এই সংসার আসা যাওয়ার রঙ্গমঞ্চ

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ৮, ২০১৯, ০৬:৫৪ পিএম

ঢাকা : কেউ ঠিক ১০ বছর আগে, আবার কেউ পাঁচ বছর আগে যে দিনে যে সভাকক্ষে বসে প্রথম সভা করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে কাজ শুরু করেছিলেন, সোমবার (৭ জানুয়ারি) সেই সভাকক্ষেই এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একই দিনে বিদায় নেন ৩৬ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী।

এদের মধ্যে যারা পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী ছিলেন তাদের প্রায় সবাই প্রবীণ নেতা। মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যদের শপথের আগে সচিবালয়ে নিজেদের শেষ কর্মদিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময় নতুনদের জায়গা দিতে পুরনোদের সরে যাওয়াই চিরায়ত নিয়ম বলে জানিয়েছেন বিদায়ী মন্ত্রীরা।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর আনুষ্ঠানিকভাবে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে বিদায় নেন। যাওয়ার আগে তাঁরা নতুন মন্ত্রিসভা কেমন হলো তা নিয়ে যেমন বলেছেন, তেমনি নিজেদের কর্মকান্ড নিয়েও কথা বলেছেন।

সোমবার (৭ জানুয়ারি) তেমন কোনো কাজ হয়নি কোনো মন্ত্রণালয়েই। বিদায়ের আবহ ছিল সব জায়গাতে। মন্ত্রণালয়গুলোতে নতুন মন্ত্রীদের নিয়ে আলোচনা ছিল। নিয়ম অনুযায়ী, নতুন মন্ত্রিসভার শপথের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে গেছে।

সোমবার (৭ জানুয়ারি) দুপুরের পর শেখ হাসিনার চতুর্থ মেয়াদের সরকারের সদস্যরা শপথ নেন। শপথ নেন ২৪ জন মন্ত্রী, ১৯জন প্রতিমন্ত্রী ও ৩ জন উপমন্ত্রী।

ঝেটিয়ে বিদায় করার চেয়ে অবসর ভালো : মন্ত্রীর পদ থেকে নিজেই সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত।

বলেছেন, অবসর  না নিয়ে ঝেঁটিয়ে বিদায় হয়ে যাওয়া, সেটার থেকে তো রক্ষা পেয়েছি। শেষ কার্যদিবসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের পক্ষ থেকে বিদায়ী সংবর্ধনা দেওয়া হয় মুহিতকে। ১০ বছর অর্থ মন্ত্রণালয় সামলানোর পর নতুন মন্ত্রিসভায় থাকছেন না আবুল মাল আবদুল মুহিত।

প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন, তিনি অবসর সময়ে বই পড়বেন ও লেখালেখি করবেন। যদিও রবিবার বাছাই করা মন্ত্রীদের তালিকায় মুহিতের নাম ছিল না।

বিদায়ী অর্থমন্ত্রী বলেন, এটি আমার খুব আনন্দের বিষয়, আমাকে বিদায়-টিদায় করতে হয়নি, আমি নিজে নিজেই বিদায়টা নিয়ে নিয়েছি। সেজন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ভোটে জয়ের পর ৬ জানুয়ারি শপথ নেওয়া মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন মুহিত। সেই থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন তিনি। একটানা দিয়েছে ১০টি বাজেট।

মুহিত বলেন, আমাকে বিদায় করা হয়নি। আমি নিজ ইচ্ছায় অবসরে যাচ্ছি। এটি একটি বিরল সম্মান ও সৌভাগ্যও বটে। অবসরে কী করবেন- এমন প্রশ্নে সাংবাদিকদের মুহিত বলেন, এখন থেকে অবসর সময়ে বই পড়ব ও লেখালেখি করব। আমার কালেকশানে ৫০ হাজার বই আছে। এগুলো সব পড়া হয়নি। চিন্তা করছি অবসরে গিয়ে এগুলো কিছু কিছু পড়তে শুরু করব। আরেকটি কাজ আমি করব। সেটা হচ্ছে এই পড়ার ওপরে আমি লেখালেখি করব। আর আমি ৩৪টি বই লিখেছি।

এর মধ্যে ১২টি ইংরেজি, আরও বই লিখব। অনুষ্ঠানে ছিলেন নতুন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান যিনি গত পাঁচ বছর মুহিতের ডেপুটি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

এই সংসার আসা-যাওয়ার রঙ্গমঞ্চ : সদ্যবিদায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, এই সংসার আসা-যাওয়ার রঙ্গমঞ্চ। নতুনদের জায়গা করে দিতে হবে। নতুনদের নিয়ে যে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়েছে সেটা চমৎকার। আমরা তো এমপি হিসেবে সংসদে থাকবোই। এই সরকারের সফলতা কামনা করি।

সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ২৮ বছর বয়সে প্রথম প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর পলিটিক্যাল সেক্রেটারি নিযুক্ত হয়েছিলাম। পরবর্তীতে ‘৭২ থেকে ‘৭৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ সহকারী ছিলাম। এর ২১ বছর পর ’৯৬ সালের ২৩ জুলাই শপথ নিয়ে ২৪ জুলাই সচিবালয়ে এসেছি। দীর্ঘ ৯ বছর আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগসহ মহাজোট বিপুলভাবে জয়ী হয়েছে। এরই মধ্যে তিনি বিশ্ববিখ্যাত, জননন্দিত, আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। এটি স্বাভাবিক যে নতুনদের জায়গা দিতে হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেই কাজটিই করেছেন।

সৈয়দ আশরাফের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের এই শুভক্ষণে সৈয়দ আশরাফ নেই, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। সৈয়দ আশরাফের জায়গা অন্য কাউকে দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, এখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আমরা একটি পরিবারের মতো ছিলাম।

বেশি পেয়ে আপ্লুত বিদায়ী শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত বিদায়ী অনুষ্ঠানে সদ্য বিদায়ী শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তার শেষ কর্মদিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতর ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেছেন, আমার যে কৃতিত্ব তা আপনাদের সবার। আমি যা নই, তার চেয়ে বেশি দায়িত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ কৃতিত্বের অধিকারী করেছেন। তিনি দায়িত্ব দিয়েছেন বলেই আমার এই কৃতিত্ব। তবে এই কৃতিত্ব সবার। আমি আমার দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি।  

নাহিদ বলেন, দীর্ঘ ১০ বছরে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষায় তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার সমপ্রসারণ করা হয়েছে। মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা আধুনিক করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছি। শিক্ষা পরিবারের সবার সহযোগিতায় আমরা একটি পর্যায়ে পৌঁছেছি। এটা সবার অবদান।

নাহিদ বলেন, নতুন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি একজন অভিজ্ঞ বিচক্ষণ মানুষ। শিক্ষা পরিবারের যে অগ্রগতি তা তিনি এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আপনারা সবাই তাকে সহযোগিতা করবেন। গত ১০ বছরের সফলতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করবেন।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আপনারা নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকবেন। যাতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়া সহজ হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অবদান তুলে ধরে নাহিদ বলেন, শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলে ও মেয়েদের ভর্তিতে সমতা এসেছে। এটি বড় অর্জন।

জনগণের পাশে থেকে কাজ করার বার্তা বিদায়ী নৌমন্ত্রী : নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিদায়ী সম্বর্ধনায় সদ্য বিদায়ী মন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, আমি বিদায় নিচ্ছি না, আছি। রাজনীতি যতক্ষণ করছি ততক্ষণ আমি মনে করি আজকে মন্ত্রী আছি কালকে থাকব না। জনগণের পাশে থাকব, তাদের জন্য কাজ করব।

নতুন মন্ত্রিসভাকে স্বাগত জানিয়ে শাজাহান খান বলেন, প্রধানমন্ত্রী যে কাজটি করেছেন সেটি অত্যন্ত সঠিক। নতুন নতুন অনেকে আজকে মন্ত্রিসভায় এসেছেন। আমরাতো সাতবার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি। জীবিত থাকা অব্দি হয়ত হবোও। যারা নতুন আসছেন, তাদের উদ্দীপনা-শক্তি কাজে লাগাতে প্রধানমন্ত্রী নিয়ে এসেছেন। তারা অত্যন্ত যোগ্য। এই মন্ত্রণলায়ের দায়িত্বে যিনি আসছেন তিনি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

 মন্ত্রী থাকাকালীন নৌমন্ত্রণলায়ের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে শাজাহান খান বলেন, বাংলাদেশের ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথের মধ্যে ২০ হাজার চারশ কিলোমিটার নৌপথ হারিয়ে গেছে। বিগত সরকারের সময় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩টি নৌপথ খনন শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৬শ কিলোমিটার নৌপথ উদ্ধার করা হয়েছে। প্রায় তিন হাজার একর জমি পুনঃউদ্ধার করা হয়েছে।

নতুনদের জায়গা করে দিতে হয়, এটাই নিয়ম: সদ্য বিদায়ী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের স্বাগত জানাই।

নতুনদের জন্য জায়গা করে দিতে হয়, এটাই নিয়ম। নতুন যে মন্ত্রী দায়িত্বে আসছেন, তিনি তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তিনি মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখবেন।

কর্মকর্তাদের উদ্দেশে কামরুল ইসলাম বলেন, বিগত পাঁচ বছর আমাকে যেভাবে সহায়তা করেছেন, নতুন মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারকেও আপনারা সেভাবে সহযোগিতা করবেন উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে।

সংসদ সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভিশন বাস্তবায়নে কাজ করে যাব :  সদ্য বিদায়ী গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে ভিশন রয়েছে তা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব শুধু মন্ত্রীদের নয়, সংসদ সদস্যেরও। আমি সংসদ সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভিশন বাস্তবায়নে কাজ করে যাবো। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের সহযোগিতা করবো।  এতে ভিশন বাস্তবায়ন দ্রুত হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই