থামছে না সড়কে মৃত্যু

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ১৯, ২০১৮, ০১:৪৬ পিএম

ঢাকা : সড়কে গণপরিবহনের বেপরোয়া গতি ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ, অঙ্গহানির শিকার হচ্ছেন আরো অনেকে। গত দুই মাসে শুধু রাজধানী ঢাকায় সড়কে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে ছাত্র, চাকরিজীবী, গৃহবধূসহ অনেকের। ঢাকার বাইরেও আছে মৃত্যুর লম্বা সারি।  

সড়কে গণপরিবহনের বেপরোয়া গতিতে জীবনহানি নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। গণপরিবহনের মালিক-শ্রমিক, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ), পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ পরস্পরের ওপর দুর্ঘটনার দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। এতে প্রধান বিষয় চলে যায় আড়ালে। অসংখ্য দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দায় নিয়ে গণমাধ্যম ও আদালতের ভূমিকায় নড়েচড়ে বসেছেন গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। তারা এখন স্বীকার করছেন, সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বিদ্যমান দৈনিক চুক্তিতে গাড়ি চালানোর প্রথা।

শ্রমিকরা বলছেন, চুক্তির লক্ষ্য পূরণে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় তারা বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে মালিকরা বলছেন, শ্রমিকরা বাড়তি মুনাফার লোভেই চুক্তিতে গাড়ি নিচ্ছেন। সম্প্রতি ঢাকাসহ সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ার কারণ নিয়ে আলাপে তারা অধিকাংশ বাসের ফিটনেস, চালকের মাদকাসক্তি, পথচারীদের ট্রাফিক আইন ভাঙার প্রবণতা ও ট্রাফিক পুলিশের গাফিলতির কথাও বলেছেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত বলে আসছি, চুক্তিভিত্তিক গাড়ি যতদিন রাস্তায় থাকবে ততদিন চালকদের মধ্যে রেষারেষিও থাকবে। এটাই দুর্ঘটনা বাড়ার প্রধান কারণ। সম্প্রতি রাজধানীতে বিআরটিসি (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন) ও স্বজন পরিবহনের রেষারেষিতে হাত হারিয়ে কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, এটার কারণও ছিল কিন্তু একই।

ওসমান বলেন, বিআরটিসি একটি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। সরকারের এটা ভর্তুকি দিয়ে চালানোর কথা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের বাসগুলোও এখন লিজ দেওয়া হচ্ছে, মানে দৈনিক চুক্তিতে চলছে। যে কারণে বেসরকারি পরিবহনগুলো এখন বিআরটিসির বাসের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করছে। আওয়ামীপন্থী সংগঠন সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইনসুর আলীও চুক্তিতে চলার কারণে সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ার কথা স্বীকার করেন।

বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, আমি ড্রাইভার হিসেবে একটি গাড়ি চুক্তিতে নিলে সহকারী ও সুপারভাইজারের বেতন আমাকে দিতে হবে। এরপর মালিকের ভাড়া, রাস্তার চাঁদা, তেল বা গ্যাস খরচসহ সব মিলিয়ে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা শুধু আমার খরচই হবে। এরপর যা থাকবে সেটুকু নিজের।

ইনসুরের অভিমত, চালকরা যখন চুক্তির টার্গেট পূরণে ব্যর্থ হন তখনই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। রাজধানীর শনির আখড়ার মেয়র হানিফ উড়ালসড়কে গত ১২ মে বাসের চাপায় পা হারানো কমিউনিটি পুলিশের সদস্য আলাউদ্দিন সুমন গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। একই দিনে সেই একই ফ্লাইওভারে বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী গণমাধ্যমকর্মী নাজিম উদ্দিন নিহত হন।

গত ২৮ এপ্রিল এই ফ্লাইওভারের ওপরে কথা কাটাকাটির জেরে গ্রিন লাইন পরিবহনের বাসচালক ক্ষিপ্ত হয়ে একটি প্রাইভেটকারের চালকের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলে ঘটনাস্থলেই রাসেল সরকারের বাম পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।  

ঢাকায় গুলিস্তান-মিরপুর রুটে আট বছর ধরে চালক হিসেবে কর্মরত মো. বশির বলেন, চুক্তির টার্গেট অনুযায়ী মালিককে টাকা দিতে না পারলে পরের দিন গাড়ি পাওয়ার সুযোগ নেই। যে কারণে আমাদের এই রেষারেষি-পাড়াপাড়ি আর মানুষের হয়রানি। চুক্তিতে বাস চালানোর জন্য দিনে যাত্রী আর রাতে মালিকের সঙ্গে ঝগড়া করতে হয়।

প্রায় দুই দশক ধরে দূরপাল­ার বাসচালক হিসেবে কর্মরত মো. জাকির হোসেন বলেন, চালক ও হেলপারের দোষ পায়ে পায়ে। অথচ দেশের রাস্তাঘাটের যে অবস্থা তাতে শুধু চালকদের দোষ দেওয়া ঠিক না।  

তিনি বলেন, দেখবেন ওভারব্রিজের নিচ দিয়েও মানুষ হুট করে দৌড় দিয়ে গাড়ির নিচে পড়ছে, আর তখনো দোষ হচ্ছে চালকের। বলা হচ্ছে, সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। তার অভিমত, এসব ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সচেতন হওয়া উচিত। তাদেরও ট্রাফিক আইন মেনে চলা উচিত। বিদ্যমান ট্রাফিক আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ হলে সড়কে দুর্ঘটনার হার কমে যেত।

এ দাবি বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরীর। তিনি বলেন, সরকার ট্রাফিক পুলিশকে দায়বদ্ধ করতে পারেনি। তাদের কার্যক্রম কোনোভাবেই জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়নি।  

অন্যদিকে ঢাকা শহরে অদক্ষ চালকও বেশি বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল­াহ। তিনি বলেন, অনেক চালক বেশি মুনাফার জন্য ট্রিপভিত্তিক গাড়ি নিয়ে থাকে। এ কারণে তারা রেষারেষি করে। তিনি বলেন, দৃশ্যত ঢাকা শহরের পরিবহন ব্যবসা শ্রমিকের হাতে। কিন্তু মালিকরা তাদের চাপ দিয়ে বলছে যে, দৈনিক তাকে তিন থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা দিতে হবে। না দিলে বা কম দিলে পরদিন গাড়িটা অন্য কাউকে দেওয়া হচ্ছে।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মনে করেন, এই কারণে চালকরা মানসিক প্রেসারে থাকছে। অন্যদিকে অতিরিক্ত শ্রম দিলেও তারা ধূমপান, মাদকসহ নানা ধরনের আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ছে।  

গণপরিবহনের চালক-সহকারীরাও সঙ্গে আলাপে নিজেদের মাদকাসক্তির কথা স্বীকার করে। তাদের মতে, কেউ পরিবহন সেক্টরে এলে সঙ্গদোষে নেশাসক্ত হয়ে পড়ে। নেশা করে শ্রমিকরা সব বঞ্চনা ভুলে থাকার চেষ্টা করে বলেও দাবি করে দু-একজন। শ্রমিকরা আরো জানায়, ঢাকা শহরে যেসব বাস বা মিনিবাস চলে, এগুলো মূলত বাতিল গাড়ি। কাগজপত্র ঠিক নেই। রুট পারমিট নেই। চেসিস, বডি কিছুই ঠিক নেই। এ কারণেও অনেক সময় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারায়।  

মোজাম্মেল হক বলেন, বাংলাদেশে আরো বেশি বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা হওয়ার কথা। শুধু আল­াহর রহমতের কারণে আমরা কোনোমতে বেঁচে ঘরে ফিরতে পারছি। ওসমান আলীর অভিমত, চালকদের প্রশিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।

আর ইনসুর আলী মনে করেন, এই সার্বিক অবস্থার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দরকার। এনায়েত উল­াহ বলেন, সার্বিক সচেতনতা বৃদ্ধিও খুব দরকার। শুধু পরিবহন শ্রমিক নয়, যাত্রী-পথচারীদেরও সচেতন করতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই