ঢাকা: কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ-সংঘাতে নিহত প্রায় ৭৮ শতাংশ মানুষের শরীরে প্রাণঘাতী গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। বেশির ভাগের গুলি লেগেছে মাথা, বুক, পিঠ ও পেটে।
সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ২১২ জন নিহত হওয়ার তথ্য পেয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় এক গণমাধ্যম। এর মধ্যে ১৭৫ জনের মৃত্যুর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৩৭ জনের শরীরে প্রাণঘাতী গুলি ও ২২ জনের শরীরে ছররা গুলির চিহ্ন ছিল।
অন্যদের মধ্যে ১০ জনের শরীরে ছিল মারধর ও আঘাতের চিহ্ন। চারজনের মৃত্যু হয়েছে গাড়ি ও স্থাপনায় দেওয়া আগুনে পুড়ে। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দুজনের।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেশির ভাগের গুলির চিহ্ন একটি। কারও কারও ক্ষেত্রে দুটি চিহ্নও দেখেছেন স্বজনেরা। বিক্ষোভে যেমন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তেমনি নিহত ব্যক্তিদের কেউ কেউ নিজের বাসার ভেতরে, বারান্দায় ও ছাদে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
এই গণমাধ্যমের পর্যালোচনায় আসা ১৭৫ জন নিহতের মধ্যে ২২ জন শিশু ও কিশোর। ১৮ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে ১০৩ জন। ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সী ২৭ জন। ৪০ বা এর বেশি বয়স ২০ জনের। তিনজনের বয়স জানা যায়নি।
১৭৫ জনের মধ্যে শিক্ষার্থী ৪৬ জন। একটি তিন বছরের শিশু। দোকান, হোটেল, বিক্রয়কেন্দ্র ইত্যাদির কর্মী ২৮ জন। দোকানমালিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হকার ১৬ জন, দিনমজুর ও সমজাতীয় পেশার ১৪ জন। কার, ট্রাক, রিকশা-ভ্যানচালক ও চালকের সহকারী ১৩ জন। পোশাক কারখানার শ্রমিক ও কর্মী ৭ জন, কৃষক ১ জন এবং চাকরিজীবী ও অন্যান্য পেশার ২৩ জন। পুলিশ ও আনসার সদস্য ৪ জন এবং সাংবাদিক ৪ জন। বাকি ১৮ জনের পেশা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
নিহতদের ১৭৫ জনের মধ্যে সরাসরি রাজনৈতিক-সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ছয়জনের। তাদের একজন ছাত্রলীগ, একজন মৎস্যজীবী লীগ, একজন যুবলীগ; একজন যুবদল ও একজন ছাত্রদল এবং একজন শিবিরকর্মী। উল্লেখ্য, তাদের মধ্যে কেউ শিক্ষার্থী, কেউ ব্যবসায়ী। সেই তালিকায় এদের ধরা হয়েছে।
আঘাতের ধরন পাওয়া গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নথি পর্যালোচনা এবং ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের ১১টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যে।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে ১৬, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ জুলাই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে (১৭ জুলাই কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি)। এরপর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনেকের মৃত্যু হয়। এ সংঘর্ষকালে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে।
অবশ্য ঢাকায় নিহতের ঘটনাগুলোয় পুলিশ বাদী হয়ে যেসব মামলা করছে, তাতে বিক্ষোভকালে সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতকারীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিএনপি, জামায়াতসহ বহু অনুপ্রবেশকারী ও দুষ্কৃতকারী ঢুকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে। তাদের গুলিতেই অনেকে মারা গেছেন। তিনি বলেন, প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে মামলার এজাহার হয়। তদন্তে কারা গুলি করেছিল, তা বেরিয়ে আসবে। খুনের দায়ে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
যদিও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২৫ জুলাই এক বিবৃতিতে বলেছে, বিক্ষোভ দমনে আইনবহির্ভূতভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশে সহিংসতার তিনটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে তারা এর প্রমাণ পেয়েছে।
এ ছাড়া ৩০ জুলাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে এক খোলাচিঠিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড লিখেছেন, ‘আমরা দেখতে পেয়েছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলির বেআইনি ব্যবহার, শিক্ষার্থীরা আবদ্ধ স্থানে থাকা অবস্থায় সেখানে কাঁদানে গ্যাসের বিপজ্জনক ব্যবহার এবং এ কে (কালাশনিকভ) ঘরানার অ্যাসল্ট রাইফেলের মতো প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্রের নির্বিঘ্ন ব্যবহার করেছে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সাধারণত গরম পানি, ঠান্ডা পানি, রঙিন পানি, লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং রাবার বুলেট ব্যবহার করে। প্রয়োজনে বন্দুক ব্যবহার করে গুলিও করে।
বন্দুক ও রাইফেলের গুলির পার্থক্য আছে। বন্দুকের গুলির পাল্লা কম, অর্থাৎ বেশি দূর গিয়ে আঘাত করতে পারে না। কার্তুজের ভেতরে ছোট ছোট বল থাকে। এগুলোকে ছররা গুলি বলা হয়। বিক্ষোভ দমনে ব্যবহার করা কম ক্ষমতার শটগানের গুলি কাছ থেকে না লাগলে সাধারণত মানুষের মৃত্যু হয় না। রাইফেলের গুলি বা বুলেট দূরে গিয়েও মানুষের মৃত্যু ঘটায়। এটা প্রাণঘাতী, তাই নিরস্ত্র মানুষের বিক্ষোভ দমনে ব্যবহার করা হয় না।
১৭৫ জনের মৃত্যুর বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০৬ জনই ঢাকায় নিহত হয়েছেন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে উত্তরা, মিরপুর, কদমতলী, কাফরুল, বাড্ডা, ভাটারা, রামপুরা, বনশ্রী, নিউমার্কেট, গ্রিন রোড, আজিমপুর, সায়েন্স ল্যাব, মোহাম্মদপুর, পল্টন, গোলাপবাগ, হাতিরঝিল, গোপীবাগ ও সূত্রাপুরে মানুষ নিহত হয়েছেন। রাজধানীর বাইরে নারায়ণগঞ্জ (১৭), নরসিংদী (১৬), সাভার (৮), চট্টগ্রাম (৬), গাজীপুর (৫), রংপুর (৫), ময়মনসিংহ (৪), মাদারীপুর (৩), সিলেট (২), টাঙ্গাইল (১), চাঁদপুর (১) ও বগুড়ায় (১) নিহতের ঘটনা ঘটেছে।
এআর
আপনার মতামত লিখুন :