেন। ওই দিন দরজা না খোলায় বিকেলে দরজা ভেঙে তার লাশ দেখা যায়।

মৃতের ভাগনে ইমন বলেন, ‘মামা এখানে ব্যাচেলর থাকত। মারা যাওয়ার আগের রাতে বাসায় এসে মামিকে ফোন করে বলেছে, পেটে ব্যথা, বমি আসতেছে। পরে মামি বলল ঘুমানোর জন্য। সকাল থেকেই মামার মোবাইল নম্বরে কল দেওয়ার পর কল রিসিভ না করার আমরা বাসায় এসে দরজা ভেঙে লাশ দেখতে পাই। স্থানীয়রা বলছেন, করোনায় মৃত্যু। কিন্তু প্রাথমিকভাবে স্বাভাবিক মৃত্যুই মনে হচ্ছে।’

একই দিনে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এক যুবক (৪৫)। তার বাড়ি খুলনা নগরীর হেলাতলা এলাকায়। তার শরীরে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. এ টি এম মঞ্জুর মোর্শেদ। হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে ওই রোগী মারা যাবার পর তার স্বজনরা লাশটি রেখে পালিয়ে যান।

‘ভুল করে’ করোনা ইউনিটে রাখা মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু : শ্বাসকষ্ট ও হূদযন্ত্রের জটিলতা নিয়ে ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এক মুক্তিযোদ্ধা। পরে শহরে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য নির্ধারিত আইসোলেশন ইউনিটে তার মৃত্যু হয়। গত রোববার রাত ৩টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।

ওই হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রোববার রাত ২টা ১০ মিনিটে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬৫ বছর বয়সি এক মুক্তিযোদ্ধা। এরপর প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে করোনা ভাইরাসের আইসোলেশন ইউনিটে পাঠানো হয়। আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তির আধা ঘণ্টা পর তার মৃত্যু হয়।

সোমবার (৩০ মার্চ) বিকেল ৩টার দিকে ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. নাদিরুল আজিজ চপল গণমাধ্যমকে বলে, ‘ওই মৃত ব্যক্তি হূদযন্ত্রের ও শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা নিয়ে রাত ২টা ১০ মিনিটে ভর্তি হন। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে এককভাবে হাসপাতালের ওয়ার্ডে আইসোলেটেড করে রাখতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ভুলবশত তাকে করোনাভাইরাসের আইসোলেশনে ইউনিটে নেওয়া হয়।’

তবে তার আগে দুপুর আড়াইটার দিকে ঠাকুরগাঁও সিভিল সার্জন ডা. মাহফুজুর রহমান সরকার বলেন, ‘রাতে ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধ ব্যক্তি মারা যান। তার হূদযন্ত্রে সমস্যা ছিল। করোনা ভাইরাসের আইসোলেশন ইউনিটে তাকে নেওয়া হয়নি, হাসপাতালেই তার মৃত্যু হয়েছে।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই