• ঢাকা
  • শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
শিক্ষাচিন্তা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি ধ্বংস ডেকে আনবে  


মাছুম বিল্লাহ      এপ্রিল ২৬, ২০২১, ০৭:৪১ পিএম
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি ধ্বংস ডেকে আনবে  

ঢাকা : বিজ্ঞানের এক চরম উন্নতির যুগে আমরা বাস করছি। আমাদের জীবনকে সহজ, আরামদায়ক এবং শান্তিময় করার জন্য আবিষ্কার করছি বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, ডিভাইস। যেগুলো আগে আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলোর আরো উৎকর্ষ সাধনের জন্য চলছে অবিরাম গবেষণা ও প্রচেষ্টা। এসব করে আমরা কোনো কোনো সময় নিজেদের তৈরি যন্ত্রপাতির কাছে আমাদের প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তাকে হার মানাচ্ছি। ইদানীংকালে কয়েকটি বহুল আলোচিত বিষয়ের মধ্যে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ কিংবা আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের কথা শুনতে পাচ্ছি চারদিকে। বিষয়টি যদিও কম্পিউটারের সাথে সম্পর্কিত, তারপরেও মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ কী মানুষের চিন্তাধারাকে, মানুষের কাজকে প্রতিস্থাপন করবে? কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে খুবই চিন্তিত কারণ তা হলে অফিসে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, ব্যাংকে, ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে সর্বত্রই মানুষের স্থান ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ দিয়ে তৈরি যন্ত্রপাতি দখল করবে। মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি চায় কম লোকবল খাটিয়ে বেশি লাভ, বেশি পুঁজির কিছু করতে। বিশ পঞ্চাশ কিংবা একশ বা হাজার হাজার মানুষের কাজ একটি মেশিন যেহেতু করতে পারে, কাজেই হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাওয়ার কথা। বিষয়টি কী তা-ই হতে যাচ্ছে?

আবার কেউ কেউ বলছেন ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তার তেমন কিছু নেই। মানুষ তার প্রয়োজন, উপকার এবং সুবিধার জন্যই ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ ব্যবহার করবে। সেটি কোনক্রমেই মানুষের বুদ্ধিকে ছাড়িয়ে যাবে না। মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকবেই। কম্পিউটার মানুষের সৃষ্টি, মানুষের বুদ্ধি খাটিয়ে তৈরি করা হয়েছে কিন্তু তা মানুষের চেয়ে দ্রুতগতিতে এবং নির্ভুলভাবে কোনো হিসাব দ্রুততম সময়ে বের করে দেয়। একইভাবে ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা হবে, মানুষের বিরুদ্ধে যাবে না। আবার কেউ কেউ বলেছেন, বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র, ডিনামাইট মানববুদ্ধি খাটিয়ে তৈরি করা হয়েছে, সেটি মানুষ ব্যবহার করছে নিয়ন্ত্রণে রেখে; কিন্তু সামান্য কারণে মানুষ বিগড়ে গেলে, বা মানুষ ভুল করলে যন্ত্র বিগড়ে যায়, কিংবা মানুষ  রাগান্বিত হলে সেটি ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ধবংস করার জন্য, নিশ্চিহ্ন করার জন্য যেখানে কোনো ধরনের মানবতা পরিলক্ষিত হয় না। ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সে’র ক্ষেত্রেও কী সেরকম হবে; না আরো ভয়ংকর কিছু হবে বিষয়টি মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ মানবসভ্যতার ধবংস ডেকে আনবে না তো?

এ বিশ্বের সবকিছুই মানুষের জন্য। মানুষই সৃষ্টি করেছে সমাজ, সভ্যতা, বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানে সাধন করেছে চরম উৎকর্ষ। আজ মানুষের বুদ্ধি যদি সেই মানুষকেই অপ্রয়োজনীয় করে ফেলে তাহলে সেই ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধিমত্তা সবকিছুতে ব্যবহার করা কতটা যুক্তিযুক্ত বা যুক্তিসঙ্গত সেটি গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। টেস্টটিউব বাচ্চা বিষয়টি কোনো সমাজই সেভাবে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসেনি, কারণ ওই পদ্ধতিতে সন্তান নিলে মানবসভ্যতায় ধস নামতে পারে। গোটা মানবসমাজে দেখা দিতে পারে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া। তাই এটিকে লালন করা কিংবা জনপ্রিয় করা হয়নি। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সেটিকে উৎসাহ প্রদান করা হয়নি বরং পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বলা হয়েছে এবং শুধু যেসব দম্পতি বাচ্চা উৎপাদনে একেবারেই অক্ষম, কেবল তাদের জন্য বিষয়টি ব্যবহার করা যেতে পারে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যাপারটির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য হবে।

ভবেশ রায়ের সায়েন্স ফিকশন ‘মহাকাশ ও একটি মানবশিশু’র অন্তর্গত ‘কারাগার গৃহ’ নামক সায়েন্স ফিকশনে আমরা দেখতে পাই নবনীতা সেনগুপ্তা ছয় কুঠুরির একটি ফ্ল্যাটে বাস করেন যা মাটির নিচে। ঘরটি চারদিক দিয়ে আটকানো, কোনো দরজা জানালা নেই। তার সব কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হয় তার ফ্ল্যাটে সেট করা বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি দ্বারা। তার ছেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে পড়াশোনা করেন অথচ সেই ছেলেই তার মায়ের এমন চরম যান্ত্রিক জীবন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন : ‘আমি তোমাকে যন্ত্রের মধ্য দিয়ে দেখতে চাই না। সরাসরি দেখতে চাই’। টিটো তেমনি বিষণ্নভাবেই বলতে লাগল। ‘মা! আমি তোমার সঙ্গে কোনো তার বা বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে কথা বলতে চাই না। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কথা বলতে আমার ভালো লাগে না।’

‘কী বাজে বকছ তুমি?’ ছেলের কথায় নবনীতা সেনগুপ্তা যেন প্রচণ্ড ধাক্কা খেলেন। দুঃখও পেলেন। বিরক্ত হলেন এমন ছেলেমানুষী দেখে। বলতে লাগলেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলতে পার না। এসবই বিজ্ঞানের অবদান। আমরা তার সুফল ভোগ করছি। যান্ত্রিক সভ্যতার সুফল।’

— কিন্তু মেশিনের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারব না কেন?

— কারণ একা কারো পক্ষে তা সম্ভব নয়। উচিতও নয়।

— মা, তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন এই মেশিনগুলোকে স্বয়ং ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন।

কথাগুলো বলতে বলতে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে টিটো নিজেও প্রচণ্ডভাবে প্রতিবাদ করে উঠল, ‘যখন তোমার মন খারাপ হয়ে, মনে কষ্ট হয় তখন কি তুমি ঈশ্বরকে ছেড়ে মেশিনগুলোকে পূজা করো? ওদের কাছেই আশীর্বাদ প্রার্থনা করো? ভুলে যেও না, এই মেশিনগুলোকে তৈরি করেছে মানুষ। ঈশ্বর নন। মানুষ শক্তিশালী, বুদ্ধিমান এবং মহানও বটে। কিন্তু তবু তারা মানুষ-ই, ঈশ্বর নন। যন্ত্র হয়তো অনেক কিছু করতে পারে, কিন্তু সবকিছু পারে না। এই যে, আমার ভিডিও স্ক্রিনে আমি এই মুহূর্তে তোমার মুখের ছবি দেখছি, এটা কি সত্যি তুমি? এটা তো তুমি নও। তোমার ছবি বা প্রতিকৃতি মাত্র। আমি ফোনে তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু আমি সত্যিকার অর্থে তোমার গলা শুনছি না। যান্ত্রিক গতির মধ্য দিয়ে তোমার কৃত্রিম কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি।’

আমরা যখন দেখি যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি ইতিমধ্যে মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করতে শুরু করেছে তখন আমরা খুশি না হয়ে হতাশ হয়ে পড়ি। ‘গো’ নামক কয়েক হাজার বছরের পুরনো গেমের উদ্ভব হয় চীনে। খেলাটি অনেকটা আমাদের দেশের ষোলোগুটি খেলার মতো। একটি নির্দিষ্ট বোর্ডে সাদা এবং কালো গুটি নিয়ে দুপক্ষকে খেলতে হয়। উদ্দেশ্য থাকে প্রতিপক্ষের গুটি আটকে রেখে বোর্ডের দখল নেওয়া। যে বোর্ডের অর্ধেকের বেশি এলাকা দখল করতে পারবে, সেই বিজয়ী। দাবা খেলার সঙ্গে এই খেলার বড় পার্থক্য হচ্ছে, এখানে অসংখ্য সম্ভাবনাময় চাল থাকে। কেবল গাণিতিক হিসাব করে সম্ভাব্য চাল বের করা অসম্ভব। ‘গো’ খেলার জন্য গুগল ডিপমাইন্ড ‘আলফা-গো’ কম্পিউটার প্রোগ্রামটি তৈরি করেছে। এটি অ্যালগেরিদম মেশিন লার্নিং এবং ট্রি সার্চিং প্রযুক্তি সমন্বয়ে করা হয়েছে। এতে পলিসি এবং ভ্যালু নেটওয়ার্ক হিসেবে দুটি নিউরাল নেটওয়ার্ক আছে। পলিসি নেটওয়ার্কটি সম্ভাব্য সেবার চালটি দ্রুত হিসাব করতে পারে এবং ভ্যালু নেটওয়ার্কটি প্রতিটি চালের শুরুতে অপ্রয়োজনীয় চালগুলে বাদ দিয়ে সম্ভাব্য চালের পরিমাণ কমিয়ে ফেলে মানুষের এই অপ্রয়োজনীয় চাল বাদ দেওয়ার সক্ষমতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জোরে অবশেষে ভাগ বসালো আলফা-গো। আলফা-গো’র প্রাথমিক পর্যায়ে এবং বিভিন্ন এক্সপার্ট গেমেও ঐতিহাসিক গেমের চালগুলো মনে রাখতে বলা হয়েছিল। ত্রিশ মিলিয়ন চালের একটি ডাটাবেস থেকে পরবর্তীকালে একটি নির্ধারিত পর্যায়ের দক্ষতা অর্জনের পর রি-ইনফোর্সমেন্ট লার্নিংয়ের সাহায্যে আলফা-গো’র সক্ষমতা এমনভাবে বৃদ্ধি করা হয় যে, এটি নিজে নিজে খেলার দক্ষতা অর্জন করে। আলফা-গো বনাম লি সেডল-এর গুগল ডিপমাইন্ড চ্যালেঞ্জ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে। মজার বিষয় ছিল, আলফা-গো’র ক্ষমতা যাচাই করার জন্য বেশ বড়সড় একটি ভুল করে বসেন লি সেডল যিনি আঠারটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজয়ী পেশাদার গো খেলোয়াড়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গুগল ডিপমাইন্ড চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হয়েছিল আলফা-গো। ম্যাচ শেষে দক্ষিণ কোরিয়া গো অ্যাসোসিয়েশন আলফা-গো-কে গো গ্রান্ডমাস্টার পদবি প্রদান করে। আলফা-গো তাহলে মানুষের মতোই তো বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করলো, তাই না?

মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনকে সহজতর করতেই রোবট, মেশিন বা ড্রোনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার হতে পারে। কিন্তু যেমনটা সিনেমায় দেখা যায়, মানুষের কাজের সুযোগ কমিয়ে দিয়ে বেকারত্ব ডেকে আনতে পারে এর ব্যবহার এবং এর ফলে কাজ হারানো মানুষের বিষণ্নতা, অবসাদে ডুবে যাওয়ার দৃশ্য সৃষ্টি হবে। এর শুরুটা দেখতে হলে যেতে হবে ১৯৫৬ সালে। ডার্টমুথ কলেজের একদল গবেষক দেখতে চেয়েছিলেন যন্ত্রপাতি মানুষের মাতোই কাজ করতে ও সাড়া দিতে পারে কি-না। তারা ধরে নিয়েছিলেন যন্ত্রকে সঠিক নির্দেশ দিতে পারলে তারা মানুষের মতোই যুক্তি ও বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কাজ করতে পারবে। আর এ থেকেই এসেছে আজকের অ্যাপলের সিরি, কিনিট, আইবিএম-র ওয়াসন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বের প্রথম বায়োনিক মানুষ রেক্স আবিষ্কৃত হয়। কৃত্রিম অঙ্গ, রক্ত ও রোটিক হাত-পা আছে এর। রেক্স হাঁটতে পারে, শুনতে পায় এবং বুদ্ধিমত্তা সহকারে কথোপকথন চালাতে পারে। সম্ভবত এসব ধারণা থেকেই আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি চলে এসেছে।

তাই বার বার প্রশ্ন আসছে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র যন্ত্র কি একসময় মানুষের প্রভু হয়ে উঠবে, মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধির পরিচয় দেবে? ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এ বিষয়ে কিছুটা সংকেত দিয়েছেন যে, আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স মানুষের ধ্বংস ডেকে আনতে পারে, ভবিষ্যতে যখন এটিকে বেশি উন্নত করা হবে। এক ধরনের ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ আমাদের হাতে ইতোমধ্যেই আছে যা এখন বেশ পুরনো হয়ে গেলেও তা আমাদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যখন তৈরি করা হবে তা মানবজাতির বিলোপ ডেকে আনতে পারে। এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারবে, বা দ্রুতগতিতে নিজেকে পরিবর্তন করতে পারবে, তার সঙ্গে মানুষ পাল্লা দিতে পারবে না। কারণ মানুষের বিবর্তন হয় ধীরগতিতে। তবে এটিও সত্য যে, মানুষের রয়েছে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স যা যন্ত্রের নেই। মানুষের আছে আবেগ, অনুভূতি, হাসি, কান্না, অভিমান, অনুভূতির প্রকাশ। মানবসৃষ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যন্ত্র ব্যবহূত হলে সেই যন্ত্র কি এগুলো অর্জন করতে সমর্থ হবে?

লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!