ঢাকা: নানান জটিলতায় ভোগছি দেশের শেয়ারবাজার। একদিকে টানা পতন অন্যদিকে নতুন বিনিয়োগ সম্ভাবনা ক্রমেই কমছে। গত এক বছর নতুন প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) আসা একেবারেই বন্ধ। বিএসইসিতে জমা নেই কোন আইপিওর ফাইলও।
গত ৫ বছরে দেশের পুঁজিবাজার থেকে উদ্যোক্তারা রেকর্ড পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করলেও সর্বশেষ এক বছরে এক টাকাও সংগ্রহ হয়নি। এতে একদিকে যেমন নতুন উদ্যোগ তৈরি বন্ধ রয়েছে অন্যদিকে বিনিয়োগের সুযোগ না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহের মাধ্যম হলো প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও। কিন্তু দেশের পুঁজিবাজারে সর্বশেষ এক বছরের বেশি সময় ধরে কোনো আইপিও অনুমোদন হয়নি। ফলে এই সময়ে বাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করতে পারেনি কোনো কোম্পানি।
ত্রুটিপূর্ণ আইপিও রুলস ও দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া, দীর্ঘ সময় অনিয়মের মাধ্যমে বাজে কোম্পানির আইপিও অনুমোদন, সহজ ব্যাংকঋণ প্রাপ্তি, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংস্কারপ্রক্রিয়া চলমান ও বর্তমান কমিশনের ওপর আস্থা না থাকায় আইপিও আবেদন আসছে না।
সর্বশেষ আইপিও অনুমোদন হয়েছে এক বছর আগে। ২০২৪ সালের ২৫ মার্চ বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে অর্থ সংগ্রহের জন্য আইপিও অনুমোদন পায় টেকনো ড্রাগস। আর ফিক্সড প্রাইস পদ্ধিতে সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর আইপিও পায় এনআরবি ব্যাংক। এরপর আর কোনো কোম্পানির আইপিও অনুমোদন হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম গণমাধ্যমে বলেন, ভালো কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান কমিশনের সদিচ্ছার অভাব নেই। বর্তমানে বিএসইসি চাপমুক্ত। প্রক্রিয়া মেনে ভালো কোম্পানির আবেদন এলে স্টক এক্সচেঞ্জের অবজারভেশন চেক করে বিএসইসি অনুমোদন দেবে। এছাড়াও আইপিও রুলস নিয়ে টাস্কফোর্স কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে, সেগুলোর ওপর পাবলিক ওপিনিয়ন চলছে।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম গত বছরের এপ্রিলে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আর কোনো আইপিও অনুমোদন দেননি।
আর ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিএসইসির দায়িত্ব নেওয়া খন্দকার রাশেদ মাকসুদের কমিশনও গত আট মাসে কোনো আইপিও অনুমোদন করেনি। তবে এই সময়ে ১৭টি কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল করা হয়েছে বলে বিএসইসি ও ইস্যু ম্যানেজার প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, এক বছর ধরে আইপিও অনুমোদন না হওয়ায় পুঁজিবাজারে স্বাভাবিকতা ব্যাহত হয়েছে। আমাদের আইপিও ছাড়া একটি শেয়ারবাজার হয়ে গেছে। নতুন আইপিও আসা ছাড়া শেয়ারবাজার কোনো শেয়ারবাজার নয়।
‘আইপিওর যে প্রক্রিয়া, সেটি যারা আইপিওতে আসতে চান, তাদের জন্য কমফোর্টেবল (স্বাচ্ছন্দ্য) নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত সমস্যা কোথায়, সেটা বের করা এবং দ্রুত সমাধান করা।’
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রির সুযোগ পায়। এতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ে, নতুন বিনিয়োগ প্রবাহিত হয় এবং কোম্পানিগুলোর মূলধন সংগ্রহ সহজ হয়। ফলে অর্থনীতিতে গতি আসে, কর্মসংস্থান বাড়ে এবং পুঁজিবাজারের গভীরতা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পুঁজিবাজার সংস্কারে গঠিত ফোকাস গ্রুপের সদস্য আশেকুর রহমান বলেন, পুঁজি সংগ্রহ করার জন্যই পুঁজিবাজার। পুঁজি সংগ্রহ করা না গেলে বুঝতে হবে পুঁজিবাজার ব্যর্থ, বাজারের ফাংশনগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ২০২০ ও ২০২১ সালে পুঁজিবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হয়। তবে ২০২২ সালে আইপিওর সংখ্যা কমে আসে। ২০২৩ সালে আইপিওতে রীতিমতো ধস নামে, যা অব্যাহত থাকে ২০২৪ সালেও। তবে রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব গ্রহণের পর সেটা শূন্যতে নেমে এসেছে।
তথ্যমতে, গত ১৬ বছরের মধ্যে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে পুঁজিবাজারে সবচেয়ে কম আইপিও এসেছে। এর মধ্যে শেষ আট মাসে কোনো কোম্পানির আইপিও আসেনি। ২০২৪ সালে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করা চার কোম্পানির মধ্যে রয়েছে এনআরবি ব্যাংক, বেস্ট হোল্ডিং, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ ও টেকনো ড্রাগস। চারটি কোম্পানি আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে ৬৪৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে।
২০২৩ সালে মিডল্যান্ড ব্যাংক, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, শিকদার ইনস্যুরেন্স ও ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড আইপিওতে আসে। চারটি প্রতিষ্ঠান ২০২ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। তার আগে ২০২২ সালে ছয়টি প্রতিষ্ঠান আইপিওর মাধ্যমে ৬২৬ কোটি ২৬ লাখ, ২০২১ সালে ১৫টি প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ৮৫৮ কোটি ৪৪ লাখ ও ২০২০ সালে ৮টি প্রতিষ্ঠান ৯৮৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা উত্তোলন করে।
আইপিও আবেদনে সব সময় ব্যাপক আগ্রহ দেখান দেশের বিনিয়োগকারীরা। তথ্যমতে, টেকনো ড্রাগসের আইপিওতে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার রেকর্ড আবেদন জমা পড়ে, যা কোম্পানিটির শেয়ার বরাদ্দের তুলনায় প্রায় ২৫ গুণ বেশি। এর আগে বেস্ট হোল্ডিংসের আইপিওতে ৩৫০ কোটি টাকার শেয়ারের বিপরীতে ১ হাজার ৩২১ কোটি ২১ লাখ টাকার বেশি আবেদন পড়ে। অর্থাৎ একটি শেয়ারের বিপরীতে ৩ দশমিক ৭৭ গুণ আবেদন পড়ে।
বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দেশের পুঁজিবাজারে আইপিও না আসার কারণ জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, আইপিও কম আসার অন্যতম কারণ হলো, আইপিও প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা ও ব্যাংকঋণ সহজলভ্য হওয়া। তা ছাড়া তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে পলিসিগত কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো দূর করতে হবে।
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে কোনো প্রণোদনা নেই। তাহলে ভালো কোম্পানি আসবে কেন? এটা নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে।
এআর