জঙ্গিরা সাইবার দুনিয়ায় সক্রিয়

  • সোনালী বিশেষ | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০১৭, ০৩:২৮ পিএম

ঢাকা : বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন স্থানে নৃশংস সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে ইসলামিক স্টেট বা আইএস। মূলত ইরাক ও সিরিয়ায় এর শক্ত ঘাঁটি থাকলেও বিশ্বজুড়েই ছড়িয়ে পড়ছে সন্ত্রাসবাদী এই সংগঠনটি। গবেষকরা বলছেন, আগের সব সন্ত্রাসী সংগঠনের থেকে আলাদা আইএস। কারণ এরা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেদের মতাদর্শ ও প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর আগে আর কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে এভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।

ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দারুণভাবে সক্রিয় আইএস সদস্য ও এর মতাদর্শের অনুসারীরা। বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা ছড়ানো থেকে শুরু করে কর্মী সংগ্রহের কাজটিও অনলাইনের মাধ্যমে করে থাকে আইএস। দীর্ঘদিন ধরে আইএস ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কাজ করা গবেষক ও সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময়ে আইএস এর প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছেন। গত বছর ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি এ নিয়ে দুটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। মার্কিন গণমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা এ নিয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছিল। এ তিনটি প্রতিবেদনেই জঙ্গিদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ঘনিষ্ঠতাকে গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

জঙ্গিবাদের প্রচার, সদস্য সংগ্রহ ও সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর জন্য জঙ্গিরা সাইবার দুনিয়ায় সক্রিয় বলে পুলিশের ধারণা। সেখানে তারা ধর্মের অপব্যাখ্যা করে মানুষের সমর্থন আদায়, নতুন সদস্য সংগ্রহ ও অর্থ সংগ্রহের মতো কাজ করছে। আর তারা এসব করছে ছদ্মনাম ব্যবহার করে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানিয়েছে, ডিএমপির সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং টিম এ বিষয়ে নজরদারি করছে। যারা এসব কাজ করছেন তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে।

তবে সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েভের (ডাব্লিউডাব্লিউডাব্লিউ) মাধ্যম ছাড়াও অন্যভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। নাম ডার্ক ওয়েভ।

এছাড়া ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েভে ব্যবহাকারীরা বিশেষ সফটওয়ার বা ব্রাউজার ব্যবহার করে ইন্টারনেট প্রটোকল এড্রেস (আইপি) পরিবর্তন করতে পারেন। ফলে ব্যবহারকারীকে ট্রেস করে তার অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া অনেক কঠিন। মুহূর্তেই ওই ব্যবহারকারীকে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দেখা যাবে।

সিটিটিসি সূত্র জানায়, সম্প্রতি ডিএমপির সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং টিম ফেসবুকে মুজাহিদ মুসাফির নামের দুইটি প্রোফাইল খুঁজে পায়। দুই প্রোফাইল থেকে জঙ্গিবাদের পক্ষে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন পোস্ট দেয়া হয়। এর একটিতে কাভার ফটো হিসেবে ‘জঙ্গিবাদকে হ্যাঁ বলুন’ নামের একটি ছবি দেয়া ছিল। অন্যটিতে কাভার ফটো না থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পতাকা দিয়ে প্রোফাইল ছবি দেয়া ছিল। মূলত, আইএস যে পতাকা ব্যবহার করে তাতে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ লেখা থাকে।

বিষয়টি জানার পর সিটিটিসি ব্যাপক অনুসন্ধান চালায় এবং অনুমান করে, দুটি প্রোফাইল থেকেই রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ধংস করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবনতি যাতে ঘটে সে চেষ্টা ও জঙ্গিবাদের পক্ষে অর্থায়নে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। তাছাড়া বেশ কিছু উস্কানিমূলক পোস্ট দেখে সিটিটিসি কর্মকর্তারা অনুমান করেন যে, এর মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে। এরপর পুলিশের বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওই দুটি একাউন্টের ব্যবহারকারীর অবস্থান শনাক্ত করা হয়।

পরে ২ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মগবাজার চৌরাস্তা মোড় থেকে ব্যবহারকারীকে আটক করা হয়। এসময় তার  কাছ থেকে দুটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়; যেগুলোর ফেসবুকে মুজাহিদ মুসাফির নামের একাউন্ট লগইন করা ছিল। পরে জানা যায় তার নাম মো. খায়রুজ্জামান (২২)। তার বাবার নাম মো. ফজলুল হক। বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার নয়াচালায়।

জিজ্ঞাসাবাদে খায়রুজ্জামান তার ঢাকায় আসার কোন কারণ জানাতে পারেনি। তবে সে নিজেকে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম বাংলা টিমের সদস্য বলে দাবি করে।

এ বিষয়ে সিটিটিসির সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ দমন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নাজমুল ইসলাম জানান, খায়রুজ্জামান নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সক্রিয় সদস্য। সে জিহাদের মাধ্যমে খিলাফত কায়েমের চেষ্টাকে সমর্থন করে। সে তার দুটি ফেসবুক আইডি এবং চারটি পেজ থেকে জঙ্গিবাদের সমর্থনে নানা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো ও প্রাথমিক রিক্রুটমেন্টের কাজ ও জঙ্গি অর্থায়নের জন্য আহ্বান জানাতো।

এদিকে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু খায়রুজ্জামান নয়, ছদ্মনাম ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঙ্গিবাদের পক্ষে এ ধরণের প্রচারণা আরো অনেকে চালিয়ে যাচ্ছেন। ছদ্মনামে খায়রুজ্জামানের তৈরি করা মুজাহিদ মুসাফির নামের ফেসবুকে একাউন্টে গিয়ে দেখা যায়, তার বেশিরভাগ বন্ধুই ছদ্মনামের। ছবিও ব্যবহারে তারা বিভিন্ন ইসলামিক স্থাপনা, আইএস’র পতাকা, শিশু-কিশোরদের ছবি অথবা বিভিন্ন গ্রাফিকস ব্যবহার করেছেন। প্রোফাইলে তারা তাদের অবস্থান হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ উল্লেখ করেছেন। এছাড়া বায়ো: নামে ফেসবুকের যে নতুন অপশন সেখানে অনেকে নিজেকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

ছদ্মনামে তৈরি করা বেশ কয়েকটি ফেসবুক প্রোফাইলে দেখা যায়, তাদের সঙ্গে কিছু কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী সংযুক্ত হচ্ছেন যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছদ্মনাম ব্যবহার করেননি এবং প্রোফাইলে নিজেদের একধিক ছবি আপলোড করেছেন। তারাও বিভিন্ন উস্কানিমূলক লেখায় লাইক, কমেন্টের মাধ্যমে সমর্থন জানাচ্ছেন। এমনকি অনেকে তা শেয়ারও করছেন।

আল্লাহ মহান নামের ছদ্মনামের একটি ফেসবুক প্রোফাইলে চাকরির জায়গায় লেখা আছে, ‘জান্নাতে যেতে চাই, আল্লাহ যা করলে খুশি আমি সেটাই করি।’

আমি বিপ্লবি নামের একটি প্রোফাইলের বায়ো: তে লেখা রয়েছে, সুপার পাওয়ার এক আল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু। এই প্রোফাইলে ৮ আগস্ট দুপুরে একটি পোস্টে ফিলিস্তিনের হারাকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া (হামাস) বা ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন সম্পর্কে বলা হয়েছে। ‘হামাস হলো ফিলিস্তিনি সুন্নি ইসলামী বা রাজনৈতিক দল, যারা গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণ করে। এই সংগঠনের হামাসের ইজ্ আদ-দীন আল-কাসাম ব্রিগেড নামে একটি সামরিক শাখা রয়েছে।’

একইদিন সকালে অন্য একটি পোস্টে ভারতের রাজস্থানে একজন মুসলমান নির্যাতনের ছবিসহ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে মুসলমানদের উপর হিন্দুদের নির্যাতন বেড়ে গেছে। সেখানে মুসলমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

এদিকে সিরিয়ায় আইএসের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়া বেলজিয়ামের নাগরিক ইউনূসকে ২০১৪ সালে গ্রেফতার করে সে দেশের পুলিশ। ২০১৭ সালে তিনি মুক্তি পান। এরপর বার্তা সংস্থা সিএনএন তার উপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। সেখান ইউনূসের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার বিভিন্ন তথ্য উঠে আসে। পাশাপাশি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় জঙ্গিদের ভাবনার কথাও জানান তিনি।

ওই প্রতিবেদনের একটি ভিডিওতে দেখানো হয় অনলাইনে কীভাবে জঙ্গি সদস্য রিক্রুট করা হয়। সেটি জানতে সিএনএন একজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে। তারা একটি ফেসবুক একাউন্ট খুলেন; যেটি দেখতে মনে হবে যে জিহাদী একাউন্ট। এক সপ্তাহের মধ্যে ২০০ জনের বেশি ব্যক্তি এই একাউন্টে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান। তাদের বেশিরভাগই ইউরোপিয় নাগরিক ছিলেন। তারা কালো পতাকা ফেসবুক প্রোফাইল ছবি হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ বলছে, ‘অনেক তরুণই আইএসকে অনেক ভাল মনে করেন। এখন প্রশ্ন হলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখন কী করবে? তারা সৈন্য মোতায়েন করতে পারবেন, কিন্তু সুবিশাল ইন্টারনেটে পুলিশ কিছুই করতে পারবে না। খেলাফত ভার্চুয়াল জগতে চলে এসেছে।’

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ইন্টারনেটের ডার্ক ওয়েভে চলাফেরা করলে তাকে পাওয়া খুব কষ্টসাধ্য। সেখানে পৃথিবীর সব অপরাধীরা ঘুরে বেড়ায়। যেহেতু জঙ্গিরা তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখে সেহেতু তারা ডার্ক ওয়েভ ব্যবহার করতে পারে।

গবেষক ও সাইবার বিশেষজ্ঞ হাসান উল করিম বলেন, ‘ইন্টারনেটে অপরাধীদের গতিবিধি জানতে পুলিশের আরো প্রশিক্ষণের দরকার আছে। কারণ, ডার্ক ওয়েভে এনকোড কোথা থেকে হচ্ছে বা ডিকোড কোথায় হচ্ছে তা দুই ব্যবহারকারী ছাড়া সাধারণত অন্য কেউ বুঝতে পারে না।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই