• ঢাকা
  • বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
বিশ্ব কিডনি দিবস

আজ ঘরে ঘরে বাড়ছে কিডনি রোগী


বিশেষ প্রতিবেদক মার্চ ৯, ২০২৩, ১১:৪৩ এএম
আজ ঘরে ঘরে বাড়ছে কিডনি রোগী

ঢাকা : ১৫ দিন পর পর একবার ডায়ালাইসিস করতে হয় পারভীন আক্তারের। আর সপ্তাহে দুবার ডায়ালাইসিস করাতে হয় পারভীনের স্বামী কাজী রফিকুল ইসলামের। দুজনের দুটি কিডনির একটিও পুরোপুরি সুস্থ নেই। দুজনই প্রায় একই রকমভাবে জানতে পারেন তারা কিডনি জটিলতায় ভুগছেন। দুজনেরই মাঝে মাঝে কাশি হতো। সঙ্গে জ্বরও আসতো। তারা নিয়মিত একজন চিকিৎসকের কাছে যেতেন। সেই চিকিৎসক ওষুধ দিলে তা খেয়েই ভালো হয়ে যেতেন। পরে তারা খেয়াল করলেন- মাঝেমধ্যে তাদের পা ফুলে যেতো। তখন তারা বিষয়টি গুরুত্ব দেন।

পরে আরেক চিকিৎসকের কাছে গেলে রক্ত পরীক্ষা দেন। সেই রক্তের রিপোর্টে একটা জিনিস বেশি দেখে চিকিৎসক জানান, তারা কিডনি রোগে আক্রান্ত। অথচ তাদের মধ্যে এ রোগের তেমন কোনো লক্ষণ ছিল না। তারা হঠাৎ জানতে পারেন তাদের দুটি কিডনিই নষ্ট। এখন ডায়ালাইসিস ও ওষুধের ওপর বেঁচে রয়েছেন তারা। যার খরচ মেটাতে মেটাতে তিন সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েছে এই দম্পতি। এরকম গল্প দেশের বেশিরভাগ কিডনি রোগীর সঙ্গেই মিলে যাবে। শুধু পারভীন বা রফিক নয়, তাদের মতো যারা কিডনি জটিলতায় ভুগছেন তাদের অনেকেই এ রকম হঠাৎ করেই জানতে পারেন নিজেদের কিডনি সমস্যার কথা। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে সব পরিবারেই একই করুণ দশা।

জানা গেছে, ২০১২ সালে থেকে ২০২২ সালে অর্থাৎ গত এক দশকে বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনে কিডনি রোগী বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। ২০১২ সালে এ হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৯৭৫ জন। আর ২০২২ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৬৭১ জন। বেড়েছে ডায়ালাইসিস নেওয়া রোগীর সংখ্যাও। ২০১২ সালে ডায়ালাইসিস নেওয়া রোগী ছিল ২২ হাজার আর ২০২২ সালে হয়েছে ৬৭ হাজার ৬২০ জন।

কিডনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৮০ শতাংশ বিকল না হওয়া পর্যন্ত কিডনি রোগের কোনো উপসর্গ থাকে না। এতে বেশিরভাগ রোগী চিকিৎসার জন্য আসছেন শেষ সময়ে। যখন তাদের প্রয়োজন হচ্ছে ডায়ালাইসিস ও কিডনি প্রতিস্থাপন। কিন্তু এ চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে না পেরে চিকিৎসার বাইরে থাকছেন ৮০ শতাংশ রোগী। তাদের মধ্যে প্রতিবছর মৃত্যু হচ্ছে ১০ হাজারের বেশি মানুষের।

তারা বলছেন, কিডনি রোগের ভয়াবহতা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। এছাড়া রয়েছে লোকবল সংকট ও যন্ত্রপাতির সমস্যা। কাজেই এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে।

এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্ব কিডনি দিবস পালন হবে। প্রতি বছর মার্চের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার এ দিবসটি পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সুস্থ কিডনি সবার জন্য, অপ্রত্যাশিত দুর্যোগের প্রস্তুতি, প্রয়োজন ঝুঁকিপূর্ণদের সহায়তা।’

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন জানায়, বিশ্বের প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। আর বিশ্বে প্রতি ১০ জন মানুষের মধ্যে ১ জন ক্রনিক কিডস বা দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে ভুগছেন। তবে বয়স্কদের মধ্যে এই হার আরও বেশি। যাদের বয়স ৬৫ থেকে ৭৫ বছর তাদের মধ্যে প্রতি ৫ জনে ১ জন পুরুষ ও প্রতি ৪ জনে ১ জন নারী কিডনি রোগে ভুগছেন। আর যাদের বয়স ৭৫ বছর বা তদূর্ধ্বে তাদের অর্ধেক সংখ্যক মানুষ কিডনি রোগে ভুগছেন।

ইউনাইটেড স্টেট রেনাল ডাটা সিস্টেমের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ২০২০ সালে রোগীর সংখ্যা ছিল প্রতি মিলিয়নে ১০৯ জন। ২০১০-২০২০ এই ১০ বছরে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে দেশে ১০ হাজার ৮৪১ জন মানুষ কিডনি রোগে মৃত্যুবরণ করেছেন।

গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের কিনডি ডায়ালাইসিস সেন্টারের চিকিৎসক মাহবুব উল্লাহ খন্দকার বলেন, কিডনি মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যার প্রধান কাজ রক্ত পরিশোধন করা এবং উৎপাদিত বর্জ্য মূত্রাকারে শরীর থেকে বের করে দেওয়া। তবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, শরীরে লবণ ও পানির ভারসাম্য রক্ষা এবং রক্ত উৎপাদনে কিডনির প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ বা ক্রনিক কিডনি ডিজিজের অনেক কারণ রয়েছে। তবে কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক দিন পর্যন্ত উপসর্গবিহীন থাকতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্য বলছে, গত বছরে এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখ ৬৩ হাজার ৯৫ জন। এর মধ্যে ৯৭ হাজার ৮৫৭ জন নতুন রোগী। পুরাতন ৬৫ হাজার ২৩৮ জন। অর্থাৎ প্রায় ৬০ শতাংশ নতুন রোগী। এর আগের বছর ২০২১ চিকিৎসা নিয়েছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ১২২ জন। এর আগের বছর ২০২০ সালে চিকিৎসা নিয়েছে ৯৭ হাজার ৮৮৪ জন। বেড়েছে ডায়ালাইসিস নেওয়া রোগীর সংখ্যাও। ২০১৭-২০১৮ সালে এখানে ডায়ালসিস নেওয়া রোগী ছিল দেড় হাজারের কম। ২০২২ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৭৪৮ জনে। একই চিত্র দেখা গেছে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে। ২০১৭ সালে এখানে কিডনি রোগী ছিল ৯৫৫ জন। ২০২২ সালে এসে হয়েছে ২০৮৫ জন। আগে ডায়ালাইসিস নেওয়া রোগী ছিল ১২ হাজার, বর্তমানে ১ লাখ ১২ হাজার ৭৮৮ জন।

কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর নতুন করে ৪০ হাজার রোগীর ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হচ্ছে। এর মধ্যে ডায়ালসিস নিচ্ছেন ১০ হাজার রোগী। বাকিরা অর্থের অভাবে ডায়ালাইসিস দিতে পারছেন না।

তিনি বলেন, আমার ২৫ শতাংশ রোগীকে ডায়ালাইসিস দিতে পারি। সব মিলিয়ে ডায়ালাইসিস করছেন ১৮ হাজার ৯০০ রোগী। এর মধ্যে নতুন ১০ হাজার, পুরনো ৮ হাজার ৯০০ রোগী। ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ ডায়ালাইসিস করার আওতার বাইরে থাকে। বর্তমানে ৩০০টির বেশি হিমোডায়ালসিস সেন্টার রয়েছে। এসব সেন্টারে ১০০০ থেকে ১২০০ হিমোডায়ালাইসিস মেশিন আছে।

দেশে এখন পর্যন্ত মোট দুই হাজারের মতো কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। গত ১০ বছরে কিডনি প্রতিস্থাপন হতো বছরে ১০০টির কম। বর্তমানে করা হচ্ছে ২১০ থেকে ২১৫টা।

সংশ্লিষ্টরা সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে নেফ্রলজিস্টের সংখ্যা রয়েছে ৩০০ জন অর্থাৎ প্রায় ১২ থেকে ১৫ লাখের লোকের জন্য একজন নেফ্রলজিস্ট রয়েছে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপন প্রোগ্রাম রান করার জন্য ডেডিকেটেড ইউনিট থাকা দরকার। আমরা এখনও পর্যন্ত এটি তৈরি করতে পারিনি। এছাড়া ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জারির ক্ষেত্রেও সেটি হচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের বেশিরভাগেরই নিম্নবিত্ত। দেখা যায়, অনেক সময় ডোনার আছে কিন্তু ট্রান্সপ্ল্যান্ট পরবর্তী মেডিসিনের যে অর্থ ব্যয় হয় সেটি অনেক রোগীর থাকে না। আর যারা উচ্চবিত্ত তারা সরকারি হাসপাতালে আগ্রহী হয়। তারা চলে যান দেশের বাইরে। এছাড়া কিডনি দাতারও সংকট রয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!