করোনায় আতঙ্কিত নয় বস্তিবাসী

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ১৮, ২০২১, ০৫:৪০ পিএম

ঢাকা : দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতে বস্তিগুলোতে ব্যাপকহারে ছড়িছে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হলেও বাস্তবে এখন পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি। এতে বিস্মিত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে ভিন্ন মত দিলেও সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি নজরে আছে জানিয়ে আইইডিসিআর বলছে, এনিয়ে গবেষণা চলছে।

করোনা সংক্রমণরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার এবং ঘনঘন হাত ধোয়ার কথা বলা হলেও এর কোনোটিই অনুসরণ করেন না বস্তিবাসী। যাদের সবারই বসবাস বস্তির মত ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে। ঘিঞ্জি ঘরে একসাথে অনেকে একই রান্নাঘর আর টয়লেট ব্যবহার করেন তারা। কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের কোনো সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)’র ২০১৪ সালে বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোকগণনা জরিপ অনুযায়ী রাজধানীতে মোট বস্তির সংখ্যা ৩ হাজার ৩৯৪টি। এসব বস্তির মোট জনসংখ্যা ৬ লাখ ৪৬ হাজার ৫৬ জন। বিপুল সংখ্যক এসব মানুষদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ হলে তা ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়তো। ঘটতো মৃত্যুর ঘটনাও। কিন্তু গত এক বছরে তেমন কিছুই ঘটেনি।

গত বছর রাজধানীর যে কয়টি এলাকায় করোনার সক্রমণ সবচে বেশি হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল মিরপুর এলাকা। এই এলাকাতেই রয়েছে চলন্তিকা, ভাষানটেক ও বাউনিয়া বাঁধের মতো বড় বস্তি। একইভাবে মহাখালিও উচ্চ সংক্রমিত এলাকা হলেও সেখানকার কড়াইল বস্তিতেও করোনা সক্রমণের কোনো ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়নি তখন। 

মিরপুর ৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার কাশেম মোল্লা বলেন, গত বছর তার ওয়ার্ডে অবস্থিত বস্তিগুলোতে করোনা সংক্রমণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এবারো এখন পর্যন্ত কেউ আক্রান্ত হয়নি। 

মিরপুর গুদারাঘাটে চিড়িয়াখানা সংলগ্ন নিউ সি ব্লকের বস্তির বাসিন্দা রাহেলা বলেন, তাদের বস্তিতে একরুমে ৪/৫ জন কোনো কোনো রুমে ৭/৮ জনও থাকে। কিন্তুু কারোই করোনা হয়নি। 

‘করোনা গরিবের না ধনী মানুষের রোগ’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। বস্তিবাসীদের মতে, গরিব মানুষের যেখানে দুই বেলা খাবার যোগাতেই হিমশিম খেতে হয় সেখানে সামান্য জ্বর, সর্দি, কাশির ওষুধ যোগাড় করাটা বিলাসিতা মাত্র। তাছাড়া এসব রোগের পরীক্ষা কোথায় করা হয় তাও জানা নেই তাদের।

ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা কম থাকলেও করোনা সংক্রমিত হলে সেখানে অবশ্যই মৃত্যুর ঘটনাও বেশি ঘটতো। কিন্তু তেমনটি যেহেতু হচ্ছে না তাই ধারণা করা হচ্ছে ওইসব স্থানে বসবাসকারীদের মধ্যে এই রোগটি যে কোনো কারণেই হোক না কেন সংক্রমিত করতে পারছে না। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কোভিড-১৯ বিষয়ক কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, অন্যান্য জায়গার মতো বস্তিতেও যদি করোনার প্রকোপ হতো তাহলে সেখানে অনেক মৃত্যুও ঘটনা ঘটতো। কারণ এমনিতেই বস্তিগুলো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতাও তাদের কম। এমনো হতে পারে তাদের মধ্যে হয়তো করোনার এন্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। কিংবা অন্য কিছু। তবে যাই হোক না কেন এ সম্পর্কে গবেষণা করা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

দেশে শ্রেণিভিত্তিক করোনা সংক্রমণের পরিসংখ্যান না থাকলেও বস্তিবাসীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের কম হারের বিষয়টি নজরে এসছে রোগতত্ত্ব রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটেরও (আইইডিসিআর)। বিষয়টি নিয়ে তারা সমীক্ষা চালাচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে আইইডিসিআর পরিচালক মীরাজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা গনমাধ্যমকে বলেন, আমরা রাজধানীর বস্তিবাসীদের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছি। বিভিন্ন বস্তি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করছি। সেখানে সংক্রমণের হার বেশি দেখছি না। তিনি বলেন করোনার যে বৈশিষ্ট্য, এতে ঘনবসতিতে বসবাসকারী মানুষগুলো হয়তো অগোচরেই আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।

এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বস্তি এলাকার যুবক-তরুণদের সংখ্যা বেশি। সেখানে বৃদ্ধদের অধিকাংশই গ্রামে থাকে। যার কারণে তারা আক্রান্ত হলেও তা তুলনামূলকভাবে কম হচ্ছে। মৃদু লক্ষণে তারা গা করে না, পাত্তাও দেয় না। যেহেতু সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ বয়স কম তাই আক্রান্ত হলেও নিজেদের অজান্তেই তারা সেরে উঠছেন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, বস্তির মানুষ আক্রান্ত হলেও হয়তো শনাক্ত হচ্ছেন না। করোনাতে যারা আক্রান্ত হন তাদের মধ্যে শতকরা ৮০ শতাংশেরই লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে না। আবার যারা কর্মঠ তারা হালকা সর্দি কাশি হলে বলেনও না। সচেতনতার অভাবে সেটা আমলে নেন না। তাই আক্রান্ত কম এটা বলতে আমাদের স্টাডি করা লাগবে।

তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে কঠোর পরিশ্রম. খাদ্যাভাস, জীবনাচারণ প্রভৃতি বিষয় নানাভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে শ্রমজীবী মানুষদের ওপর। এই সবকিছুই তাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। তাই স্বাস্থ্যবিধি পালন না করেও হয়তো তারা সংক্রমিত হচ্ছেন না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, যারা মাটির সঙ্গে সংযুক্ত থেকে খোলামেলা রোদে বা বাতাসে কাজ করেন, শারীরিক শ্রম বেশি দেন তাদের মধ্যে করোনা আক্রান্তের প্রকোপ কম। 

এর নির্ণায়কগুলো হলো, শারীরিক শ্রম, রোদে কাজ করা, খোলা বাতাস এগুলো দিয়ে শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। একইসঙ্গে এরা ফ্রিজে রাখা বা সংরক্ষিত খাবার কম খান। এই নির্ণায়কগুলো আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। 

দ্বিতীয়ত, যারা শীতাতপ জায়গায় বেশি থাকেন এবং যারা খোলা রোদে একেবারেই কম যান, খালি পায়ে কম হাঁটেন, সংরক্ষিত খাবার বেশি খান এবং কৃত্রিম আলোতে দিনের বেশিরভাগ সময় থাকেন, তাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে তাদের কোভিড-১৯ বেশি আক্রমণ করছে। এটা শুধু কোভিড-১৯ এর জন্য না, সব ভাইরাসের জন্যই প্রযোজ্য বলে জানান তিনি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই