জাতি হিসেবে আমরা যে একটি অকৃতজ্ঞ জাতি, নতুন করে আবার তা প্রমাণ করলাম। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে পেতে জীবন দেওয়া ১০টি তরতাজা প্রাণের কথা একবারের জন্যও বলা হলো না। গণতান্ত্রিক দেশটি তার বীর সন্তানদের স্মরণ করতে ভুলে গেল।
ভুলে গেল বাংলাদেশের মাটিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি শোকাবহ দিন। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের গুলিতে এদিন নিহত হয়েছেন দেশের দামাল সন্তানরা। একই সঙ্গে আনন্দেরও বটে, কারণ এদিন স্বৈরাচার মুক্তির বারতা বয়ে আনে এদেশের জনতা। আমরা ফিরে পেয়েছিলাম কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র। দিবসটির মাথায় পরিয়েছিলাম স্বৈরাচার পতন দিবসের মুকুট।
একসময় এখানে কোথাও ভালোবাসার কোনো ঘাটতি ছিল না। ঘাটতি ছিল না বলেই আমরা ভাষার জন্য আন্দোলন করতে পেরেছি। বুকের রক্ত ঢেলে সেই ভাষাকে মহান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুব শাহীকে পরাস্ত করে একাত্তরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে পেরেছি। এ দাঁড়ানোর পেছনেও ছিল রক্তাক্ত ইতিহাস। ইতিহাস আত্মত্যাগের।
কবি শামসুর রাহমানের, ‘আসাদের লাল শার্ট’ এখনো টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার পথে প্রান্তরে। আর-মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস? সে সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। লাখো শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের স্মৃতিসৌধ। ভালোবাসা কতটা গভীর হলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অকাতরে জীবন উৎসর্গ করতে পারে, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস তারই অকাট্য প্রমাণ।
নিজের অস্তিত্ব নির্মাণের লক্ষ্যে, একটি পতাকাকে বুকে ধারণ করার লক্ষ্যে, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র ঘাটতি থাকলে আমাদের জীবনে ১৬ ডিসেম্বরকে পাওয়া যে সম্ভব হতো না- এ কথা শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়। কিন্তু আজ?
আমরা যেন লক্ষচ্যুত পঙ্গপালে পরিণত হয়ে ছুটে চলেছি এক মৃত্যুকূপের মোহনায়। পথপরিক্রমায় সামনে যা কিছু এসেছে, নিমিষেই তাকে ভক্ষণ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছি। কখনো ভাবিনি এর শেষ কোথায়। কোথায় চলেছি আমরা। বোধ আর বিবেককে বলি দিয়ে মেতে উঠেছি ভ্যালেন্টাইন নামের ইমপোর্টেড ‘ভালোবাসা দিবসে’।
ভুলতে ভুলতে আমরা যেন ভালোবাসার সংজ্ঞাকেও হারিয়ে ফেলেছি। হারিয়ে ফেলেছি ভালোবাসা নামের এই শব্দটির অহংকার, মর্যাদা এবং সম্মানবোধ। আর সে কারণেই বিদেশ থেকে আমদানি করে চকচকে মোড়কে বাজারজাতের চেষ্টা করছি। ভালোবাসাকে করে তুলেছি একটি বিশেষায়িত পণ্যে। ভালোবাসাকে কখনই বাজারের পণ্য হতে পারে না, এ বিশ্বাস থেকে আমরা সরে আসতে শুরু করেছি।
ভাঙতে শুরু করেছি আমাদের শিল্প, আমাদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি। তা না হলে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে আমরা কেন ভালোবাসতে পারলাম না স্বৈরাচার পতন আন্দোলনের সেই সব শহীদদের—যারা গণতন্ত্রকে ভালোবেসে, নিজের জীবন উৎসর্গ করে আমাদের হাতে দিয়ে গেলেন গণতন্ত্রের ঐতিহাসিক পতাকা!

প্রতিদিনের মতো সে দিনটি বিশেষ কোনো দিন ছিল না। তবে বছরটি ছিল শুরু থেকেই উত্তাল। জনবিরোধী ‘মজিদ খান শিল্পনীতি’ বাতিল দাবির কারণে। ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা যুদ্ধের মতোই এখানেও অগ্রণী ভূমিকায় ছিল সাধারণ ছাত্রসমাজ। সময়টা ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি।
গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, ছাত্রবন্দিদের মুক্তি ও দমননীতি বন্ধ এবং গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঢাকায় ছাত্র জমায়েত, সচিবালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল এবং অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দেয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। সকাল থেকেই ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সচিবালয় ও তার আশপাশ। গণতন্ত্রকামীদের আন্দোলনে স্বৈরাচারী শাসক লেলিয়ে দেয় পুলিশ।
তাদের গুলিতে তখন শহীদ হন জাফর, শিশু পথচারী দীপালি সাহা, জয়নালসহ দশজন। নব্বই দশকের স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের উন্মেষ ঘটেছিল সেই দিনই। অথচ আজ করপোরেট ভালোবাসায় মুগ্ধ আমরা যেন ভুলে গেছি জয়নাল, জাফর আর দীপালিদের মতো ভালোবাসার নির্যাসে গড়া শহীদদের।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের আরেক শহীদ নূর হোসেনের আত্মত্যাগের দিনটি নীরবে আসে আর চলে যায়। সংবাদ মাধ্যমে কেবল ‘আজ নূর হোসেন দিবস’ শিরোনামে প্রকাশ করা হয় যৎসামান্য প্রতিবেদন। এ যেন দায়সারা গোছের এক অকৃতজ্ঞদের ভালোবাসা। বড় কোনো রাজনৈতিক দলকে আজ এসব শহীদকে সেভাবে স্মরণ করতেও দেখা যায় না। অথচ, এদের রক্তের বিনিময়ে আজ গণতান্ত্রিক হাওয়ায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দল সরকার চালায় অথবা বিরোধী দলে থাকে।
পাশ্চাত্যের ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’কে ভালোবাসা দিবসে পরিণত করে এদেশেরই একদল শিক্ষিত সচেতন মানুষ(?) সাধারণ মানুষের দেহে ইনজেক্ট করল মরফিয়া। তাদের এ কাজকে কখনই ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। তারা সুস্থ। সাহসী ও সততার আদর্শে গড়া যুব সমাজকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্যই ভেবেচিন্তে যে এ কাজ করা হয়েছে—এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
ছাত্র ও যুব সমাজকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবেই যেন বেছে নেওয়া হয়েছে এ ধরনের কর্মকা-। এক্ষেত্রে তারা যে সফল হয়েছে আজ তা বলতেও দ্বিধা নেই। ‘ছাত্র রাজনীতি তার অতীত ভুলে বিপথে চলছে’—এ জাতীয় মন্তব্যে মুখরিত রাখার চেষ্টা করছে আমাদেরই তথাকথিত ‘সুশীল সমাজ’। কিন্তু ১৪ ফেব্রুয়ারির মতো ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় দিনগুলো যাতে আমরা ভুলে না যাই সেই চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য একটি দীর্ঘশ্বাসও ফেলল না তারা। কিন্তু কেন?
কারণ একটিই। করপোরেট পুঁজির টাকার ঝলকানির নিচে তারা তাদের সবকিছুকে বিসর্জন দিয়ে বাণিজ্যিক ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এবং গোটা জাতিকে এক অকৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে গড়ে তোলার কাজে ন্যস্ত হয়েছে। যেখানে আদরে সোহাগে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে চলেছে আমাদের রাজনীতিক, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। যা একজন দেশপ্রেমিকের কখনই কাম্য হতে পারে না।
লেখক : সাংবাদিক-চিন্তক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।







































