দৃষ্টিজয়ীদের অভিভাবক নাজিয়া জাবীন

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ২০, ২০২১, ০৮:৫১ পিএম

ঢাকা : এমন কিছু মানুষ আমাদের দেশে আছেন যারা চুপচাপ, নিভৃতে মানবকল্যাণে নিজেদের পুরো অস্বিত্তকেই সঁপে দিচ্ছেন, ব্যক্তিসত্তাকে মানবতার সত্তায় রুপান্তরিত করেছেন। তেমনি এক প্রচারবিমুখ সমাজসেবী নাজিয়া জাবীন। আজ তিনি দেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে গেছেন দৃষ্টিজয়ীর মর্যাদায়। দীর্ঘ ১৩ বছরের এই পথচলায় এখন তিনি অনেকটাই আনন্দিত দৃষ্টিজয়ীদের জন্য কিছু একটা করতে পেরে। যদিও এ গুণী মনে করেন এখনো হয়নি কিছুই, যেতে হবে আরো অনেকটা পথ।

সাক্ষাৎকারে দৃষ্টিজয়ীদের বন্দনা করলেন তার সামগ্রিক কথাপোকথনে-

-আপনি একাধারে লেখক, একজন ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক। গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে সৃজনশীল ব্রেইল পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার ভাবনার সূচনাটা এলো কোথা থেকে।

নাজিয়া জাবীন : আমার লেখা প্রথম ছড়ার বইটা যখন প্রকাশিত হলো সেই অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের ভালোই সাড়া পাই। তাদের পাশাপাশি সে সময় অনেক দৃষ্টিজয়ী বন্ধুরা এসেছিলেন। সে সময় আমি ’প্রেরণা’ নামে দৃষ্টিজয়ীদের একটি সংগঠনে কাজ করতাম। একসময় দেখলাম, তারা অনেক চেষ্টা করেও বইটা তো পড়তে পারছে না, কিন্তু চরম আগ্রহে হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছেন। আবার কেউ কেউ বইয়ের গন্ধ নাকে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। উপায়ন্তর না দেখে কেউ কেউ দূরে গিয়ে আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে বইয়ের পৃষ্ঠা গুণছে। সম্পূর্ণই এক অন্যরকম হূদয়বিদারক দৃশ্য। আমি বুঝতে পারি তাদেরও ইচ্ছে জাগে বই পড়ার। এ দৃশ্য আমার ভেতরটাকে ধাক্কা দেয়, উপলব্ধি করি, তাদেরও পড়ার অধিকার আছে। সেই থেকে শুরু।

-তারপর এগুলেন কিভাবে?

নাজিয়া জাবীন : পরে চিন্তা করলাম উন্নত বিশ্বে দৃষ্টিজয়ীরা সাধারণ মানুষের মতোই পড়াশোনা করছে। বিদেশে দৃষ্টিজয়ীদের জন্য ব্রেইল ভার্সনের বই এবং ১টি অডিও সিডি থাকে । আমাদের দেশেও তো পুরনো ব্রেইল পদ্ধতি চালু আছে। তাহলে তো আমাদের দৃষ্টিজয়ী বন্ধুরাও সহজেই সৃজনশীল বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। যেই ভাবা সেই কাজ। চলে গেলাম টঙ্গী ব্রেইল প্রেসে । প্রেসটি ছিল সরকারি। গিয়ে দেখি বেহালদশা। বন্ধ থাকে বেশিরভাগই। পাশাপাশি এ বিষয়ে আর কোথায় কোথায় কী আছে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলাম। এভাবে চলে যায় ২০০৮ সাল। শেষ পর্যন্ত নিজেই উদ্যোগ গ্রহণ করি। ২০০৯ সালে আমার লেখা একটি ছড়ার বই ’ছড়ার তালে মনটা দোলে’ নামে একটা বই ব্রেইল পদ্ধতিতে বের করি।

-এ বইটি কি ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম বই?

নাজিয়া জাবীন : হ্যাঁ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশিত প্রথম শিশু সাহিত্যের বই। দেশে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনায় ব্রেইল পদ্ধতি ব্যবহার হয়ে আসলেও সৃজনশীল পড়াশুনা বা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ব্রেইল পদ্ধতিতে ছাপানো বই না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত হয়ে আসছিল দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীরা। আমার এই বই প্রথম এদেশে ব্রেইল পদ্ধতিতে সৃজনশীল শিশু সাহিত্যের বই হিসেবে প্রকাশ হয়।

-দৃষ্টিজয়ী বন্ধুর মর্মাথ্য কি?

নাজিয়া জাবীন : দৃষ্টিহীন বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বলে আমার কাছে কেউ নেই । আমরা তাদের এইভাবে বলে থাকি যা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। দৃষ্টিহীন বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নয়, ওরা দৃষ্টিজয়ী।  এমন তো নয় ওরা কিছু করতে পারছে না; বরং ওরা আমাদের থেকে আরো ভালো কিছু করার চেষ্টা করছে। যেখানে সুস্থ থেকে অনেকে আড্ডাবাজি, নেশা করে বিপথে পা বাড়াচ্ছে সেখানে দৃষ্টিজয়ীরা এগুচ্ছে সফলতার প্রত্যয়ে।

-ব্রেইল পদ্ধতিতে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশকের ভূমিকায় কোন সময় থেকে অবতীর্ণ হলেন?

নাজিয়া জাবীন : আমার বইটা যেসব দৃষ্টজয়ী বন্ধুদের দিয়েছিলাম, তাদের স্কুলে গিয়ে দেখলাম বইটার ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা উঁচু উঁচু অক্ষরগুলো সমান হয়ে গেছে। তারা বইটি পড়তে পারছে না। তখন ভাবলাম, তাহলে কী করা যায়? এরপরে আমারই লেখা ‘বিনির সাথে পুতুল বিয়ে’ বইটির ব্রেইল বের করলাম। একসময় মনে হলো তাদের পড়ার চাহিদা এতো বেড়ে গেছে শুধুমাত্র আমার লিখা বই দিয়ে তাদের তৃষ্ণা মেটানো সম্ভব না। তখন আমি ব্রেইল পদ্ধতিতে সাহিত্যের বই প্রকাশের জন্য বিভিন্ন প্রকাশকের কাছে গেলাম। সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল হক প্রথম এগিয়ে আসলেন। তিনি প্রায় সাতটি বই আমাকে দিলেন। বললেন, তুমি এগুলো ব্রেইল কর। আমি আছি তোমার সঙ্গে। এই সাতটি বই নিয়ে আমরা ২০১১ সালে বই মেলায় আসলাম। ভেবে দেখলাম, মানুষকে জানান দিতে হবে। যখন সাধারণ মানুষ জানবে, দৃষ্টিজয়ীরা পড়তে জানে কিন্তু তাদের বই নেই, তখন আমরা ব্রেইল পদ্ধতিতে সাহিত্য রচনার জন্য দাবি তুলতে পারব। একটা জোরালো আওয়াজ বের হবে। ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি আমাদের সহায়তা করলেন। আমরা একটি স্টল পেলাম। দেখা গেল প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। দৃষ্টিজয়ী বন্ধুদের ভিড় বাড়ছে। তারা গড়গড় করে পড়তে পারে। অথচ তাদের হাতে বই নেই। তখন আমাদের দুটি স্টল দেওয়া হলো। মানুষ এসে ভিড় করে। দৃষ্টিজয়ী বন্ধুদের পড়া শুনে। ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি আমাদের স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনীর সহায়তায় প্রথম ব্রেইল বইটি বের করলেন। বইটি হলো সৈয়দ শামসুল হকের ছোটদের জন্য লেখা বঙ্গবন্ধুর বীর গাঁথা। মেলা মঞ্চে এটার মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা এতে নতুন করে অনুপ্রাণিত হলাম।

-ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনায় কেমন খরচ পড়ে?

নাজিয়া জাবীন : যথেষ্ট ব্যয়বহুল। কারণ ব্রেইলে এক পৃষ্ঠা মানে সাধারণে তিন পৃষ্ঠা। প্রতিটি পাতা প্রিন্ট করতে সাত থেকে দশ টাকা খরচ হয়। তারপর স্পাইরাল বাইন্ডিং করতে হয়।

-দৃষ্টিজয়ীদের পরীক্ষায় কি ব্রেইল পদ্ধতি ছাড়া কি অন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতি নেই?

নাজিয়া জাবীন : দৃষ্টিজয়ী বন্ধুরা টেপ শোনে, ক্লাসে স্যারের লেকচার শোনে, লেকচার রেকর্ড করে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় তাদের পরীক্ষার সময়। পরীক্ষার হলে তাদের একজন হ্যান্ডরাইটারের দরকার হয়। কিন্তু হ্যান্ডরাইটার পাওয়া যায় না। হ্যান্ডরাইটারের সাহায্য ছাড়া পরীক্ষা দেওয়া যায় না। কারণ শিক্ষক তো আর ব্রেইল চেক করতে পারে না। এসব নিয়ে দৃষ্টিজয়ী বন্ধুদের প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষা কতটুকু মানসম্মত হয় তা ভাবার বিষয়।

- এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?

নাজিয়া জাবীন : আমার মনে হয়, ব্রেইল শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় মৌখিক পরীক্ষার নাম্বার বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। তাদের পুরো পরীক্ষাটা যদি মৌখিক পদ্ধতিতে করা যায় তাহলে আরো ভালো হয়।

- দৃষ্টিজয়ীদের পড়াশুনার ব্যাপারে অভিভাবকদের উৎসাহ কেমন?

নাজিয়া জাবীন : অভিভাবকদের উৎসাহ দৃষ্টিজয়ীদের থেকে আরো বেশি। প্রচুর। আমার কাছে মুমুর মা এসেছিলেন। মুমু যখন মাত্র তিন বছর বয়সী তখন খেলতে গিয়ে তার মাথায় টেলিভিশন পড়ে। সেই দুর্ঘটনায় মুমু দৃষ্টিশক্তি হারায়। তাকে নিয়ে তার বাবা মায়ের অনেক উৎসাহ। সে অন্য সবার মতো নিজের পায়ে দাঁড়াবে। সমাজে একজন হবে। শুধু মুমু নয়, মুমুর মতো অনেকেই আছে।

- দৃষ্টিজয়ী অভিভাবকদের আলাদাভাবে কাউন্সিলিং করার কোনো ব্যবস্থা আছে কি?

নাজিয়া জাবীন : না, বাংলাদেশে এমন অভিভাবকদের জন্য কোনো কাউন্সিলিং সেন্টার নেই। তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশে এমন অভিভাবকদের জন্য একটা কাউন্সিলিংয়ের জায়গা প্রয়োজন। মাঝে মাঝে অভিভাবকরা হাঁপিয়ে উঠেন, আবার কখনো হতাশা হয়ে পড়েন। কিন্তু তাদের জন্য কোনো তথ্যকেন্দ্র নেই। এটা খুব জরুরি ও দরকার।

- দৃষ্টজয়ী বন্ধুরা সাধারণত কী ধরনের বই খোঁজ করে?

নাজিয়া জাবীন : বাচ্চারা সাধারণত ভূতের বই, গোয়েন্দা কাহিনী, সায়েন্স ফিকশন পছন্দ করে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ছে তারা শুধু এ সবে খুশি না। তারা এখন বলে আপু, আপনি যদি ভালোবাসা দিবসে প্রেমের কবিতা পড়তে পারেন, আমরা কেন পারব না? আসলে তারা তাদের বয়স ও সময়োপযোগী বই প্রত্যাশা করে, যে বইটি পড়ে তারা আনন্দ পাবে, মজা পাবে।

-দৃষ্টিজয়ীদের আলোকিত করার প্রয়াসে আপনি ছিলেন। এখন তো আগের থেকে অনেক সচেতনতা বেড়েছে।

নাজিয়া জাবীন : এখন ওরা আর আগের মতো একা না। ওদের জন্য এখন অনেক সংগঠন এগিয়ে আসছে, অনেক বড় বড় মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি সরকারও এ বিষয়ে অনেক সজাগ হয়েছে। দৃষ্টিজয়ীদের আলোকিত করার জন্য যে উদ্যোগ আমি নিয়েছিলাম তা আজ ব্যপ্ত পরিসরে প্রকাশ পাচ্ছে। নিজেই নিজের মতো এগিয়ে চলেছি। আরো সবাই যদি এই ব্রেইল প্রকাশনায় এগিয়ে আসতো তাহলে দৃষ্টিজয়ীদের বইয়ের অভাব হতনা।

- আপনার প্রজেক্ট ‘জ্যোতি’ সম্পর্কে বলেন-

নাজিয়া জাবীন : ইতিমধ্যে স্পর্শের একটি প্রজেক্ট ‘জ্যোতি’ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মেয়েদের লেখাপড়ায় সহায়ক বৃত্তি নিয়ে কাজ করছে। অল্প কদিনের ব‍্যবধানে আমরা তিন গুণেরও বেশি জয়ীতাদের পাশে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি। এখন অনেকের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। করোনার কারণে এখন অনেকেই বেকার হয়ে গেছে। তাদের পরিবার চালানোই কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। বাচ্চাদের পড়াশোনা  দূরের কথা। এখন মোট ১৮ জনের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছি।  এখানে শুধূ দৃষ্টিজয়ীরাই এ সাহায্য পাচ্ছে না। পাচ্ছে জীবনজয়ীরাও। জীবনজয়ী বলতে বুঝিয়েছি কেউ কানে শুনে কম, কেউ আবার হাঁটতে পারেনা কিন্তু পড়াশোনা করেছে বন্ধ হয়ে গেছে এমন বাচ্চারাও আছেন। ১৮ জনকে ২ মাস ধরে সহায়তা করছি। এভাবে ১ বছর ধরে দেওয়া চেষ্ট করবো। এখন আরো অনেক বন্ধুরা জীবনজয়ী মানুষের পাশে থাকতে বাড়িয়ে দিয়েছেন হাত। যাঁরা পাশে আছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আর সামনে যারা থাকতে চান তাদের প্রতি একরাশ ভালোবাসা। আলোকিত হোক জীবন, আলোকিত হোক সমাজ। ‘জ্যোতি’ এগিয়ে যাক আপন গতিতে।

- ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা -

নাজিয়া জাবীন : প্রত্যাশা আর স্বপ্ন অনেক।  একটু একটু করে স্বপ্ন পূরণের পথে হেঁটে চলেছি। এই পথচলায় সবার দোয়া চাই। জীবনজয়ী যারা , জীবনটাকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার  জন্য যারা জীবনে যুদ্ধ করে চলেছেন তাদের অভাব পূরণের জন্য সমাজের সবাই যদি নিজেদের সাধ্যমতো এগিয়ে আসেন। তাদের জন্য চিন্তা করেন তাহলে জীবনজয়ীদের সব অভাব দূর হবে। সমাজের আমূল পরিবর্তন হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই