প্রবীণ নিবাস : চোখের জলে ঈদ যাদের

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ১৭, ২০১৮, ০৫:৩৫ পিএম

ঢাকা : ‘বাবা রে- চল্লিশ বছর পূর্বে, ঈদের আগের দিন বিকালে নতুন জামা-কাপড় নিয়ে আসতে পারেনি তোর বাবা। সুদের দেনা শোধ করতে গিয়ে ভেজাচোখে খালি হাতে ফিরেছিল তোর বাবা। তোর জন্য কিছুই আনতে পারেনি, এ কথা বলতেই আমার বুকটা মুচড়ে ওঠে। তারপর বাঁশের খুঁটিতে রাখা পয়সা আর মাটির মটকায় জমানো দুই কেজি খুদের চাউল তোর বাবার হাতে দিয়েছি। চাউল বিক্রি আর জমানো পয়সা মিলিয়ে গঞ্জের হাট থেকে জামা আর প্যান্ট নিয়ে এসেছিল তোর জন্য। আহ্ সে কী আনন্দ। সে রাতে আমরা যেন আগাম ঈদ উদযাপন করেছিলাম। আজ আমি নিঃস্ব অসহায়! আমাকে দেখার কেউ নেই!’

গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে বসে বসে সংসার জীবনের বাড়ন্ত সময়ের সেই আনন্দঘন স্মৃতি কল্পনা করে চোখের জলে বুক ভাসান কুমিল­ার আছিয়া বেগম (ছদ্মনাম)। গত ঈদুল ফিতরের সময়ে কথা হয়েছিল আছিয়া বেগমসহ অনেকের সঙ্গে। জীবনের ৬৮ বছর বয়সে এসে এমন পরিণতি শুধু আছিয়া বেগমের নয়; বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বয়স্ক নারী-পুরুষ সবারই। ফেলে আসা দিনগুলোতে পরিবারের সঙ্গে এমন আনন্দঘন স্মৃতি পরিণত বয়সের এই করুণ মুহূর্তে তাদের স্মৃতিকাতর করে তোলে। প্রতিটি মুহূর্ত কাটে চোখভেজা দীর্ঘশ্বাসের কষ্টের কুণ্ডলীতে।

প্রায় ১৫ বছর পূর্বে এই কেন্দ্রে আসেন চাঁদপুরের মতলব থানার বাসিন্দা বৃদ্ধ আবদুস সাত্তার (৮৫)। একসময় তিনি সাইন বোর্ড তৈরির কারিগর ছিলেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক) সাইন বোর্ডটি তিনিই লাগিয়েছিলেন। তিন ছেলেমেয়ে এখন দেশে-বিদেশে আছে। স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকে। তিনি জানান, কেউ খোঁজ নেয় না। এই আক্ষেপে কষ্টের ঢেউগুলো মাঝে মাঝে বুক ঢুঁকরে বেরিয়ে আসে তার।

১৫ বছর পূর্বে এ কেন্দ্রে আসেন ভারতের মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা সৈয়দ আহম্মদ আলীর স্ত্রী বেগম হোসনে আরা (৭৫)। তিনি ২৬ বছর আগে স্বামী ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। ঢাকার বনানীতে থাকতেন। স্বামী, মেয়ে ও ভাই মারা যাওয়ার পর বৃদ্ধাশ্রমে আসেন। ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা ঢাকায় থাকেন, কিন্তু কেউ খোঁজখবর নেয় না। একই পরিস্থিতি রাজশাহীর সাগরপাড়া গ্রামের ফিরোজা রহমান, চাঁদপুরের এসএম জামানসহ (৭৩) দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা অনেক প্রবীণের। বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে রয়েছে এমন শত শত নারী-পুরুষ। যারা শেষ বয়সে এসে স্বজনদের অবহেলায় চরম আক্ষেপ আর বুকভরা কষ্ট নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে বসে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।

সমাজবিজ্ঞানী আশিক মাহমুদ শিমুল মনে করেন, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই অনেক পরিবারের বয়স্ক স্বজনদের ভাগ্যে এমন পরিণতি ঘটছে। যা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ নিজের জায়গাটি বিবেচনা করে শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসার বিশ্বাসে ফিরে আসা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই