• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ও পুলিশের পকেটে যায় ক্যাসিনোর টাকা


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৯, ০২:৪৩ পিএম
ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ও পুলিশের পকেটে যায় ক্যাসিনোর টাকা

ঢাকা: ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার নেতৃত্বেই রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, বনানীসহ বিভিন্ন স্পটে চলত এসব ক্যাসিনো কারবার। এসব থেকে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা আয় করতেন যুবলীগের এই নেতা। রাজধানীর অভিজাত সব এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই চলছে রমরমা ক্যাসিনো বাণিজ্য। 

এসব ক্যাসিনোতে জুয়ার আসরে উড়তো অবৈধ টাকা। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের মালিকানায় পরিচালিত এসব ক্যাসিনোর টাকার ভাগ পাঠানো হতো পুলিশ কর্মকর্তাসহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিদের। যার ফলে দিনকে দিন ঢাকায় বিস্তার লাভ করে অবৈধ এই ব্যবসা। তবে এতদিন নজরে না এলেও এখন নড়েচরেই বসেছেন প্রশাসন। রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরা, গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল, ফকিরাপুল, ক্লাবপাড়া, বাংলামোটর, ইস্কাটন, ধানমন্ডি, গ্রিনরোড এলাকা মিলিয়ে অন্তত ৬০টি ক্যাসিনোর তথ্য ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে। 

এসব ক্যাসিনোগুলোর মালিকানায় রয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও সেচ্ছাসেবক লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতারা। এদের মধ্যে রয়েছেন- শাহে আলম মুরাদ, ইসমাঈল হোসেন সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভুইয়া, কাওসার মোল্লা ও কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদসহ আরও কয়েকজন। 

র‌্যাব সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর ব্যস্ততম ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্যাসিনোর মালিক হলেন ঢাকা দক্ষিণের যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুইয়া। গুলশানের বনানীতে তার আরও একটি ক্যাসিনো রয়েছে। তার নাম গোল্ডেন ঢাকা। খালেদকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এমন কিছু ব্যক্তির নাম বলেছেন, যারা সমাজে খুবই প্রভাবশালী। তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী সে সব ব্যক্তি সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করেছে র‌্যাব। 

এদিকে, গতকাল রাত থেকেই র‌্যাব তাদের কারও কারও ওপর নজরদারি রাখতে শুরু করেছে। তবে কৌশলগত কারণে এখনই তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে সবুজ সঙ্কেত পেলে নজরদারি রাখা ব্যক্তিদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। ক্যাসিনো বা জুয়া খেলা দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী অবৈধ হলেও প্রকাশ্যেই এ কারবার চলে আসছিল। 

রাজধানীর দুটি থানার নাকের ডগাতেই রমরমা ক্যাসিনো বাণিজ্য চললেও এর বিরুদ্ধে কখনই অভিযান চালায়নি প্রশাসন। কারণ অধিকাংশ ক্যাসিনোর মালিক ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। গতকাল খালেদকে গ্রেফতার করা হলেও অন্য সব প্রভাবশালীরা রয়েছেন এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। গতকাল খালেদকে গ্রেফতার করার পর রাজধানীতে ক্যাসিনো কারবার এবং এতে কোটি কোটি টাকা ওড়ার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। 

এ ঘটনায় এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন কারা পেতেন এসব টাকার ভাগ? একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ক্যাসিনো বাণিজ্যের টাকার ভাগ পুলিশসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিকে প্যাকেট করে পাঠানো হতো দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে।  যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতা এই টাকার ভাগ পেতেন। এমনকি ক্যাসিনো বাণিজ্য থেকে আয় হওয়া টাকার একটি অংশ দেশের বাইরেও পাচার হয়ে আসছিল। এসব কারণে রাজধানীতে দিনের পর দিন ক্যাসিনোর কারবার বিস্তার লাভ করে বলে একাধিক সূত্রের তথ্যে জানা যায়।    

রাজধানীর পল্টন থানার উল্টো পাশের জামান টাওয়ারে কয়েক বছর পূর্বে ক্যাসিনো বাণিজ্য শুরু হয়। এর পর ধাপে ধাপে আরামবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠে একের পর এক ক্যাসিনো। তবে প্রশাসন শুরু থেকেই এ বিষয়ে নীরব ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রাজধানীর ক্যাসিনোগুলোতে সাঁড়াশি অভিযানে ইতোমধ্যে তিনটি ক্যাসিনোতে ১৮২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় নগদ প্রায় ৪০ লাখ টাকাও জব্দ করা হয়। তবে রাতভর মোট ৮টি ক্যাসিনোতে অভিযান পরিচালনা করার কথা রয়েছে বলে র‍্যাব সূত্রে জানা গেছে।

অপরদিকে, রাজধানীর মতিঝিল, গুলিস্থান ও বনানীতে এই অভিযান চালান র‍্যাবের একাধিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ সময় বিপুল পরিমাণ মদ ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য জব্দ করে র‌্যাব। র‍্যাব সূত্রে জানা যায়, মতিঝিলের ইয়ংমেনস ক্লাব থেকে ২৪ লাখ ২৯ হাজার টাকা জব্দ ও ১৪২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বনানীর ওয়ান্ডার্স ক্লাব থেকে ১০ লাখ ২৭ হাজার টাকাসহ ২০ হাজার ৫০০ জাল টাকা জব্দ করা হয়েছে। গুলিস্থানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাব থেকে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৬০০ টাকা জব্দ ও ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার ১৮২ জনের মধ্যে ৩১ জনকে ১ বছর করে, বাকিদের ৬ মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন র‍্যাবের এই ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলো।

অন্যদিকে, র‍্যাবের অভিযানের খবর পেয়ে ক্যাসিনোর মালিক সেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মোহাম্মদ কাওসার মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে সটকে পড়েন। র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার আলম ওয়ান্ডার্স ক্লাবের পেছনে ক্যাসিনোটি সিল করে দিয়েছেন। ওয়ান্ডারর্স ক্লাবের ক্যাসিনোর মালিক হলেন, সেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কাওসার মোল্লা এবং স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ। দুজনই পালিয়েছে বলে র‌্যাব জানিয়েছে।

এরপরই র‌্যাব অভিযান চালায় গুলিস্থানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে। মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় ৪০ জনকে। এ সময় কয়েকটি পাসপোর্টও উদ্ধার করা হয়। নগদ পাওয়া যায় ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৬১৫ টাকা। গুলিস্থানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের ক্যাসিনোর মধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ ও যুবলীগ নেতা সম্রাটের অংশিদারিত্ব রয়েছে র‌্যাব কর্মকর্তারা তাদের সোর্সের বরাত দিয়ে এই তথ্য জানান। 

আর ওই ক্যাসিনোর কক্ষের ভিতরে রয়েছে বড় বড় মহারথিদের ছবিও। এ সকল মহারথিদের ছবি টাঙিয়ে এবং তাদের দোহাই দিয়েই চলত কোটি টাকার জুয়া ও মদের আসর। ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব থেকে আটক করা হয় ১৪২ জনকে। তাদের মধ্যে ৩১ জনকে ১ বছরের কারাদণ্ড ও বাকিদের ৬ মাস করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। তাদের কেরানীগঞ্জ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর কথা বলেছেন র‌্যাব সদস্যরা। 

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, এই মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা আলী আহম্মেদ। র‌্যাবের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক জানানো হয়, রাজধানীতে যুবলীগের মদদে ৬০টি ক্যাসিনো চলছে বলে খবর প্রকাশ হওয়ার প্রেক্ষিতেই এই সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়।

বিষয়টি নিয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, রাজধানীর ক্যাসিনোগুলোর বিরুদ্ধে র‌্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে। অপরাধীরা প্রভাবশালী হলেও ছাড় দেওয়া হবে না।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!