হাসিনার সঙ্গে বুক, খালেদার সঙ্গে হাত মেলালেন সুষমা

  • সোনালী বিশেষ | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০১৭, ০৪:০৯ পিএম

ঢাকা : বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয়নি। দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সফরের পর এমনটাই ভাবছেন। এর যুক্তি হিসেবে তারা মনে করছেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে যে সর্ম্পক গড়ে উঠেছে, তা ভারতের জন্য স্বস্তিদায়ক। সুষমার সফর নিয়ে মুল্যায়ন করতে গিয়ে রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সুষমা প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে বুক মেলালেন। আর বিএনপির চেয়ারপার্সনের সঙ্গে করলেন করমর্দন।

বিশ্লেষকরা বলেন, সুষমা স্বরাজ বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিবেশিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়ে থাকে। এ প্রতিবেশীর তালিকায় সবার আগে রয়েছে বাংলাদেশ। ভারত ও বাংলাদেশেরে সর্ম্পক বর্তমানে ‘অসাধারণ’ বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। তার এই কথাতেও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি তিনি স্পষ্ট বার্তা দিয়ে গেছেন। মুলত বাংলাদেশ ভুখন্ড কোন কারণে অস্থিরতা তৈরি হলে এর প্রভাব প্রতিবেশী ভারতের উপর গিয়েও পড়বে।

গত রোববার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ২৪ ঘন্টার সফরে বাংলাদেশ আসেন। সফরকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ৩টি বৈঠক করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা, সংসদের বিরোধী নেতা এবং সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী জোটের নেতা বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে কথা হয়েছে তার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর আমন্ত্রণে দ্বিপক্ষীয় রুটিন আলোচনা জেসিসি বৈঠকে অংশ নেয়াই ছিল সফরের মুখ্য উপলক্ষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিল্লির বিদেশ মন্ত্রীর সফরটি রুটিন আলোচনায় সীমাবদ্ধ ছিল না।

সুষমা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে  প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একাত্ত্বতা প্রকাশ করে বলেন, তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে। এসময় তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন। কিন্ত খালেদা জিয়া সুষমার সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত এক ঘন্টার বৈঠকে কোন একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ভারত যে এখনও বিএনপিকে আস্থায় নিতে পারেনি এটা তার একটা দৃস্টান্ত।

খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই বেগম জিয়া নির্বাচনকালীন সরকার ও বিএনপির প্রতি ভারতের আস্থা অর্জনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষনের চেস্টা করলেও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কৌশলে তা এড়িয়ে যান বলে জানা যায়। সুষমা খালেদা জিয়ার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেও কোন উত্তর না দিয়ে কৌশলে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ডিপ্লোম্যাটিক রুটিন টক এর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেন।বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিবের প্রেস ব্রিফিংয়েও তাই সেই প্রতিধ্বনিই শোনা যায়।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনীতি, বিশেষ করে আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। স্বাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ‘বিশেষ মাত্রা’ অব্যাহত রাখার ব্যাপারে ভারতের অঙ্গীকারের কথা জানান সুষমা স্বরাজ।

নির্বাচন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশের একটি সরকারি সূত্র জানায়, বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত সব সময় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার পক্ষে। তাই ভারত যে বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়, সেটি সুষমা স্বরাজ বলেছেন। এ জন্য সব দলকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারের দায়িত্বের কথা বলেছেন। আর নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির সময় সাবধানি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রসঙ্গটিও তিনি উলে­খ করেছেন বলে জানা যায়।

রাজনৈতিক ও ক‚টনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, সুষমা স্বরাজের সঙ্গে আলোচনায় খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনের প্রসঙ্গটি তুলেছেন। এ সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন কম, শুনেছেন বেশি। বিএনপির নেত্রী বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়ার প্রসঙ্গ তুললে সুষমা রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নতির জন্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজসহ সব পক্ষকে একসঙ্গে দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার প্রসঙ্গটি আলোচনায় তোলেন বিএনপি নেত্রী। এ সময় সুষমা স্বরাজ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভারতের নির্বাচন পরিচালনার প্রসঙ্গ টানেন। তিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনা করাকে ‘প্রক্রিয়ার বিচ্যুতি’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

সুষমা স্বরাজ বলেছেন, বাংলাদেশে কীভাবে নির্বাচন হবে, সেটি ঠিক করবে এ দেশের জনগণ। তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিকল্প নেই। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, শেখ হাসিনার অধীনে অংশ নেবে না বলেই বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল। আগামী নির্বাচনেও তাদের মূল দাবি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। কিন্তু আগামী নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনেই হতে হবে সুষমা স্বরাজও এমন ধারণা দিয়ে গেছেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, সবার অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচনের বিষয়ে সুষমা স্বরাজ যা বলেছেন, আওয়ামী লীগের অবস্থানও তাই। ফলে সুষমা স্বরাজের অবস্থান সঠিক।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সংবিধান অনুসারে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ কোনো ছাড় দেবে না। আর বিএনপি এই পদ্ধতিতে আগামী নির্বাচনে এলে ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক আছে, সেটা অনেকটা চাপা পড়ে যাবে। তবে বিএনপি চাইলে নির্বাচনী আইন কিংবা ছোটখাটো অন্য বিষয়ে ছাড় দিতে রাজি আছে।

বৈঠকে উপস্থিত একাধিক বিএনপি নেতা জানান, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনেক দেশেই আছে। কিন্তু একটি সংসদ বহাল রেখে আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা যে নজিরবিহীন, সেটি তাঁরা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পরিষ্কার করে বলেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, একটা সংসদ বহাল রেখে আরেক সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের সংবিধানে ছিল না। গত নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকার সংবিধান সংশোধন করে এটা করেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দিল্লি ও আমেরিকা তাদের সব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে কিভাবে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখা যায়। কারণ ভারত তারেক রহমান ও পরেশ বড়ুয়ার ভেতর খুব বেশি পার্থক্য দেখতে পায় না। বরং পরেশ বড়ুয়ার থেকে তারা তারেক রহমানকে নিয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন।

এবং তারা তাদের ইন্টারনাল সিকিউরিটি ক্ষেত্রে তারেক রহমানকে অনেক বড় হুমকি মনে করে। দিল্লির নীতি নির্ধারকরা খুব ভালো ভাবে জানেন, বিএনপির কোনও ক্রমেই পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর হাত থেকে বের হয়ে আসার উপায় নেই। এ অবস্থায় বাংলাদেশে বিএনপি ক্ষমতায় আসার অর্থ হলো ভারতের জন্যে আরেকটি পাকিস্তান খাড়া হয়ে দাঁড়ানো।

সুষমা স্বরাজ সফরকালে রোহিঙ্গা নিয়ে নিয়েও দিল্লির অবস্থান স্পষ্ট করে গেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন,  সফরকালীন সিরিজ বৈঠক, একান্ত আলোচনা, বক্তৃতা বা বিবৃতির কোথাও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উল্লেখ করেননি তিনি। ভারতও চায় রাখাইনের বাস্তুচ্যুতরা তাদের বসতভিটায় ফিরুক। দিল্লি মনে করে সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে হবে। রাখাইনে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সেই উন্নয়ন কার্যক্রমে দিল্লির সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকারের বিষয়টিও স্পষ্ট করেছেন বিদেশমন্ত্রী। তিনি আনান কমিশনের রিপোর্ট এবং সুপারিশ বাস্তবায়নে দিল্লির পূর্ণ সমর্থনের বিষয়টিও স্পষ্ট করেছেন।

সুষমা স্বরাজ বলেন, রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের ফিরিয়ে নিলেই কেবল স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে- এটা একেবারে পরিষ্কার। তিনি আরো বলেন, আমি আরো যোগ করতে চাই যে, রাখাইন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় ভারত গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা সংযম, মানুষের কল্যাণের কথা মাথায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার আহ্বান জানাই।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ভারত সরকার ভালো করেই জানে আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল অংশ নেবে। তা ছাড়া গতবার যে আশা থেকে আওয়ামী লীগকে ভারত সমর্থন করেছিল, সেটি হয়নি।

বরং বাংলাদেশের জনগণের কাছে ভারতের ব্যাপারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। তাই আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার কথা বলে ভারত বোঝাতে চাইছে কোনো বিশেষ দল নয়, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে তারা সুসম্পর্ক চায়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই