কর্মীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিব্রত আ.লীগ

  • সোনালী বিশেষ | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ২, ২০১৭, ১০:৩৮ এএম

ঢাকা : নেতাকর্মীদের ধারাবাহিক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিব্রত হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ কয়েকটি সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতাকর্মীর বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে চিন্তিত হয়ে পড়েছে দলটির নীতি-নির্ধারকরা।

এসব সংগঠনের নেতাকর্মীরা খুনোখুনি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ, শিক্ষক লাঞ্ছনা, প্রশ্ন ফাঁস, অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছে।

দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, সরকার অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দল ও সহযোগী সংগঠনের এক শ্রেনীর নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ডে তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

বগুড়ার এক কিশোরীকে কলেজে ভর্তি করানোর নামে গত ১৭ জুলাই তাকে নিজ বাড়িতে কৌশলে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে স্থানীয় শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারের বিরুদ্ধে। তুফানের স্ত্রী এ ঘটনা জানতে পেরে স্বামীকে দায়ী না করে কিশোরীটিকেই ঘটনার জন্য দায়ী করে।

পরে সংরক্ষিত আসনের স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার মর্জিয়া হাসান রুমকির মাধ্যমে গত শুক্রবার শালিস সভা বসিয়ে নির্যাতিতা এবং তার মায়ের চুল কেটে দেয়। পরে নাপিত ডেকে তাদের ন্যাড়া করিয়ে এলাকা ছাড়া করার হুমকি দেয় অভিযুক্তরা। স্থানীয়রা তাদের হাসপাতালে ভর্তি করালে সে রাতেই তুফানসহ তার তিন সহযোগীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত শনিবার তুফানসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন নির্যাতিতা কিশোরী। এ ঘটনার পর গত রোববার তুফানকে বগুড়া শ্রমিকলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

এদিকে ঠাকুরগাঁওয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আব্দুল মান্নান হত্যার ঘটনার ২০ দিন পর অভিযুক্ত আসামি যুবলীগ নেতা মারুফ আলী শান্তকে সোমবার (৩১ জুলাই) গ্রেফতার করেছে পুলিশ।  

গত ১৭ জুলাই সিলেটের বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের পর একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এদিন দুপুরে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে খালেদ আহমদ লিটু (২৫) নামে ছাত্রলীগের এক কর্মী নিহত হয়।

লিটু জেলা ছাত্রলীগের আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক পাভেল মাহমুদের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। কলেজ এলাকার অধিপত্য নিয়ে দুপুরে পাভেলের অনুসারীদের সঙ্গে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবুল কাশেম পল্লবের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

একইদিন রাজশাহীর নিউ গভঃডিগ্রি কলেজে দলীয় তাবুতে বসা নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে তিনজন গুরুত্ব আহত হয়। এর আগে গত শনিবার চাঁদা না পেয়ে বরিশালের বানারীপাড়ার চাঁদা না দেয়ায় বরিশালের বানারীপাড়ার বেতাল গ্রামে স্বামীকে আটকে রেখে নববধূকে (২২) ধর্ষণ করে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন হোসেন মোল্লা।

এই ঘটনায় সোমবার (৩১ জুলাই) সুমনকে গ্রেফতার করা হয়। পাশাপাশি তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। এই ঘটনায় দেশে বিদেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। একইসঙ্গে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে তার শাস্তি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তথাকথিত সাংগঠনিক বহিষ্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তাদের শাস্তি। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সাংগঠনিক ইউনিটে ছাত্রলীগের কর্মকা- সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়।

এমনকি ফৌজদারি অপরাধ করলেও দেখা যায়, কোনো মামলা হচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে মামলা হলেও গ্রেফতার হয় না আসামিরা। ঘুরে বেড়ায় প্রকাশ্যে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বদ্ধমূল ধারণা- ‘অপরাধ করলে কিছুই হয় না।’

ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের এসব অপকর্ম দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। বিশেষ করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা খুন, হত্যা, ধর্ষণ, মারামারি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। দিন দিন তারা বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকে।

ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র তিন মাসের মাথায়ই তারা সরকারকে অস্থির করে তুলে। সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ আওয়ামী লীগের নেতারাও ছাত্রলীগের ওপর চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। এমনকি তাদের কর্মকাণ্ডে ক্ষিপ্ত হয়ে শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক পদ থেকে অব্যাহতি নেন। এর পর থেকে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।

সংগঠনটির বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান একাধিক ছাত্র নেতা। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ২ বছর পরপর নিয়মিত সম্মেলন, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের একক ক্ষমতায় ভারসাম্য এনে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, যে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে বিষয়টি এড়িয়ে না গিয়ে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা, ছাত্রলীগকে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের প্রভাবমুক্ত করা এবং শিক্ষক রাজনীতির প্রভাবে প্রভাবান্বিত হতে না দেয়া।

এছাড়া পরামর্শের মধ্যে আরও আছে, সংগঠনটিকে অতীত ঐতিহ্যে ফিরিয়ে নিতে ছাত্র নেতাদের অধ্যয়নমুখী করা, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বাইরে সংগঠনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতাদের বিভিন্ন পরামর্শ গ্রহণ এবং সর্বোপরি আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা করা।

রেকর্ড বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শুধু গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হয়েছেন ৮ জন। অন্য এক হিসেবে দেখা গেছে, গত ৮ বছরে সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রায় ৬০ জন নিহত হয়েছেন। এ হিসাব শুধু অভ্যন্তরীণ কোন্দলের। এর বাইরে ছাত্রলীগ কর্তৃক আহত ও নিহত করার হিসাব তো রয়েই গেছে। অপরাধের এ ধারাবাহিকতা থেকে বের হতে পারছে না সংগঠনটি।

সোনালীনিউজ/জেডআরসি/এমটিআই