ঘুরে দাঁড়াবে দেশের অর্থনীতি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২১, ১২:৫২ পিএম

ঢাকা : করোনা মহামারীর বিরূপ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটিয়ে দেশের অর্থনীতি আবারও ঘুরে দাঁড়াবে। এমনটাই আভাস দিয়েছে জাতিসংঘের ডেভেলপমেন্ট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স (ডিইএসএ) প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক সিচুয়েশন অ্যান্ড প্রসপেক্ট’ প্রতিবেদন।

এতে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে জিডিপি সম্প্রসারণ হবে ৫ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছবে।

প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, করোনা মহামারীর ভীতিকর প্রভাব কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি পরবর্তী অর্থবছরে (২০২১-২২) উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসবে।

যদিও বাংলাদেশ সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ হলেও জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ দেখানো হয়েছে।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক পূর্বাভাস এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ’র পূর্বাভাস সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও ব্যতিক্রম ঘটেছে বিশ্বব্যাংকের হিসেবের সাথে। অর্থাৎ জাতিসংঘের পূর্বাভাস বিশ্বব্যাংকের তুলনায় বেশি।

বিশ্বব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরের বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্প্রসারিত হবে ১ দশমিক ৬ শতাংশ, যা পরবর্তী অর্থবছর অর্থাৎ ২০২২ সালে ৩ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হবে।

অন্যদিকে আইএমএফ’র হিসাব বলছে, ২০২২ সাল নাগাদ জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। যদিও অর্থনৈতিক এই প্রবৃদ্ধির সফলতার অনেকটাই নির্ভর করবে টিকাদান কর্মসূচির ওপর।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, করোনা মহামারীর কারণে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরেছিল বিশ্বকে। এতে বাণিজ্য ও পর্যটন থমকে যাওয়ার পাশাপাশি চাকরি হারানো এবং উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো। এ কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি সংকোচন হয় ৪ দশমিক ৩ শতাংশ পর্যন্ত। ১৯৩০ এর দশকে মহামন্দার পর আর কখনো এতটা সংকোচন হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মে নিয়োজিত এবং করোনা এসব মানুষ সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে।

অর্থাৎ মহামারীর প্রভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকরা বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার নীতিনির্ধারকদের শ্রমবাজারকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি করে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে । তবে এই লক্ষ্য অর্জনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় কিছুটা ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে।

এ ছাড়া বাণিজ্য, রেমিট্যান্স এবং বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনার কথা বলাও হয়েছে প্রতিবেদনে। দক্ষিণ এশিয়ায় মালদ্বীপ, নেপাল এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা বেশ গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার ওপরে। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে পাকিস্তান এবং ইরান।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, পুঁজিবাজারের ঊর্ধ্বমুখী ধারা, আমদানি বাণিজ্য সচল হওয়া। এছাড়া কম মুনাফা সত্ত্বেও মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকে জমানো আমানত বাড়ছে। আর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের মাধ্যমেও ভালো মুনাফা পাওয়া এবং কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স বৃদ্ধি পেয়েছে।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি প্রকাশিত ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স-২০২০ অনুযায়ী ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বিগত বছরের তুলনায় দুই ধাপ এগিয়ে ১৩৩তম। যদিও করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর, যা থেকে এখনো উত্তরণ ঘটেনি। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক খাত এখনো ইতিবাচক ধারায় ফিরতে পারেনি।

যার মধ্যে অন্যতম নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া, মানুষের আয় কমে যাওয়া, বেকারত্ব বৃদ্ধি, নিম্নমুখী রপ্তানি আয়, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, বিভিন্ন শিল্পের জন্য মেশিনারিজ এলসি না হওয়া এবং খেলাপি ঋণ ও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি।

তবে এসবের পরও সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি সঠিক পথেই রয়েছে বলে মনে করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

দেশের শিগগিরই দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের অগ্রগতি থেকে নির্দ্বিধায় বলা যায় আমরা সঠিক পথে রয়েছি।’

গত ২০ জানুয়ারি (বুধবার) জাতীয় সংসদে চলমান শীতকালীন অধিবেশনে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও আয়-ব্যয়ের গতিধারা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন তিনি।

প্রতিবেদনে তিনি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক পর্যন্ত বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও আয় ব্যায়ের গতিধারা, সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ, রাজস্ব পরিস্থিতি, বাজেট ভারসাম্য ও অর্থায়ন, মুদ্রা ও ঋণ পরিস্থিতি, বৈদেশিক খাত, মূল্যস্ফীতির অবস্থা তুলে ধরেন।

এ সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘করোনা মহামারী সত্ত্বেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমরা ৫.২৪ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছি। বাস্তবমুখী ও পর্যাপ্ত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার বর্তমান অর্থবছরে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিসঞ্চার, কর্মসৃজন ও কর্ম সুরক্ষা, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে পেরেছে।’

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সরকারের সাফল্য আরো বেশি হতে পারত যদি প্রণোদনার অর্থ বণ্টনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি না হতো, ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মালিকদের প্রণোদনা যথার্থ পরিমাণে দেওয়া হতো এবং গার্মেন্ট শিল্পে যে প্রণোদনা হয়েছে সেগুলো বিনিয়োগ হতো। এসব না হওয়ায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব দূরীকরণে ভূমিকা রাখতে পারেনি।

অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, ‘করোনার মাঝেও কৃষিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনে, রেমিট্যান্স আহরণ এবং পোশাক শিল্পের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সাফল্য রয়েছে।’ কিন্তু যেসব সাফল্য অর্জিত হয়েছে সেসব কতদিন নাগাদ স্থায়ী হবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, ‘নেতিবাচক এবং ইতিবাচক দুই ধারাতেই রয়েছে অর্থনীতি। তবে যতটুকু ইতিবাচক আছে তা কতটুকু টেকসই সেটিই নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।’

এছাড়া ইনভেস্টমেন্ট, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, চিকিৎসা, সুশাসনের ক্ষেত্রে নিদারুণ ব্যর্থতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ব্যর্থতার ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করতে না করলে যতটুকু সাফল্য তাও টিকবে না।’

তার মতে, ‘এসএমই খাতে যথামাত্রায় লোন দেওয়া হয়নি। এর ফলে ছোট ও মাঝারি শিল্প পুঁজির অভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এটি আর্থিক খাতের অদক্ষতা। গার্মেন্ট সেক্টরে যেসব লোন দেওয়া হয়েছে সেগুলো বিনিয়োগে রূপান্তর হয়নি। সরকারের জরুরি প্রণোদনা সহয়তার ক্ষেত্রে পূর্ব প্রস্তুতি না থাকা এবং দুর্নীতির কারণে প্রণোদনা সবার কাছে যথাযথভাবে পৌঁছায়নি।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির যেসব সূচক ভালো অবস্থায় নেই, সেগুলোর মধ্যে বিনিয়োগ অন্যতম। তবে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হলে একসঙ্গে সবকটি সূচকই ঘুরে দাঁড়াবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, বর্তমান যে পরিস্থিতি চলছে আগামী মার্চ পর্যন্ত তা এভাবেই যাবে।

এরপর আগামী জুলাই-আগস্টের পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলো থেকে কেনাকাটা, ভ্রমণ, ভোগ ব্যয় বাড়তে থাকবে। তখন আমাদের রপ্তানি ও শ্রম বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই