• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মুজেজাসমূহ


মুফতি নাঈম কাসেমী নভেম্বর ৫, ২০২০, ১২:০৩ পিএম
বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মুজেজাসমূহ

ঢাকা : যেমনিভাবে রাতের অন্ধকারের পর দিনের আলো আসাটা কুদরতি নিয়ম। ঠিক তেমনিভাবে এটাও আল্লাহতা’য়ালার ফয়সালা যে, যখন মানবজাতির ওপর পথভ্রষ্টতা ও গুমরাহির কালো আঁধার ছেয়ে যায়, তখন আল্লাহতা’য়ালা হেদায়েতের সূর্য উদিত করেন। মানবজাতিকে সঠিক পথপ্রদর্শনের জন্য নবী-রাসুলদের আল্লাহতা’য়ালা নিজের প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেন। আল্লাহতা’য়ালা তাদের এমন কিছু অলৌকিক শক্তি দান করেন, যা সাধারণত মানুষকে দেন না। তাদের এমন চক্ষু দেওয়া হয়ে থাকে যা অন্য কাউকে দেওয়া হয় না। নবী-রাসুলগণ এমন কিছু দেখেন যা আমরা দেখি না। তারা এমন কিছু শোনেন যা আমরা শুনি না। মানুষের ফিতরি তাকাজা পূর্ণ করা ও তাদের অন্তরকে প্রশান্তি দেওয়ার জন্য নবী রাসুলদের থেকে এমন কিছু অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে যা সাধারণ মানুষের জন্য অসম্ভব। যেমন হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জন্য আগুন ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, হজরত মুসা (আ.)-এর লাঠি বিশাল বড় শাপ হয়ে যাওয়া, হজরত ঈসা (আ.)-এর পিতা ছাড়া জন্ম হওয়া এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক রাতে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা হয়ে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত ভ্রমণ করা এ সমস্ত ঘটনা মানুষের বিবেক দ্বারা বোঝা অসম্ভব। এগুলোকেই ইসলামী পরিভাষায় মুজেজা বলা হয়।

আমাদের নবী, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন এক সময়ে ধরাতে আগমন করেছেন, যখন সারা দুনিয়া মূর্খতা ও গুমরাহির অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। তিনি (সা.) এই অন্ধকারকে একত্ববাদ ও ইসলামের আলোয় আলোকিত করে দিয়েছেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহু মুজেজা রয়েছে। ইমাম বাইহাকি (রহ.) বলেন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজেজা হলো এক হাজার। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজেজা হলো এক হাজার ২০০। আবার অনেক মনীষী বলেন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজেজা তিন হাজার। (সূত্র: ফতহুল বারি)। সর্বোপরি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্য-অগণিত মুজেজা রয়েছে। যা লিখে বা বর্ননা করে শেষ করা সম্ভব নয়। তথাপি পাঠকদের জন্য কিছু পেশ করার প্রয়াস করেছি।

কোরআন কারিম : হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর পক্ষ থেকে যতগুলো মুজেজা দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মুজেজা হলো ‘আল কোরআন’। কাফেররা যখন নবীজির নিকট মুজেজা চেয়েছে তখন আল্লাহতা’য়ালা উত্তরে বলেন, ‘তাদের কি এই নিদর্শন যথেষ্ট নয় যে, আমি মুহাম্মাদের ওপর এই কিতাব অবতীর্ণ করেছি যা তিনি তাদেরকে পড়ে শোনানো হয়।’ (সুরা আনকাবুত)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘নবীদেরকে আল্লাহতা’য়ালা যেসব মুজেজা দান করেছেন সেগুলো দেখে মানুষরা তাদের ওপর ঈমান এনেছে। কিন্তু আল্লাহপাক আমাকে এমন এক মুজেজা দান করেছেন সেটা হলো কোরআন, যার দ্বারা আমি আশা করি কিয়ামতের দিন আমার অনুসারী সবচেয়ে বেশি হবে।’ এই কোরআনের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, এর মতো করে একটি সুরাও কেউ রচনা করতে পারবে না।

হাদিস : কোরআনের পর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বড় মুজেজা হলো ‘হাদিস’। কেননা যেই ব্যক্তি উম্মি তথা যিনি কখনো পড়েননি, লেখেননি বা দুনিয়ার কারো থেকে একটা শব্দও শেখেননি, এমন ব্যক্তির জবান মুবারক দিয়ে গঠনমূলক কথা ও বাণী কীভাবে নিঃসৃত হতে পারে? ইমান-আকিদা, লেনদেন, আচার-ব্যবহার, উত্তম চরিত্র গঠন, সামাজিক জীবন, পারিবারিক জীবন, আল্লাহর হক, মানুষের হক, দুনিয়া ও আখিরাত ইত্যাদি বিষয়ে এমন সব দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, যেগুলো সারা দুনিয়ার মানুষের ইহকাল ও পরকালের সফলতার মূল সনদে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। কিয়ামত পর্যন্ত কোনো মানুষ যদি প্রিয় নবী সম্পর্কে জানতে চায়, তাহলে হাদিস থেকে খুব সুন্দরভাবে জানতে পারবে।

চন্দ্র দিখণ্ডিত হওয়া : একদা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিনায় উপস্থিত ছিলেন। অনেক কাফেরও সেখানে উপস্থিত ছিল। কাফেররা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কোনো অলৌকিক নিদর্শন দেখতে চাইল। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আসমানের দিকে তাকাও। তারা আসমানে তাকিয়ে দেখল, চাঁদ দুই টুকরা হয়ে গেছে। মাঝখানে পাহাড়। সমস্ত কাফের ভালো করে দেখার পর পুনরায় চাঁদ এক হয়ে গেছে। কিন্তু হতভাগা কাফেররা এই চাক্ষুষ মুজেজাকেও অস্বীকার করেছে।

বুবার নবুওয়াত স্বীকারোক্তি : এক নারী নবীজির নিকট তার এক যুবক ছেলেকে নিয়ে এসে বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার ছেলে জন্ম থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত কথা বলেনি। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, হে যুবক বলো আমি কে? সাথে সাথে সে বলে উঠল ‘আপনি আল্লাহতা’য়ালার সত্য নবী।’ (বাইহাকি শরিফ)।

আঙুলের মাথা দিয়ে পানি বের হওয়া : হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় পানি শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফলে এক হাজার ৫০০ মানুষ খুব পেরেশানিতে ও কষ্টে ছিল। তখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এক মগ পানি নিয়ে আসা হলে তার মাঝে নবীজি নিজের হাত মুবারক রেখে দিলেন। তখন নবীজির আঙুল থেকে ঝরনার মতো পানি বের হতে শুরু করে। এরপর সবাই ওজু করেন। পান করেন। নিজেদের প্রয়োজন সেরে নিজ নিজ পাত্রে রেখেও দিলেন। (বুখারি, তিরমিজি)

গাছ ও পাথরের সিজদা করা : শাম দেশের রাস্তায় এক খ্রিস্টান পাদ্রি থাকত। যখন আবু তালেবের কাফেলা সেখানে পৌঁছল, তখন সেই পাদ্রি দেখল রাস্তার উভয় পাশের গাছ ও পাথর সিজদারত অবস্থায় আছে। সে যেহেতু তাওরাত ও ইঞ্জিলের আলেম ছিল, তাই সে জানত যে গাছ, পাথর নবী ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করে না। সে কাফেলার কাছে এলো। সবাইকে দেখল। আর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামর হাত ধরে সে বলল, ‘তিনি শেষ নবী’।

গাছ এবং পাহাড়ের সালাম দেওয়া : হজরত আলী (রা.) বলেন, একদা আমি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মক্কার এক গলিতে যাচ্ছিলাম। আমি দেখলাম, যেই পাহাড় ও গাছ সামনে আসছে সেটা থেকেই শব্দ আসছে ‘আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ’।

হালিমা সা’দিয়া (রা.)-এর উটনী ও ঘরে বরকত : হজরত হালিমা সা’দিয়া (রা.) বলেন, আমি যখন আমার এলাকার মহিলাদের সাথে মদিনায় যাচ্ছিলাম দুধপানকারী সন্তানের জন্য, তখন আমার উটনীটা ছিল একেবারে দুর্বল ও ক্ষীণকায়। যেটা সবার পেছনে চলছিল। কিন্তু যখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাথে নিয়ে বাড়িতে ফিরছিলাম তখন উটনীটা সবল হয়ে গেল। সবার আগে দ্রুত গতিতে চলে আসল। তিনি আরো বলেন, আমার ঘরের বকরিগুলোতে দুধ খুব কম ছিল। একেবারে ছিল না বললেই চলে। কিন্তু যখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ঘরে আসলেন তখন আমার বকরিগুলো দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এমন কি আমার প্রতিবেশীরা আমাকে বলতে লাগল, আমরাও তো একই জায়গায় বকরি চরাই। আমাদের বকরিগুলোতে তো এত দুধ আসে না।

গাছের কালিমায়ে তাওহিদ পড়া : হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সফরে ছিলেন। এক গ্রাম্যলোক নবীজির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাচ্ছো? সে বলল বাড়িতে যাচ্ছি। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, তোমার কি নেকির প্রয়োজন আছে? সে বলল, কী নেকি? নবীজি বললেন, কালিমা তাওহিদ বলো। সে বলল, এই কালিমার সাক্ষী আর কে দেয়? তখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক গাছকে ডাক দিলেন। গাছ সাথে সাথে দৌড়ে নবীজির নিকট চলে এল। তিনি (সা.) ওই গাছকে বললেন, তুমি কালিমা বলো। সেই গাছ তিনবার কলিমা বলল। তখন ওই গ্রাম্যলোকটি বলল, আমি বাড়িতে গিয়ে সবাইকে নিয়ে আসব। আমরা সবাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করব। যদি সবাই না আসে তাহলে আমি একাই আপনার কাছে চলে আসব। (ইবনে সা’দ)

এক দিনের বাচ্চার নবুওয়াতের স্বীকারোক্তি : বিদায় হজের সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট ইয়ামামাবাসীর এক ব্যক্তি এক বাচ্চা নিয়ে এল। যে বাচ্চা ওই দিনেই জন্মগ্রহণ করেছে। বাচ্চাকে দেখে নবীজি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে বাচ্চা বলো আমি কে? বাচ্চা সাথে সাথে বলে উঠল আপনি আল্লাহ তা’য়ালার সত্য নবী ও রাসুল।’ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি সত্য বলেছো। আল্লাহতা’য়ালা তোমার বয়সে বরকত দান করুন।

লেখক : পরিচালক, জামিয়া শায়খ আরশাদ মাদানী, বাংলাদেশ

 

Wordbridge School
Link copied!