সামনে আসছে আরও কঠিন সময়

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ২১, ২০২০, ০৮:০৯ এএম

ঢাকা : এপ্রিলের শুরু থেকেই ঢাকা শহরে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে শহরের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা। বিশেষ করে ৪ এপ্রিল থেকে প্রতিদিনই দ্বিগুণ হারে আক্রান্ত হতে থাকে মানুষ। প্রথম সপ্তাহ শেষে দেশের মোট রোগীর ৫৬ শতাংশই শনাক্ত করা হয় ঢাকা শহরে। এরপর গত দুই সপ্তাহেরও কম সময়ে ঢাকা শহর হয়ে পড়ে দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হটস্পট। গত রোববারও দেশের মোট রোগীর ৪০ শতাংশই ছিল ঢাকা শহরের।

অন্যদিকে গত ৫ এপ্রিল ঢাকা শহরসংলগ্ন জেলা নারায়ণগঞ্জে মোট রোগী ছিল মাত্র ১১ জন। তারপর থেকে প্রতিদিনই উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকে রোগী। গত দুই সপ্তাহে সেই রোগীর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৩৮৬ জনে। অর্থাৎ মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এ জেলায় রোগী বেড়েছে ৩৫ গুণ।

গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে এক দিনে সর্বোচ্চ যে ৪৯২ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে, তাদের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ঢাকা শহরে ও নারায়ণগঞ্জে। এমনকি এ সময় যে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে ৫ জন ঢাকার ও ৪ জন নারায়ণগঞ্জের।

এদিকে লকডাউনের মধ্যেও সামাজিক সংক্রমণের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। কিন্তু একই হারে পরীক্ষার মাধ্যমে আক্রান্তদের শনাক্ত করা হচ্ছে না। এমনকি যে ১৯টি ল্যাবে পরীক্ষা হচ্ছে, সেগুলোর সর্বোচ্চ সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা।

দেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে ৮০ জনের কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। এটা সর্বনিম্ন। আর সর্বোচ্চ ইতালিতে, তারা প্রতি ১০ লাখে ১৭ হাজার ৭৫৮ জনের পরীক্ষা করছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে কম এর কারণ পরীক্ষা এবং নমুনা সংগ্রহ পদ্ধতিতে দুর্বলতা আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মত, দুর্বলতাগুলো দ্রুত দূর করে পরীক্ষা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। যত দ্রুত সম্ভব পরীক্ষা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে শনাক্ত রোগীদের কন্ট্রাক ট্রেসিং (আন্তঃসংযোগ চিহ্নিত করা) করে তাদের পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। আরটি পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষার পাশাপাশি এখন র‌্যাপিড টেস্টের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ নমুনা সংগ্রহে দক্ষ, প্রশিক্ষিত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিতে হবে।

এ ছাড়া লকডাউন শতভাগ কার্যকর করতে হবে। তা না হলে, ঢিলেঢালা লকডাউন করে, অল্প বিস্তর পরীক্ষার মাধ্যমে করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ পাওয়া সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সি বলেন, পরীক্ষা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। সরকারের পক্ষ থেকে সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। তাবে শুধু একটা পদ্ধতির ওপর নির্ভর না করে পরীক্ষার পদ্ধতি বাড়াতে হবে।

এ ক্ষেত্রে সেরোলজিক্যাল টেস্টের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, এন্টিবডি ও এন্টিজেন পদ্ধতিতে দ্রুত সময়ে বিপুল পরীক্ষা করা সম্ভব। আমেরিকা ও কোরিয়াতে এ ধরনের পরীক্ষা হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে ইতোমধ্যে এ ধরনের ৪৫ লাখ রেপিড টেস্ট কিট কেনা হয়েছে। এসব বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলে সমস্যা বাড়বে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে ৮০ জনের কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। মোট জনসংখ্যার অনুপাতে যা একেবারেই কম। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন। বেশি শনাক্ত হয়েছে বিশ্বের এমন দেশগুলোতে পরীক্ষার হার প্রতি ১০ লাখে ১৫ হাজারের বেশি।

রোববার (১৯ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওয়ার্ল্ডওমিটারসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে ৮০ জনের করোনার পরীক্ষা করা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা হচ্ছে মালদ্বীপে। দেশটিতে প্রতি ১০ লাখে পাঁচ হাজার ৩৬৩ জনের পরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৭ মার্চ। এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগী ২১ জন। ভুটানে প্রতি ১০ লাখে এক হাজার ৫১১, পাকিস্তানে ৩৩২, শ্রীলঙ্কায় ২২৩, নেপালে ২১৬ এবং ভারতে ১৭৭ জনের পরীক্ষা করা হচ্ছে। ইতালিতে প্রতি ১০ লাখে ১৭ হাজার ৭৫৮, জার্মানিতে ১৫ হাজার ৭৩০, স্পেনে ১২ হাজার ৮৩৩, যুক্তরাষ্ট্রে ৯ হাজার ৩৬৭ এবং দক্ষিণ কোরিয়াতে ১০ হাজার ৪২৬ জনের করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করা হচ্ছে। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় রোগী শনাক্তের প্রথম থেকে পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে। সংক্রমণের বিস্তারও তারা অনেকটা সামলে নিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়াদী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, আমাদের যে হারে পরীক্ষা হচ্ছে সেটা বাড়ানো দরকার। এ ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহে গলদ রয়েছে। নমুনা সংগ্রহের পদ্ধতি পরিবর্তন করে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। পরীক্ষা বাড়াতে হলে কন্ট্রাক ট্রেসিং করতে হবে। ইতোমধ্যে শনাক্ত রোগীদের সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদের সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। দ্রুত সব রোগী চিহ্নত করে তাদের আইসোলুট (সঙ্গ নিরোধ) করতে হবে।

জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানীতে ১০টি বিভাগে ৯টিসহ মোট ১৯টি ল্যাবে করোনা পরীক্ষা চলছে। এসব ল্যাবে প্রায় ৩০টির মতো পিসিআর মেশিন রয়েছে। এই মেশিনগুলো দিনে দুই শিফট ব্যবহার করলে দৈনিক সাড়ে পাঁচ হাজার পরীক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু পরিকল্পনা, নমুনা সংগ্রহ এবং ল্যাব বিশেষজ্ঞের ঘাটতির কারণে সেটি করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়লেও এগুলোর পুরো সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাঠপর্যায়ে যারা নমুনা সংগ্রহ করছেন, তারা যথেষ্ট প্রশিক্ষিত নন। ফলে পর্যাপ্ত নমুনা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে সঠিক প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ না করায় নমুনা নষ্টও হয়ে যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী সোমবার পর্যন্ত দেশে মোট রোগী শনাক্ত হয়েছে দুই হাজার ৯৪৮ জন। প্রথম রোগী শনাক্তের পর এ পর্যন্ত এই সংক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ১০১ জনের। আক্রান্তদের মধ্যে এ পর্যন্ত মোট ৮৫ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।

সূত্র জানায়, বর্তমানে যে পদ্ধতি (পিসিআর) ব্যবহার করে শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে, তা বেশ জটিল। এই পরীক্ষা করার মতো দক্ষ টেকনিশিয়ানেরও সংকট রয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে অনেকে নমুনা দিতে চাচ্ছেন না, পরীক্ষা কম হওয়ার এটা বড় কারণ।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সংস্থাটি প্রকাশিত সর্বশেষ করোনাভাইরাস প্রতিরোধবিষয়ক কৌশলপত্রে বলেছে, এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো টিকা বা সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত রোগী শনাক্ত করা এবং তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা গেলে এ ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। তাই সাধারণ জনগণের মধ্যে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করতে দেশগুলোকে সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা শুরু করে। শুরুতে বিদেশফেরত এবং তাদের সংস্পর্শে না এলে পরীক্ষা করা হয়নি। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হন। ৩০ মার্চ থেকে পরীক্ষা কেন্দ্রের আওতা বাড়ানো শুরু হয়।

সামগ্রিক বিষয়ে অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, পরীক্ষা আরও বাড়বে, আমরা সেই চেষ্টা করছি। অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে ২০টি ল্যাবে পরীক্ষা চালু হয়েছে। আরও ৮টি ল্যাব প্রস্তুত করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ২৮টি ল্যাব নিয়মিত করোনা পরীক্ষা করা হবে।

এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরও ৩০টি ল্যাবের তালিকা করা হয়েছে। এগুলো ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে আরও বেশি পরীক্ষা করতে উপজেলা পর্যায়ে নমুনা সংগ্রহের উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে ল্যাব পরিচালনায় দেশে বিশেষজ্ঞের ঘাটতি রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই