প্রসূতি মায়েদের নিয়ে মেধাবীদের বাণিজ্য

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ১৫, ২০১৭, ০৫:৫৫ পিএম

ঢাকা: মানবিকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ও এখন এসেছে ব্যবসার আওতায়। খাদ্য, পানীয়, স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এই অনৈতিক বাণিজ্য মানুষের মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা হচ্ছে এখন প্রসূতি মায়েদের নিয়ে। তাও এ ব্যবসায় জড়িয়ে আছেন দেশের মেধাবীরা। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই প্রবণতা মারাত্মক আকার ধারন করেছে। 

বিশেষ করে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে যেনতেন ভাবে অর্থ আদায় করাই চিকিৎসকদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব মেধাবী চিকিৎসকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছেন মায়েরা। যে কারণে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সিজার পদ্ধতিতে সন্তান প্রসব করার হার। আর এই ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালের চাইতে প্রাইভেট হাসপাতালগুলো এগিয়ে আছে বেশি।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে যে সংখ্যক নবজাতকের জন্ম হচ্ছে এর ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই অপ্রয়োজনীয়। প্রতি একশ’ নবজাতকের মধ্যে ২৩ জনেরই জন্ম হচ্ছে সিজারের মাধ্যমে। অথচ সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম হওয়ার পর মা ও সন্তান দু’জনই যে দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে- সেই বিষয়টি জানানো হচ্ছে না। অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য এক শ্রেণির চিকিৎসক অপ্রয়োজনে সন্তানসম্ভবা মায়েদের সিজারিয়ান পদ্ধতিতে ডেলিভারি করাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান ডা. ফেরদৌসী ইসলাম বলেন, সিজার এখন স্বাভাবিক ঘটনায় দাঁড়িয়ে গেছে। দিন যত এগুচ্ছে এর প্রবণতাও বাড়ছে। যা মোটেই সুখকর সংবাদ নয়। এরজন্য শুধু এক শ্রেণির অসাধু চিকিৎসক-হাসপাতালকে দায়ী করলে সমস্যার সমাধান হবে না। 

ডা. ফেরদৌস নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বিষয় তুলে ধরে বলেন, ইদানীং শহরকেন্দ্রিক সিংহভাগ মা ও তার পরিবার সিজার নামক শর্টকাট পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দিতে চান। তারা স্বাভাবিক প্রসবের জন্য ২/৩ দিন অপেক্ষা এবং প্রসবের ব্যথা সহ্য করতে চান না। এটাই হলো বর্তমান সময়ের নির্মম বাস্তবতা।

সরকারের ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর দেশের প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সন্তান প্রসবের জন্য ভর্তি হয়েছিল এক লাখ ৬৬ হাজার ৭২১ জন প্রসূতি। তাদের মধ্যে এক লাখ ১৭ হাজার ১৬৪ জনের সিজার করে সন্তান হয়েছে। আর মাত্র ৪৭ হাজার ৮৬৮ জনের হয়েছে নরমাল ডেলিভারি। অর্থাৎ তখন সিজারিয়ানের হার ৭০ শতাংশ থাকলেও চলতি ২০১৫ সালে এ হার প্রায় ৮০ শতাংশে উঠে গেছে বলে জানিয়েছে প্রসূতিসেবা

বিশেষজ্ঞরা। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রকৃতপক্ষে ১০০ সিজারিয়ান প্রসূতির মধ্যে ১৫ থেকে ২০ ভাগেরও সিজারের দরকার ছিল না। ৮০ ভাগেরই নরমাল ডেলিভারি করা যেত। কিন্তু একটি মহলের প্রচারণার কারণে ক্ষতিকর এ পথটিই অনুসরণ করা হয়েছে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস)-২০১৪-এর তথ্যানুযায়ী, দেশে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ১০টির মধ্যে ৬টি শিশুরই জন্ম হচ্ছে সিজারিয়ান পদ্ধতিতে। এক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে। সমাজে সবচেয়ে শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের ৫০ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান এবং সচ্ছল পরিবারে এই হার অনেক বেশি। ২০০৪ সালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হতো ৪ শতাংশ শিশুর। ২০০৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ শতাংশে। ২০১১ সালে তা ছিল ১৭ শতাংশ। আর ২০১৪ সালে তা দেড়গুণের বেশি বেড়ে হয়েছে ২৩ শতাংশ। বর্তমানে ২০১৪ সালের দ্বিগুন হয়েছে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।

জাহিদ-আনিকা দম্পতি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিজারিয়ান সেকশন এখন দেশের বেশিরভাগ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের জন্য বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ প্রবণতা রোধ তো করা যাচ্ছেই না, বরং দিন দিন প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এই ক্ষেত্রে প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসকরাও জড়িয়ে পড়ছেন। কোনো প্রসূতি পেলেই প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর এক শ্রেণির চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই বিভিন্ন অজুহাতে রোগীকে নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারে কৌশলে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। এমনকি সিজার না হলে মা কিংবা নবজাতকের ক্ষতি হওয়ার ভয়ও দেখানো হয় অনেক ক্ষেত্রে। নিরূপায় হয়ে প্রসূতি ও তার স্বজনরা নিরাপদ মাতৃত্ব ও সুস্থ সন্তানের স্বার্থে হাসপাতালের প্রত্যাশায় সায় দেয়। আর সিজারিয়ানের মাধ্যমে প্রসব পদ্ধতিতে রাজি হলেই শুরু হয় টাকা হাতানোর হিসাব কষাকষি।

অভিযোগ উঠেছে, নরমাল ডেলিভারির চেয়ে সিজারিয়ানে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক অনেক বেশি টাকা পায়। হাসপাতাল বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষেরও এতে ব্যবসা বেশি। কারণ বেশি সময় হাসপাতালে থাকতে হয়, ওষুধ বেশি লাগে, অপারেশন থেকে শুরু করে অন্যান্য খরচও বেশি আদায় করা হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশনের পর প্রসূতির অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের জীবাণু আক্রমণ দেখা দেয়। এতে হাসপাতালের ব্যবসা বেড়ে যায়। আর নরমাল ডেলিভারি হলে রোগী এক-দুই দিনের মধ্যে বাসায় চলে যেতে পারে। কিন্তু সিজারিয়ান হলে আগে-পরে মিলিয়ে রোগীকে প্রায় এক সপ্তাহ থাকতে হয়। এতে হাসপাতালের কেবিন বা বেড ভাড়া ও বিভিন্ন সার্ভিস চার্জের নামে অনেক বেশি টাকা আদায় করা সম্ভব।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিজারিয়ান ডেলিভারির পর কর্মদক্ষতা হারাচ্ছেন মায়েরা। সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অধিক রক্তক্ষরণ, ক্ষতস্থানে ইনফেকশনসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন অনেকেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ প্রসবে বা নরমাল ভ্যাজাইনাল ডেলিভারিতে শিশু মা থেকে কিছু অণুজীবাণু পেয়ে থাকে। যা নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ সিস্টেম গঠনে সুফল এনে দেয়। এছাড়া নরমাল ডেলিভারিতে জন্ম নেয়া শিশুতে প্রাইমারি পালমোনারি উচ্চ রক্তচাপ অনেক কম। ফলে সন্তান ঝুঁকিতে অনেক কম থাকে।

অন্যদিকে, সিজারিয়ান ডেলিভারিতে শিশুর মাতৃদুগ্ধ পান শুরু থেকে বেশি সমস্যাঘন থাকে। পাশাপাশি সিজারিয়ান অপারেশনে মাকে অস্ত্রোপচারের জন্য যেসব অ্যানেসথেটিক ওষুধ প্রয়োগ করা হয় তা নবজাতক শিশুতে প্রভাব ফেলে। এতে করে অনেক সময় বুকের দুধ পানে বাধা হয়ে উঠে। এছাড়া সিজারিয়ান ডেলিভারিতে মাকে বাকি জীবনে বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। নবজাতক শিশু  হাসপাতালে জন্ম নেয়ার কারণে বেশি ইনফেকশন ঝুঁকিতে থাকে। এইক্ষেত্রে সিজারিয়ান শিশুর ব্লাড ইনফেকশন হার বেশি। জন্ডিস দেখা দেয়।  

ফরসেপের তুলনায় মাথায় আঘাতের আশংকা ৬০ শতাংশ কম কিন্তু সিজারিয়ান বেবিতে ইনটেনসিভ কেয়ার পরিচর্যার সংখ্যা ফরসেপের তুলনায় ২ দশমিক ৬ গুণ বেশি। সর্বোপরি হাসপাতালে ভুমিষ্ঠ সিজারিয়ান শিশুরা বিভিন্ন অণুজীবাণু পায় হাসপাতালের পরিবেশ থেকে, যা অত্যন্ত ভয়ংকর জীবাণু। তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকখানি কমে আসে।

সোনালীনিউজ/এন