বর্ধিত ওষুধের দামে বিপাকে মানুষ

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২, ১২:৩৩ পিএম

ঢাকা : মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের দাম বাড়ায় কষ্টে আছে মানুষ। এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের বাজারে আগুন। এর মধ্যে একমাস আগে বহুল ব্যবহৃত ৫৩টি ওষুধের দাম প্রায় শতভাগ বেড়েছে। 

আবারো বেশকিছু ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জমা পড়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে। এভাবে ওষুধের দাম বাড়ায় রোগীর চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর অসহায়। ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে দেশে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। কার্যত প্রায় গোটা ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে ওষুধ শিল্প মালিক সমিতি। 

ফলে কোম্পানিগুলোর উচ্চাভিলাষী বিপণন নীতি ও অধিক মুনাফা করার প্রবণতায় মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। আর কোম্পানিগুলোর অতি মুনাফা প্রবণতার বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। 

সরকারের আইনের দুর্বলতার কারণেই ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। জনগণের চিকিৎসা ব্যয় কমাতে ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তদারকি বাড়ানোর বিকল্প নেই। এজন্য আইন সংশোধন করা প্রয়োজন। 

তবে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণ প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়, ডলারের বিনিময় মূল্য, মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা কারণেই ওষুধ উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। এসব কারণে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে।

সর্বশেষ গত ৩০ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ওষুধের মূল্য নির্ধারণ কমিটির ৫৮তম সভায় অর্ধশতাধিক ওষুধের পুনর্নির্ধরিত দাম অনুমোদন করা হয়। 

অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের করা প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০টি জেনেরিকের ৫৩ ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছে সরকার, যা ওই দিন থেকেই কার্যকর হয়েছে। 

এর আগে ২০১৫ সালে কয়েকটি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছিল। প্রায় সাত বছর পর আবারো বাড়ানো হয় অতিপ্রয়োজনীয় ৫৩ ব্রান্ডের ওষুধের দাম। 

সম্প্রতি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো আরো বেশকিছু ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে জমা দিয়েছে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে বর্ধিত মূল্যের ওষুধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিক ও উচ্চরক্তচাপ বা প্রেসারের ওষুধের দাম। রাজধানীর শাহবাগ মোড়ের এক ওষুধ দোকানি জানান, দু’মাস আগেও নাকের ড্রপ এন্টাজলের দাম ছিল ১৩৮ টাকা। এখন সেটি ২৪০টাকা। শিশুদের যে নাপা সিরাপ ছিল ২০ টাকা। এখন সেটি ৩৮টাকা। এন্টোবায়োটিক ক্যাপসুল জাই ম্যাক্সের দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ। ৩০ টাকার প্রতি ক্যাপসুলের দাম হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫। এভাবে দাম বেড়েছে এমন প্রায় ৫৩ রকমের জরুরি ওষুধের। অতি প্রয়োজনীয় এসব ওষুধের দাম গত দেড় মাসে শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ বেড়েছে।

প্যারাসিটামল, সেই সাথে রক্তাচাপ, হূদরোগ, ব্যাথানাশক ও পেটে গ্যাসের সমস্যার নিয়মিত ওষুধগুলোর দাম ৫০ থেকে ১৩৪ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ কিছু ওষুধের দাম দ্বিগুণ ছাড়িয়েছে। 

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে নাজিয়া মডেল ফার্মেসির কর্মীরা জানান, গেলো এপ্রিল থেকে প্রতি মাসেই বেড়েছে ওষুধের দাম। প্রায় সব কোম্পানিই দাম বাড়িয়েছে।

এদেশে এখনো মানুষের চিকিৎসা বাবদ মোট খরচের বড় অংশই ওষুধের পেছনে ব্যয় হয়, সেখানে ওষুধ ভেদে বড় ব্যবধানে দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্যমতে, বাংলাদেশে একজন মানুষের মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ওষুধ বাবদ খরচ হয় এবং এই খরচ করতে রোগীর পকেট থেকেই। অর্থাৎ দেশের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে গিয়ে ওষুধেই মানুষের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রায় দেড় হাজার জেনেরিকের (শ্রেণিগত বা জাতীয়) ২৭ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ তৈরি হয়। এগুলোর মধ্যে কেবল ১১৭টি ওষুধের মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর বাইরে যে ওষুধ রয়েছে, সেগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে ওষুধ কোম্পানিগুলো।

ওষুধ শিল্প সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল মুক্তাদির বলেন, গত মাসে ওষুধের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছিল ৮০ টাকা ডলারে। শিপমেন্ট পৌঁছানোর পর ডলারের দাম উঠেছে ১১০ টাকায়। প্রতি ডলারে ৩০ টাকা করে বেশি দিতে হয়েছে। এছাড়া মোড়ক, পরিবহন, বিপণন ব্যয় বাড়ার প্রভাবও ওষুধের বাজারে দেখা যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক নাহিদ আক্তার জাহান বলেন, জীবনরক্ষাকারী ওষুধগুলোর দাম প্রাইভেট মার্কেটের ওপর ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এই দামের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। কারণ দেশে যেখানে স্বাস্থ্যবীমা খুবই সীমিত সেখানে ওষুধে এই বাড়তি দাম রোগীর ওপরে চাপ আরো বাড়াবে। এক্ষেত্রে সরকারের নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। তা নাহলে দেশের চিকিৎসা খাত নিম্নবিত্ত মানুষের আওতার বাইরে চলে যাবে এবং যার সার্বিক প্রভাব জনস্বাস্থ্যের ওপর পড়বে। 

এজন্য সরকার অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে, যেন এর বেশি দামে কেউ বিক্রি করতে না পারে। অথবা সরকার নিজেই উৎপাদন করে অল্প দামে ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করতে পারে।

নিয়ম মেনেই ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর বা (ডিজিডিএ)।

ডিজিডিএর মুখপাত্র আইয়ুব হোসেন বলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ১১৭টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে সরকার। ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহূত কাঁচামাল, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়সহ নানা কারণে ওষুধের খরচ বেড়েছে। এসব কারণে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। ওষুধের দাম আচমকা বাড়ানো হয়েছে বিষয়টা এমন নয়। প্রাইজ পলিসি অনুযায়ী অনেকদিন ধরে দাম আপডেট করা হয়নি। 

ওষুধ কোম্পানিগুলোর দাম বাড়ানোর আবেদন ছিল, বাজারে কিছু পণ্যের অ্যাভেইলেবিলিটি (প্রাপ্যতা) কম ছিল তাই এগুলো অ্যাভেইলেবল করতে দাম আপডেট করা ছাড়া উপায় নেই। সবকিছু পর্যালোচনা করেই ওষুধ প্রশাসনের দাম নিয়ন্ত্রণ কমিটির পরামর্শক্রমে সরকার এ ওষুধগুলোর দাম আপডেট করেছে। আরো কিছু ওষুদের দামবৃদ্ধির আবেদন আছে। 

সেগুলো যাচাই বাছাই করে, যৌক্তিক মনে হলেই দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই