শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ

দুদকের ৬ হাজার মামলা থানায় ‘লাওয়ারিশ’

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ৩, ২০১৮, ১২:৫৭ পিএম

ঢাকা : শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ ও জালিয়াতির অপরাধে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের দায়ের করা ছয় হাজার মামলা ‘লাওয়ারিশ’ অবস্থায় পড়ে আছে বিভিন্ন থানায়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা হাপিত্যেশ করছে। ২০১৬ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) আইনে সরকারি স্বার্থ না থাকায় ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ ও জালিয়াতির ঘটনা তদন্তের এখতিয়ার চলে যায় পুলিশের হাতে। সীমিত জনবলের কারণে দুদকের অন্যান্য অভিযোগের অনুসন্ধান ও মামলার তদন্তে স্থবিরতা দেখা দিলে দুদক আইনের এই সংশোধনী আনে সরকার।

দুদকের হাতে আছে শুধু প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রতারণা, আত্মসাৎ ও জালিয়াতি তদন্তের এখতিয়ার। দুদক আইনের এই সংশোধনী কার্যকর হওয়ার পর দুদকে চলমান কিন্তু এখতিয়ার-বহির্ভূত অনুসন্ধান ও তদন্তগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হয় পুলিশের হাত।

পুলিশের হাতে দুদকের দায়েরকৃত মামলাগুলো আসার পর সেগুলো তদন্তাধীন হিসেবে পড়ে থাকে। মামলা আর সক্রিয় হয় না। মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে পুলিশকে কখনো তৎপর হতে দেখা যায় না বলে বিস্তর অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

দুদক সচিব ড. শামসুল আরেফিন এ প্রতিবেদককে বলেন, আইন সংশোধন হওয়ার পর কমিশনের এখতিয়ার-বহিভর্‚ত আত্মসাৎ, প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলাগুলো যার কাছে যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায়ই ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিসমাপ্তি ঘটেছে’ মর্মে আদেশ জারি করা হয়েছে। পরিসমাপ্ত মামলাগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট থানায়। তিনি বলেন, ‘আমরা মামলাগুলোর কোনো পরিসংখ্যান রাখিনি। তবে ছয় হাজারের কম নয়। পরবর্তী সময়ে মামলাগুলোর কী পরিণতি হয়েছে, সেই খোঁজ রাখাটাও আমাদের এখতিয়ার-বহির্ভূত।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদক আইন সংশোধনীর ফলে হয়তো দুদকের ওপর চাপ কমেছে। দায় চলে গেছে পুলিশের কাছে। তবে দুদকের উচিত ছিল থানা-পুলিশের হাতে চলে যাওয়া মামলাগুলো কোনো একটি প্রক্রিয়ায় মনিটর (পরিবীক্ষণ) করা। কারণ এতে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রয়েছে। তিনি আরো বলেন, আইনি এখতিয়ার হারালেও দুদকের হাতে মামলাগুলোর মনিটরিং কিংবা ন্যূনতম একটা অভিভাবকত্ব থাকা দরকার।
 
কেস স্টাডি (এক) : প্রবাসী শ্রমিকদের প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে দেশে পালিয়ে আসেন সুনামগঞ্জের গোলাম কিবরিয়ার ছেলে শিরতাজ আহমেদ। তিনি সৌদি আরবের খামিছ এলাকায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়ে ‘ডায়নামিক মিশন লি.’ নামে একটি সমিতি গড়ে তোলেন। দ্বিগুণ লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলে সমিতির সদস্য ২৮ শ্রমিকের কাছ থেকে জনপ্রতি পাঁচ লাখ টাকা করে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে তিনি দেশে পালিয়ে আসেন।

২০১৫ সালে দুদক বিষয়টি ‘অভিযোগ’ হিসেবে আমলে নেয় এবং ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪২০ ধারাসহ সংশ্লিষ্ট তিনটি ধারায় অনুসন্ধান শুরু করে। কর্মকর্তা ছিলেন সহকারী পরিচালক মাসুদুর রহমান। কোনো অভিযোগকারী না থাকায় মামলাটির কোনো বাদীও নেই। দুদক নিজেই এটির বাদী। এ মামলাটি এখন পড়ে আছে সুনামগঞ্জ সদর থানায়। যেসব প্রবাসী শ্রমিকের অর্থ আÍসাৎ করা হয়েছে, তারা কোনো প্রতিকারই পাচ্ছেন না। দুদকে শুরু হওয়া অনুসন্ধানটি থানা পুলিশের কাছে এখন ‘তদন্তাধীন’ অবস্থায় পড়ে আছে। নিষ্পত্তির কোনো তাগিদও নেই।

কেস স্টাডি (দুই) : দ্বিগুণ মুনাফার লোভ দেখিয়ে পাঁচ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে তিন হাজার কোটি টাকা বাগিয়ে নেয় আইডিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড (আইসিএল)। হজ আমানত, ডিপিএস, মাসিক মুনাফা, দ্বিগুণ বৃদ্ধি আমানত, শিক্ষা আমানত, আবাসন আমানত, ব্যবসায়িক আমানত, দেনমোহর আমানত, কোটিপতি ডিপোজিট স্কিম, লাখপতি ডিপোজিট স্কিমসহ চটকদার প্রকল্পের নামে অর্থ কামিয়ে নেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলামসহ অন্যরা। দুদক বিষয়টি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। গঠিত হয় পাঁচ সদস্যের তদন্ত দলও। উপপরিচালক নাসিরউদ্দিনের নেতৃত্বে এই দল টানা তিন বছর অনুসন্ধান চালায়।

অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুর রহমান, তার স্ত্রী কাজী সামসুন নাহার মিনা, পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম, শেখ আহমেদ এবং এসএম মোর্শেদ জুয়েলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জব্দ করা হয় তাদের মালিকানাধীন ১৩ প্রতিষ্ঠানের রেকর্ডপত্রও। তৎকালীন কমিশনের মৌখিক নির্দেশে ওই কর্মকর্তা কোনো কোনো ভুক্তভোগীর কিছু অর্থ আদায় করে দেন। এ পর্যায়ে প্রতারণা, আত্মসাৎ ও জালিয়াতির তদন্তের এখতিয়ার দুদক থেকে পুলিশের হাতে চলে গেলে অনুসন্ধানটি মামলায় রূপান্তরিত হয়ে চলে যায় থানায়। বর্তমানে বাড্ডা থানায় মামলাটি তদন্ত পর্যায়ে স্থবির হয়ে পড়ে রয়েছে। এদিকে আইসিএলের কাছে অর্থ খোয়ানো লাখ লাখ ভুক্তভোগী প্রতিকারের আশায় দিন গুনছেন।

থানায় পড়ে থাকা প্রায় ছয় হাজার আত্মসাৎ, প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলার প্রেক্ষাপটগুলো প্রায় অভিন্ন। অথচ মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে নেই কোনো পুলিশি তৎপরতা। ফলে এক দিকে ভুক্তভোগীরা প্রতিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অপরদিকে অপরাধীরা দৃশ্যত দায়মুক্তির সুবিধা ভোগ করছে।

রাজধানীর কয়েকটি থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুদক থেকে আসা মামলাগুলোর বেশিরভাগই পড়ে আছে অনিষ্পন্ন অবস্থায়। ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়ার মধ্য দিয়ে কিছু মামলা নিষ্পত্তিও হয়েছে বলতে গেলে একতরফাভাবে। রাজধানীর উত্তরখান থানার ওসি মো. হেলালউদ্দিন (সাবেক ওসি, তদন্ত, ধানমন্ডি থানা) এ প্রতিবেদককে জানান, দুদকের পাঠানো মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না- এটি ঠিক নয়।

তিনি দাবি করে বলেন, ‘আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির চেষ্টা করছি। জনবল সঙ্কট রয়েছে। তবুও দুদক থেকে আসা কিছু কিছু মামলা আমার দায়িত্বকালে নিষ্পত্তি হয়েছে।’

তিনি জানান, মামলাগুলোর বেশিরভাগের বাদীর খোঁজ নেই বলে বাধ্য হয়ে একতরফাভাবে নিষ্পত্তি করতে হয়েছে। কলাবাগান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সমীরচন্দ্র সূত্রধর বলেন, ‘আমি দুদকের ১৮টি মামলা পেয়েছি। এর মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি মামলা নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি। এগুলো শেষ করে বাকি ১৩ মামলায় হাত দেব।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই