• ঢাকা
  • সোমবার, ২৪ মার্চ, ২০২৫, ১০ চৈত্র ১৪৩০

আন্দোলনে এবার মাঠে নেমেছেন শিক্ষকরা


নিজস্ব প্রতিবেদক আগস্ট ১, ২০২৪, ০১:৫৪ পিএম
আন্দোলনে এবার মাঠে নেমেছেন শিক্ষকরা

ঢাকা : কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সারা দেশে ‘ছাত্র হত্যা, গুলি ও হামলার’ প্রতিবাদে নতুন নতুন কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে এবার মাঠে নেমেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কেন গুলি চালানো হলো, কর্মসূচি থেকে সে প্রশ্ন তুলেছেন তারা। একই সঙ্গে আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তি ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন শিক্ষকরা।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে ১৫০ জন। আহত হয়েছে আরও কয়েক হাজার মানুষ। এ ছাড়া আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আন্দোলনের শুরু থেকে শিক্ষকদের পাশে না পেয়ে এক ধরনের হতাশা ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তবে আন্দোলন কেন্দ্র করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও হতাহতের ঘটনা বাড়লে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষকদের একটি অংশ তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। শুরুতে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক, ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব) ও সাদা দল। এরপর থেকে শিক্ষকরা ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক’-এর ব্যানারে নানা কর্মসূচি পালন করছেন।

‘মার্চ ফর জাস্টিসে’ শিক্ষকরা : ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ডাকা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে গতকাল অংশগ্রহণ করে সংহতি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল ও বামপন্থি শিক্ষকরা।

কর্মসূচিতে যোগদান করতে এসে পুলিশের হাতে আটক হওয়া থেকে শিক্ষার্থীকে বাঁচাতে গিয়ে পুলিশের ধাক্কায় পড়ে আহত হয়েছেন ঢাবির লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রভাষক শেহরীন আমিন ভূঁইয়া।

বুধবার (৩১ জুলাই) দুপুর ১টার দিকে হাইকোর্টের অদূরে কার্জন হলের বিপরীত পাশের শিশু একাডেমির সড়কে এ ঘটনা ঘটে। তিনি বর্তমানে চিকিৎসাধীন বলে জানা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর ১টার দিকে শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি কলেজের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে হাইকোর্ট মোড়ের দিকে আসার সময় একজনকে আটক করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধ্বস্তাধস্তি হয়।

এ সময় ঢাবির লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নুসরাত জাহান চৌধুরী এবং প্রভাষক শেহরীন আমিন ভূঁইয়া বাধা দেন। একপর্যায়ে পুলিশের ধাক্কায় শেহরীন মাটিতে পড়ে যান।

কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সরব ছিলেন জাবির শিক্ষার্থীরা। শুরু থেকেই তাদের এ আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানান বেশ কয়েকজন শিক্ষক। আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে ‘শিক্ষার্থীদের হত্যা, নিপীড়ন, গ্রেপ্তার, আটক ও হয়রানির’ চিত্র প্রকাশ হতে থাকলে একত্রিত হতে থাকেন শিক্ষকদের বড় একটি অংশ। প্রতিবাদে মৌন মিছিল, নীরবতা পালন ও প্রতিবাদ সভায় অংশ নেন তারা। বিভিন্ন ঘটনায় আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচিতেও তারা অংশ নেন।

বুধবার (৩১ জুলাই)  আন্দোলনকারীদের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে জাবির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী বলেন, ‘আন্দোলন এখন আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নেই। এটি শিক্ষক-শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলন হয়ে গেছে। একটি রাষ্ট্র যখন সংকটে পতিত হয়, একটি রাষ্ট্রের যখন আমূল পরিবর্তনের দরকার হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’

বুধবার (৩১ জুলাই) রাজধানীতে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) সামনে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি অংশ নেন বিশিষ্ট গবেষক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান।

তিনি বলেছেন, ‘বর্তমানে যেটা দরকার, সেটা হলো রাজনৈতিক সমাধান। রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হলো বর্তমান সরকারকে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে পদত্যাগ করতে হবে। সরকারের পদত্যাগ ছাড়া নতুন কোনোরকমের ব্যবস্থায় আমরা যেতে পারব না।’

কোটা আন্দোলনে ‘রাষ্ট্রীয় মদদে হত্যাকাণ্ড’ ঘটেছে দাবি করে এ অধ্যাপক বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয় মদদে হয়েছে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহযোগীদের দ্বারা হয়েছে। যাদের আমরা বলতে পারি, প্রাইভেট বাহিনী। এর বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের জন্য অবশ্যই বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক তদন্ত দরকার। আমরা নিহত, আহত, গুম হওয়া এবং নির্যাতিত জাতীয় জনগণের পক্ষ থেকে সেই দাবিতে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাই।’

এদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষকরা। গতকাল ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাজ’ ও ‘ নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক ঐক্য’র ব্যানারে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন তারা। এতে বিভিন্ন বিভাগের অর্ধশতাধিক শিক্ষক অংশ নেন।

চবির নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোশরেকা অদিতি হক বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবি ন্যায্য, কিন্তু তাদের ওপর ধরপাকড় শুরু করা হয়েছে। ক্ষমতার উন্মাদনার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অভিভাবক হিসেবে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য শিক্ষকদের দায় আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে হয়, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে হয়, সেটা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমরা শিক্ষকরা এখন শিখছি। তবে বর্তমানে কোটা সংস্কার আন্দোলন মূলত বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছে।’

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাঠে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) একাধিক শিক্ষক। প্রথমে হাতেগোনা কয়েকজন থাকলেও তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ঘরানার শিক্ষক, বিএনপিপন্থি শিক্ষক এবং সর্বশেষ শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরাও।

রাবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ‘আমি যে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছি এটার কারণ কোটা নয়। কারণ হচ্ছে আমি সুবিচারে বিশ্বাস করি এবং ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করি। আজকে তারা (শিক্ষার্থীরা) কোটা নিয়ে কথা বলছে সেটা যৌক্তিক, সুবিচারের পক্ষে এবং ন্যায়সংগত। শুধু এ কারণেই তারা আমার মানসিক সাপোর্ট পাবে। কারণ তারা ঠিক কথাটা বলছে। এটা কোটা না হয়ে যদি অন্য কোনো বিষয়ও হতো এবং সেটা যদি ন্যায্য হতো তাহলে ঠিক একইভাবে আমি তাদের পাশে থাকতাম। এটাও সত্য যে, আমি যদি কখনো মনে করি তাদের দাবিদাওয়ার ভেতরে এমন কিছু আছে, যা ন্যায়বিচার এবং সুবিচারের পরিপন্থী, তাহলে আমি মোটেও তাদের সঙ্গে থাকব না।’

তবে মাঠে না নামলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব ভূমিকা পালন করছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষকদের একটি অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক আহসানুল হক ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘একজন শিক্ষক হিসেবে আমি লজ্জিত। যাদের গড়ার কারিগর আমরা, চোখের সামনে তাদের এ অবস্থা দেখছি। এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু নেই আমার কাছে।’

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তারেক মাহমুদ আবির বলেন, ‘এ আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন মূল ইস্যু ছিল কোটা সংস্কার। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি কোটা সংস্কার নিয়ে আমরা প্রথম থেকেই সরব ছিলাম। আমরাই প্রথম প্রতিবাদলিপি দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছি। তাদের সে দাবি পূরণ হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে। কিন্তু এখন এ আন্দোলন কীসের? আমরা কোনো প্রসিডিওর নিয়ে এগোব। ঢাবি, জাবি অনেক পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের অনেক পার্ট আছে। তবে হ্যাঁ, আমরা যেটা করতে পারি সেটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে। কিন্তু কোনো ফরমাল উপায়ে আমরা যেতে পারি না।’

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!