• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
মওলানা ভাসানীর ৪৫তম প্রয়াণ দিবস

মওলানা ভাসানী নেই, কিন্তু লড়াই এখনো চলছে


সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নভেম্বর ১৭, ২০২১, ০৯:৫২ এএম
মওলানা ভাসানী নেই, কিন্তু লড়াই এখনো চলছে

ঢাকা : স্বাধীন বাংলাদেশের কথা প্রকাশ্যে মওলানা ভাসানীই প্রথম বলেছিলেন, সেই ১৯৫৭-তে, কাগমারী সম্মেলনে। তখন তিনি আওয়ামী লীগের নেতা। সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের পরে আবারও তুলেছিলেন কথাটা, পল্টনের জনসভায়। প্রকৃত যুদ্ধ যখন শুরু হলো, একাত্তরে, তখন তাতেও মওলানা ছিলেন। যমুনাতে নৌকা ভাসিয়ে ভাসতে ভাসতে ভারতে চলে গেছেন; কিন্তু যুদ্ধে তিনি সেই ভূমিকা পালন করতে পারেননি যার স্বপ্ন দেখেছিলেন। পারলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে একটি নতুন উপাদান যোগ হতো তাতে সন্দেহ নেই। কেন পারলেন না তিনি তার ব্যাখ্যা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের মূল্যায়নের জন্য যেমন দরকার, তেমনি দরকার সেখান থেকে শিক্ষা নেবার জন্যও।

না-পারার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে জনাব সাইফুল ইসলামের লেখা ‘স্বাধীনতা, ভাসানী, ভারত’ বইতে। না, যাকে ভাসানীপন্থি বলে সাইফুল ইসলাম তা নন। তিনিও ন্যাপেরই, তবে বিপরীত ন্যাপের যাকে তখনকার দিনে মোজাফফর ন্যাপ বলা হতো তার। ওই ন্যাপের তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তবে একদিন মওলানার ডাকে তিনি রাজশাহীতে এসেছিলেন। সেই কৈশোরে। মওলানার আদি নিবাস সিরাজগঞ্জেই। তারপর একাত্তরের ১০ এপ্রিল তিনি মওলানার সহযাত্রী হয়েছিলেন, নতুন গন্তব্যে। নৌকা থেকে মওলানা তাঁকে খবর পাঠিয়েছিলেন। দলের প্রশ্ন ওঠাতে মওলানা হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, ‘এখন তো দল নয়, এখন লক্ষ্য একটাই, স্বাধীনতা।’ সঙ্গে যোগ করেছিলেন একথাও যে স্বাধীনতা যুদ্ধে কে কেমনভাবে অংশগ্রহণ করে তার ওপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। ‘তোমাকে তো যেতেই হবে যুদ্ধে, তুমিতো স্বাধীনতা চাও এবং সমাজতন্ত্র চাও,’ বলেছিলেন তিনি সাইফুল ইসলামকে। তখন আর দ্বিরুক্তি করবার কোনো অবকাশ ছিল না, স্ত্রী, মা, ঘর-সংসার সব ছেড়ে জনাব ইসলাম সেই যে রওনা হলেন মওলানার সঙ্গে, ফিরলেন দেশ স্বাধীন হবার পর। মওলানা আসামে গেছেন প্রথমে, পরে কলকাতায়, অল্প কিছুদিন ছিলেন কোচবিহারে, তারপরে দেরাদুনে। দিল্লিতে হাসপাতালে কাটিয়েছেন কিছুদিন। অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন বারবার। একবার জীবন সংশয় দেখা দিয়েছিল তাঁর, ভারত সরকার জেনেভা থেকে দ্রুত ওষুধ আনিয়ে, সর্বোচ্চ যত্ন নিয়ে তাঁকে সুস্থ করে তোলেন। প্রশ্ন উঠেছে মওলানা কি মুক্ত ছিলেন? জনাব ইসলামের ধারণা- উত্তর ভারতে তিনি মুক্ত ছিলেন, পূর্ব ভারতে নিয়ন্ত্রিত।

বড় কাছ থেকে দেখেছেন তিনি মওলানা ভাসানীকে, সেই অস্থির সময়ে। আসামের মুসলিম লীগ দলীয় প্রধানমন্ত্রী স্যার সাদুল্লা জিন্নাহ সাহেবকে একবার বলেছিলেন, একজন ভাসানীই তিনটি পাকিস্তান ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট, সেই ভাসানী স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চরমক্ষণে একাকী সময় কাটাতেন। এ একটা অপচয় বটে। অত্যন্ত মর্মান্তিক অপচয়।

কিন্তু কেন ঘটল এই মর্মান্তিক ঘটনা? অমন ক্ষমতা, আগ্রহ ও আন্তরিকতা সত্ত্বেও স্রোতের মধ্যে কেন পাওয়া গেল না তাঁকে? ব্যাখ্যা কী? সাইফুল ইসলামের আলোচনা থেকে যে ব্যাখ্যা বেরিয়ে আসে সেটি হলো, সংগঠনের অভাব। স্বতঃস্ফূর্ত শক্তি ছিল তাঁর, কিন্তু সংগঠন ছিল না। বলা যাবে যে, মুক্তিযুদ্ধের ভেতরেও ওই ব্যাপারটা ছিল, স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব ছিল না, তবে অভাব ছিল সংগঠনের। মিটিং-মিছিলের অভিজ্ঞতা ছিল; কিন্তু যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তো ছিল না। কী ঘটতে যাচ্ছে সেটা না বুঝতে পেরে আওয়ামী লীগকে বড় দলের অহমিকায় পেয়েছিল, তারা অন্যদেরকে সঙ্গে নিতে উৎসাহী ছিলেন না। মওলানা যখন আসাম সীমান্তে গিয়ে পৌঁছেছেন তখন প্রথমে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। স্পষ্ট বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কাউকে ঢুকতে দেওয়ার অর্ডার নেই। শেষে যে ঢুকতে পারলেন তাঁর এককালের সহকর্মী, মওলানা যখন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি তখন তার সম্পাদকদের একজন, একাত্তরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মঈনুল হক চৌধুরীর হস্তক্ষেপেই। তাও দিল্লিতে টেলিফোন করে ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতি নিতে হয়েছিল। কলকাতায় গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পাঁচটি উপদলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল।

মওলানা শক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন, কেননা তখন তাঁর সংগঠন নেই। তিনি একা। বাংলাদেশে তাঁর দল ন্যাপ তখন ছিন্নভিন্ন। এক অংশ তাঁকে পরামর্শ দিয়েছে পারলে পাকিস্তানকে সমর্থন করতে, না পারলে চুপ করে থাকতে। চীন দূতাবাস থেকে তাঁকে নিরাপদ আশ্রয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল একাধিকবার। তিনি তখন চীনপন্থি বলে পরিচিত, এবং চীন তখন সমর্থন করছে পাকিস্তানকে। কলকাতায় নকশালপন্থিরা মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নিতে পারছে না, চীনের কারণে। পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল মশিউর রহমান যাদু মিয়া গিয়েছিলেন কলকাতায়। মওলানার সঙ্গে দেখা করতে। মওলানা দেখা করেননি। তাঁর ধারণা যাদু মিয়া এসেছেন পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে, তাঁকে ফেরত নিয়ে যেতে। দু’দিন থেকে ব্যর্থ মনোরথে হয়তো বা যাদু মিয়া ফেরত চলে এসেছেন পূর্ব পাকিস্তানে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন জানাবার জন্য সাংবাদিক সম্মেলন করা দরকার; কিন্তু মওলানা ভরসা পাচ্ছেন না দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে। পাছে তাঁর বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়, পাছে তিনি নতুন কোনো বিতর্কের সৃষ্টি করে বসেন নিজের অজান্তেই। মওলানার পক্ষে সাংবাদিক সম্মেলন করতে হয়েছিল সাইফুল ইসলামকেই।

ওই যে সংগঠনের অভাব তার কারণেই নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও ভূমিকাকে তিনি স্পষ্ট করে তুলতে পারেননি। বিশেষ করে একাত্তরে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিনি সমাজতন্ত্র চান, ঠিক আছে; কিন্তু তাঁর সেই বাংলাদেশের সীমানাটি কী? কতদূর বিস্তৃত? অন্য সীমান্ত দিয়ে না গিয়ে তিনি আসাম সীমান্তে কেন গেলেন? ভারতের শত্রু চীন, চীনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা কোন স্তরে রয়েছে? কতটা গভীর? সর্বোপরি তাঁর নিজের দলের সঙ্গেই বা তিনি কতটুকু যুক্ত? এসব নানা প্রশ্ন ছিল। লোক ছিল না জবাব দেবার। সংগঠন ছিল না প্রচারের এবং প্রচারিত বক্তব্য বাস্তবায়িত করবার। তিনি একাই একটি প্রতিষ্ঠান, সেটা সত্য বটে; কিন্তু তা যথেষ্ট নয়, বিশেষ করে যুদ্ধের সময়ে, প্রশ্নটা যখন বাঁচার কিংবা মরার।

শক্ত সংগঠন অবশ্য তখন আওয়ামী লীগেরও ছিল না। শেখ সাহেবের অভাবে তাজউদ্দীন নেতৃত্ব দিচ্ছেন বটে, কিন্তু সকলে তখন সেই নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। একবার তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনবার একটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর পাল্টা মুজিববাহিনী খাড়া করা হয়েছে। উদ্দেশ্য বামপন্থিদের ঠ্যাঙানো। তাজউদ্দীনকে মওলানা বলেছিলেন, স্বাধীনতার পক্ষের সমস্ত শক্তিকে একত্র করতে, তাজউদ্দীন রাজি ছিলেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থি নেতারা রাজি ছিলেন না। মন্ত্রিসভায় দূরের কথা, দায়সারা গোছের উপদেষ্টা পরিষদেও নেয়া হয়নি। বামের একাংশকে নেয়া হয়েছে, সেও নিতান্ত সৌজন্যমূলকভাবে, তাকে কাজ করতে উৎসাহিত করা হয়নি, সুযোগও দেয়া হয়নি। অন্য অংশ, চীনপন্থি বলে যারা একদা খ্যাত ছিল তারা একত্র হয়ে ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গঠন করেছিল, কিন্তু সরকারি উপদেষ্টা পরিষদে তাদের কোনো প্রতিনিধি নেয়া হয়নি। মওলানাকে পরিষদের সভাপতি করা হয়েছিল, তিনি চাপ দিয়েছেন, কিন্তু ফল হয়নি। ওদিকে নানারকমের ষড়যন্ত্র হরদম চলছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে আপোষ করতে চাইছিল কেউ কেউ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ মওলানার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কদমবুচি করেছেন, উপঢৌকন পাঠিয়েছেন। পাত্তা পাননি। গুজব রটেছিল যে খন্দকার মোশতাক আপোষ চান; কিন্তু মওলানা আগাগোড়া বলেছেন, যারা আপোষ করবে তারা গাদ্দার। হয় স্বাধীনতা নয় মৃত্যু। মাঝখানে কিছু নেই। আওয়ামী লীগ তার নিজের এমপিদের সবাইকে বিশ্বাস করত না। পাহারা দিয়ে রাখতো। কারণ ছিল অবিশ্বাসের। তাদের অনেকেই যুদ্ধের জন্য এমপি হয়নি, সুযোগ-সুবিধার জন্য হয়েছেন।

সাইফুল ইসলামের এই বইতে মওলানা ভাসানীর অসামান্যতা নানাভাবে প্রকাশ পায় এবং তাঁর ব্যর্থতাও। মওলানা যে অসাধারণ ছিলেন তার রহস্য কী? মূল রহস্য রাজনীতি। তিনি নিজেই বলতেন, রাজনীতি না করলে তিনি গাঁ-গেরামে পানি পড়ার পীর থাকতেন। আর সেই রাজনীতি ছিল জনগণের রাজনীতি। একদা তিনি পাকিস্তানপন্থী ছিলেন, মন্ত্রিত্বের লোভে নয়, স্বপ্নের তাড়নায়। স্বপ্ন ছিল পাকিস্তান শোষিত মানুষের জন্য মুক্তি নিয়ে আসবে। আনলো না। তাঁর বুঝতে দেরি হয়নি, মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে গেলেন। আওয়ামী লীগ গঠন করে সভাপতি হলেন, মতাদর্শিক কারণে দল ত্যাগ করলেন, পরে নতুন দল গড়লেন, ন্যাপ। যুদ্ধের শুরুতে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর একমুহূর্ত সময় লাগেনি, কোন পথে যাবেন সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেলেছেন, ঘর থেকে বের হবার আধঘণ্টার মধ্যে টাঙ্গাইলে তাঁর ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল হানাদার পাকিস্তানিরা। কাছে পেলে কে জানে হয়তো হত্যাই করতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা তিনি প্রথম বলেন, কিন্তু সেই সঙ্গে বলেছেন স্বাধীনতা যথেষ্ট নয়, সমাজতন্ত্রও আনতে হবে। ভারতে যখন যাচ্ছেন নৌকায় বসে তখন বলেছিলেন, ‘দেখ, সায়ফল স্বাধীনতা যুদ্ধেই আইসা থাকি আর যাই কইরা থাকি আমরা বড় কাওয়ার্ড।’

আত্মীয়স্বজন, আপনজন, সঙ্গী-সাথী সবাইকে উন্মত্ত নেকড়ের মুখে ফেলে রেখে নিজে একা চলে যাচ্ছেন, এ তাঁকে পীড়িত করেছে; কিন্তু বাড়িঘরের কথা ভাবেননি। কখনো নয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোনো বোধই ছিল না মওলানার, ভারতে প্রবেশ করেছেন একটি রঙচটা টিনের সুটকেস হাতে নিয়ে।

আর ছিল অতিস্বচ্ছ দৃষ্টিশক্তি। বিশ্বাসে খাঁটি মুসলমান, বিজ্ঞানে নিরাপোষ সমাজতন্ত্রী। নিজে যখন আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি তখনই তিনি বলতেন, কংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদুলই আর মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রী স্যার সাদুল্লার পার্থক্য স্রেফ টুপির। একজনের টুপি আছে, অন্যজনের নেই। ওভাবেই দেখতেন তিনি শ্রেণিস্বার্থের পাহারাদারদেরকে। সেজন্যই সমাজতন্ত্র চাইতেন। একাত্তরের যুদ্ধে যে গেরিলা যুদ্ধ হবে সে তিনি বুঝে ফেলেছিলেন যুদ্ধ শুরু হবার আগেই। যুদ্ধ যখন তুঙ্গে তখন তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের পক্ষে ভারত আক্রমণ করা ছাড়া বাংলাদেশ ছেড়ে যাবার তার কোনো সম্মানজনক পথ নেই।

মওলানার ছিল গভীর আন্তরিকতা। যা মানুষকে টানতো। সাইফুল ইসলাম মওলানার এককথায়, বলতে গেলে একবস্ত্রে চলে গিয়েছিলেন মওলানার সঙ্গে। আরেকজন, মোরাদুজ্জামান, নৌকায় উঠেছিলেন পথ দেখাবার জন্য, দেশত্যাগের কোনো কথাই ছিল না তার, কাউকে বলেও আসেননি, কিন্তু তিনিও চলে গেলেন- সঙ্গে। তারা তবু দেশের লোক, পূর্ব-পরিচিত, ভারতে যারা তাঁর দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন তারাও প্রত্যেকেই ভক্ত হয়ে পড়েছেন। যত্নের কোনো ত্রুটি হয়নি, বিদায় মুহূর্তের সময় কান্নাকাটির ধুম পড়ে গেছে।

অবশ্য সেটা ছিল গৌরবের সময়। বাঙালির পক্ষে অমন গৌরবের সময় এর আগে কখনো আসেনি, পরে আসবে কি না কে জানে। বাঙালি তখন যুদ্ধ করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সামান্যতম যোগ আছে, কিংবা কোনোকালে ছিল এমন মানুষও নিজেদেরকে গৌরবান্বিত মনে করেছেন। মওলানা একবার এক আশ্রম দেখতে গেছেন। হিমালয়ের গায়ে, গঙ্গার প্রায় উৎসমুখে বিশিষ্ট মুনীর আশ্রম। সেখানে প্রাচীন গুহার ভেতর মহাঋষি মন্ত্র পড়ছেন, সংস্কৃত। পাঠ শেষে বেরিয়ে এলেন ঋষি; চুলের চূড়া, দেহের গঠন, পরিধানের কৌপিন ও পায়ের খড়মে হাজার বছরের ঐতিহ্য। মওলানার হিন্দি শুনে বললেন, ‘বাঙালি বুঝি?’ তারপর বাংলাদেশের লোক শুনে জড়িয়ে ধরেন মওলানাকে, বললেন, ‘বাড়ি বিক্রমপুর।’ কোথায় রইল ধর্ম, কোথায় ছোঁয়াছুয়ি। গঙ্গার কলধ্বনির সঙ্গে হাসির ধ্বনি মিশে গেল দু’জনের। আরেকবার দুর্গম এক তীর্থে গেছেন লেখক সাইফুল ইসলাম একা। পাণ্ডার পাল্লায় পড়েছেন। পাণ্ডা পয়সা চায়, সাইফুল ইসলামের পকেট ফাঁকা। একফাঁকে বাংলায় বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, শুনে লাফিয়ে উঠেছেন পাণ্ডা। বাড়ি কোথায়? জয় বাংলার লোক শুনে বললেন, ‘আমার বাড়ি বরিশালে।’ টেনে নিয়ে গিয়ে লুচি-হালুয়া খাওয়ালেন এবং দুটি দশ টাকার নোট হাতে গুঁজে দিতে চাইলেন। নেবেন না বলায় কেঁদে ফেললেন। ব্রিগেডিয়ার লভরাজ, ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোক, তাঁর স্ত্রী বারবারা লভরাজ খাঁটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, তিনি নিজেও অনেকটা সেরকম- দেখতে শুনতে। দেরাদুনে দায়িত্ব পেয়েছিলেন মওলানার দেখভাল করার। সেই দায়িত্ব পেয়ে এমন ভাব করেন যেন ওটি তাঁর জীবনে এক পরম পাওয়া। এ সময়ে দেখা গেল আর একটি মানুষ জেগে উঠেছে ব্রিগেডিয়ারের ভেতরে, কবে কোন পূর্বপুরুষের জন্ম হয়েছিল বিক্রমপুরে তাই নিয়ে হামেশা বড়াই করছেন। একদিন তো কবিতাই আবৃত্তি করে শোনালেন, ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।’ তার স্ত্রীও প্রায় বাঙালি হয়ে যান আর কি।

একদা অতিপ্রত্যুষে মওলানার ঘরে উঁকি মেরে লেখক সাইফুল দেখেন জায়নামাজে বসে মওলানা গুন গুন করছেন। কান পেতে শুনলেন। গুন গুন করে গান গাইছেন, ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শক্তি।’ সাইফুল ইসলামের সেদিন আর প্রাতঃভ্রমণ করা হয়নি। তিনি নিজের ঘরে ফিরে এসেছেন। ব্যর্থতার এই একটা বোধ মওলানাকে বিষণ্ণ করে রাখত, মাঝে মাঝে অসুস্থ করে ফেলত। বলতেন, ‘যুদ্ধ করতে এসে কুটুম বাড়িতে বেড়িয়ে গেলাম।’

বিদায়ের সময় সাইফুল ইসলামকে মওলানা বলেছিলেন, ‘অনেক বড় স্বপ্ন দেইখ্যা দায়িত্ব কান্ধে নিয়া আমার সঙ্গে আসছিলা। স্বপ্ন আমারও ছিল। বাংলার সর্বহারা মানুষের মুক্তির স্বপ্ন। সেইটা পাইতে হইলে আর একটা লড়াই লড়তে হইব।’

মওলানা আজ নেই, কিন্তু লড়াই এখনো চলছে। নানা ফ্রন্টে লড়ছে মানুষ। সেই পক্ষেও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন আছে জনগণের, কিন্তু তারও ওই একই দুর্বলতা। সাংগঠনিক।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!