৮ বছরে ছাত্রলীগের কোন্দলের বলি ৬০

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০১৭, ০৫:২৫ পিএম

ঢাকা : লাগামহীন ছাত্রলীগ। কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না কোন্দলসহ বেপরোয়া আচরণ। দিন দিন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ায় অভিভাবক সংগঠন আওয়ামী লীগের নেতারাও অসহায়। ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম এই ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা খুনোখুনি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ, শিক্ষক লাঞ্ছনা, প্রশ্ন ফাঁস, অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে।

বিগত দিনের রেকর্ড বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শুধু গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হয়েছেন ৮ জন। অন্য এক হিসেবে দেখা গেছে, গত ৮ বছরে সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রায় ৬০ জন নিহত হয়েছেন। এ হিসাব শুধু অভ্যন্তরীণ কোন্দলের। এর বাইরে ছাত্রলীগ কর্তৃক আহত ও নিহত করার হিসাব তো রয়েই গেছে। অপরাধের এ ধারাবাহিকতা থেকে বের হতে পারছে না সংগঠনটি।

চলতি বছরেও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অসংখ্য সংঘর্ষে জড়িয়েছে ছাত্রলীগ। গত ১৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে কক্ষ দখল করতে রাতভর তা-ব চালায় ছাত্রলীগ। এর আগে গত বছরের শেষের দিকে এবং চলতি বছরের শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মনোনয়ন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ২০টির মতো সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগ। এসব ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পদহীন কর্মীদের তথাকথিত বহিষ্কারের মাধ্যমেই বিচার শেষ হয়।

১৪ জুন টেন্ডার দখলকে কেন্দ্র করে রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি) ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল হক ও সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ দাসের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে দু’জনই রক্তাক্ত হয়েছেন। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মধ্যে চলতি বছরের শুরুর দিকে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। যার নেপথ্যে ৫১ কোটি টাকার টেন্ডার ছিল বলে ছাত্রলীগ সূত্র জানায়।

এর আগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির হোসেন গুলিস্তানে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে সংবাদের শিরোনাম হন। ১২ জুলাই বুধবার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের দু’গ্রুপে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা দা-কিরিচ ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়।

সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে ছাত্রলীগ নেতাদের বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার বিষয়টি। খোদ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারাই সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইনের ‘লাইফ স্টাইল’ নিয়ে সমালোচনা করেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন বিলাসী গাড়ি ও দামি ফ্ল্যাটে থাকার টাকার উৎস নিয়ে। বিভিন্ন উৎস থেকে সংগঠনের নামে আসা অর্থের ব্যয়েরও হিসাব চেয়েছেন তারা।

নেতা হওয়ার আগের ও পরের জীবনধারার ব্যবধান উল্লেখ করেও সমালোচনা করেন তারা। নির্মাণাধীন বিভিন্ন ভবন থেকে অর্থ নেয়া হয়েছে- এমন অভিযোগ এনে তার প্রকাশ্য সমালোচনাও করেছেন তারা। এর আগে গত ১৩ জানুয়ারি কর্মশালা ও ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগ দিতে হেলিকপ্টারে পাবনার ঈশ্বরদীতে যান ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। একজন ছাত্রনেতার এভাবে হেলিকপ্টারে উঠা নিয়ে সে সময় দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনা হয়।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি টেন্ডার নিয়ে চট্টগ্রাম নগর ভবনে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষে সাতকানিয়া উপজেলায় এক ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত নিহত হন। গত বুধবার রাতে সিলেট এমসি কলেজে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা রঞ্জিত সরকারের অনুসারী হোসেইন গ্রুপ ও টিটু গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি হয়। রাতে হোস্টেলে উভয় গ্রুপই সশস্ত্র মহড়া দেয়।

বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) ভোরে সশস্ত্র অবস্থায় টিটুর নেতৃত্বে ২৫-৩০ জন নেতাকর্মী অতর্কিত হামলা চালিয়ে কলেজ হোস্টেল ভাঙচুর করেন। পাঁচ বছর আগে ২০১২ সালের ৮ জুলাই ঐতিহ্যবাহী ওই এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালায় ছাত্রলীগ।

গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর সিলেট এমসি কলেজে পরীক্ষা দিতে আসা সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিসকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা বদরুল। এ ঘটনা নিয়ে দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

গত ৩০ জুন নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলায় ছাত্রলীগ নেতা তোফাজ্জলের দাবি করা ৫ লাখ টাকা দিতে অস্বীকার করায় স্থানীয় কৃষক মুশতাকের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে গুরুতর আহত করা হয়। গত ১ জুলাই সুনামগঞ্জের দিরাই ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি ও ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া হয়।

গত ৪ জুলাই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে মানিকগঞ্জের শিবালয় সদরউদ্দিন ডিগ্রি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের উপসম্পাদক নাজমুল হুদাসহ দুইজন প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হন। এরপর ৯ জুলাই ঝালকাঠির রাজাপুর কলেজে একাদশ শ্রেণীর নবীনবরণ অনুষ্ঠানে যোগদান করার আগমুহূর্তেই ছবি তোলা ও বি এইচ হারুন এমপির পাশে হাঁটাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। একই দিনে বগুড়ার নন্দী গ্রামে ছাত্রলীগ কর্মী রিপনের গুলিতে এক যুবক নিহত হন।

গত ১২ জুলাই ওসি অপসারণের দাবিতে ছাত্রলীগের এক অংশের ডাকা বিক্ষোভ-সমাবেশ ও মানববন্ধন চলাকালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ছাত্রলীগের অপর অংশ হামলা চালায়। এতে গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। চলতি ৩ জানুয়ারি কক্সবাজারের চকরিয়ায় ইয়াবার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ইটের আঘাতে আহত হন এক প্রবীণ শিক্ষক।

গত ১২ জানুয়ারি রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে সিট ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। ২১ জানুয়ারি ঢাকা কলেজের আশপাশের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চাঁদার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পরে মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

সোনালীনিউজ/জেডআরসি/এমটিআই