ব্যাহত হচ্ছে অগ্রযাত্রা

দক্ষ মানবসম্পদের অভাব

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২১, ০২:১৪ পিএম

ঢাকা : প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা। অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়ন। ফলে সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের এবং স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পথে এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অনেকেই।

তাদের মতে, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি করা না গেলে দেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হতে পারে। দক্ষ লোকের অভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কার্যক্রমে এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে দুর্নীতিরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ঢাকা ওয়াসা। সরকার এই সংস্থাটিকে বিভিন্ন সময় উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ঋণ দিয়ে থাকে।

জানা গেছে, সংস্থাটির কাছে এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা পাওনা সরকার। বিপুল পরিমাণ এই ঋণের টাকা এরই মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলেও তা আদায় করা যায়নি। অর্থাৎ এই অর্থ আদায় অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

ঢাকা ওয়াসার মতো এমন শতাধিক প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারের মেয়াদোত্তীর্ণ ‘ডেট সার্ভিস লায়াবিলিটি’ বা ডিএসএলের পরিমাণ (সুদ ও আসল মিলে) প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। আর মেয়াদ অনুত্তীর্ণ ঋণ ধরলে এর পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা, যা দিয়ে দেশের অনেক বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব।

কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও সংস্থাগুলো সরকারের এই দেনা পরিশোধ করছে না।

অথচ শর্ত অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের সময়মতো ঋণ পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যদিও অর্থ আদায় না করার জন্য অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিকেই দায়ী করা হয়।

বিশ্লেষকদের মতে, দুর্নীতির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিজ আহমেদ চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ ফেরত দিচ্ছে না তার একটি বড় কারণ অদক্ষতা ও দুর্নীতি।’

বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোঁজামিলের মাধ্যমে দিনের পর দিন সরকারের কর ফাঁকি, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা কিংবা নানাভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নিলেও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার অভাবে এসব প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. মিজানুর রহমানের মতে, দেশে এসএমই খাতের প্রায় এক লাখ প্রতিষ্ঠানের  বেশিরভাগই মুনাফা অর্জন করলেও তাদের আর্থিক হিসাব সঠিকভাবে হয় না। একই সঙ্গে তারা অদক্ষ জনবলের ওপর নির্ভরশীল। যে কারণে এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক ব্যয় হয়। তাই ডিএসই ও এসএমই ফাউন্ডেশনকে  সেসব প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিএসইসি পুঁজিবাজারের কোম্পানিগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন পরিপালনে জোরদার করে। যাতে করে উদ্যোক্তাদেরকে দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক হিসাব মান অনুযায়ি আর্থিক হিসাব তৈরী ও উপস্থাপন করতে হয়।’

সম্প্রতি ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ : অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অগ্রযাত্রা’ শীর্ষক এক ওয়েবইনারে বক্তারা বলেন, দেশের মানবসম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা গ্রহণের জন্য সবাইকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

তাদের মতে, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মানবসম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা উন্নয়ন জরুরি।

বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু নানামুখি শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিকীকরণের দিকে ঝুঁকে পড়ায় সেই লক্ষ্য ব্যহত হচ্ছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খানের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ হলো-

১. শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের বিস্তার ও তাতে তাদের অভ্যস্ত করে তোলা এবং

২. দক্ষ জনশক্তি তৈরি। কিন্তু এর কোনোটাই যথাযথভাবে না করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিকীকরণের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়তে দেখছি। নানামুখী শিক্ষাব্যবস্থা উল্টো সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করছে।’

তার মতে, ভঙ্গুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রশাসন দিয়ে এসডিজিতে যে মানসম্মত মানসম্মত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে তা অর্জন করা সম্ভব না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের(টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক এই চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতি দমনের জন্য যেসব ‘ইনস্টিটিউশনাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ দরকার তার সবই আমাদের আছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতার অভাব রয়েছে।

আমাদের ইনস্টিটিউশনাল অ্যারেঞ্জমেন্টের মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন, অডিটর জেনারেল অফিস, বিচারালয়, পুলিশ ও পার্লামেন্টারি কমিটি। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান নিজেরা কতটুকু শক্তিশালী, সে বিবেচনা আমরা করি না।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই