• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সিন্ডিকেটের কবলে ডাল-ছোলা!


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ৩১, ২০২২, ০৪:২৩ পিএম
সিন্ডিকেটের কবলে ডাল-ছোলা!

ঢাকা : আসছে মুসলমানদের পবিত্র মাস রমজান। প্রতি বছর রমজান মাস এলেই বৃদ্ধি পায় ডাল ও ছোলার চাহিদা। কারণ এ দেশের মুসলমানদের ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ ডাল ও ছোলা।

এবারো রমজান শুরুর আগেই বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে একশ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাড়িয়ে দিয়েছে এই দুই পণ্যের দাম। আমদানি বা সরবরাহে ঘাটতি না থাকলেও ভোজ্যতেলের পর এখন ডাল ও ছোলার দাম বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। এজন্য আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দোষারোপ করছেন একে অপরকে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির তথ্যমতে, এক বছরের ব্যবধানে মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৪৪ শতাংশ।

সংস্থাটির হিসাবে, গত বছরের একই সময়ে ভারতীয় বড় দানার মসুর ডালের কেজি ছিল ৬৫ টাকা। এখন তা কিনতে গুনতে হচ্ছে ১০০ টাকা। আবার মাঝারি দানার (দেশি) মসুর ডালের দাম ছিল ৮০ টাকা। তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৫ টাকা। আর আমদানি করা ছোট দানার মসুর বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা কেজি। যদিও খুচরা বাজারের বাস্তব চিত্রে সরকারি এই হিসাবের চেয়ে খুচরা বাজারে দাম কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি।

টিসিবির হিসাব বলছে, মসুর ডালের সঙ্গে বেড়েছে অ্যাংকর ডালের দামও। ৩৮ থেকে ৪০ টাকার অ্যাংকর এক বছরের ব্যবধানে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। দাম বাড়ায় পিছিয়ে নেই খেসারি ও মুগডালও।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে আমদানি করা ভারতীয় মসুর ডালের কেজি ১০৫ থেকে ১১০ এবং দেশি মসুর ১৩০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আর ছোট দানার মসুরের দাম ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা।

এ ছাড়া মুগ ডালের কেজি ১০০ থেকে ১৫০ এবং অ্যাংকর ডাল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এর মাঝে দোকানভেদে ৫ থেকে ১০ টাকা দামের পার্থক্য রয়েছে।

কারওয়ান বাজারে পাইকারিতে বড় দানার মসুর ডাল ৯২, মাঝারি দানা ১১৬ ও ছোট দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১২১ থেকে ১২২ টাকা কেজি। ১০ দিনের ব্যবধানে কেজিতে ৫ টাকার মতো বেড়েছে বলে জানান বিক্রেতারা।

পাইকারিতে খেসারির ডাল বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকা কেজি। বাজারে তিন ধরনের মুগডাল পাওয়া যায়। এর মধ্যে ভালো মানের মুগ ডাল পাইকারিতে ১১৪ টাকা কেজি। অন্য মুগ ডালের কেজি ৭২ টাকা। পাইকারিতে এক সপ্তাহে মুগ ডালের দাম কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। আর অ্যাংকর ডালের কেজি ৪৯ থেকে ৫০ টাকা।

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, স্থানীয় পর্যায়ে ডালের উৎপাদন কম থাকায় চাহিদার বড় একটি অংশ আমদানি করতে হয়। আবার আর্ন্তজাতিক বাজারেও দাম কিছুটা বেশি। এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে বড় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতারা বলেন, মাসখানেক ধরেই ডালের দাম ধীরে ধীরে বাড়ছে। এখন দাম অনেক বেশি। অনেক দিন ধরে বাজারে ডালের সরবরাহে কিছুটা টান রয়েছে। ডেলিভারি কম, তাই দাম বাড়ছে। তবে এখন বাজারে নতুন ডাল উঠছে। এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে দাম কমে আসবে।

তারা জানান, ২৫ কেজির প্রতি বস্তা ভারতীয় মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ২২৮০ থেকে ২৩০০ টাকায়।

এ ছাড়া দেশি ডাল প্রতি বস্তা ২৮৮০ থেকে ২৯০০ টাকা ও ছোট দানার মসুর (আমদানি করা বা ক্যাঙ্গারু ডাল) ৩০০০ থেকে ৩০২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, পৌষ মাসে দেশে বৃষ্টির কারণে ডালের উৎপাদনে কিছুটা বিঘ্ন ঘটেছে। বিশেষ করে বৃষ্টির কারণে ডাল পরিপক্ব হতে দেরি হয়েছে। এতে আমদানির ওপর নির্ভরতা দীর্ঘায়িত হয়েছে। তবে কয়েক দিন ধরেই বাজারে নতুন দেশি ডাল উঠতে শুরু করেছে। ফলে শিগগিরই দাম কমে আসবে।

বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজি শফি মাহমুদ বলেন, ডালের দাম পাইকারি বাজারে কমতে শুরু করেছে। দুই সপ্তাহ আগের চেয়ে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা কমেছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আরো কমে যাবে। তবে পাইকারিতে দাম কমলেও অনেক সময় খুচরা বাজারে দাম কমতে দেরি হয়। তার দায় তো পাইকারি বাজারের না। খুচরা ব্যবসায়ীরা একটু বেশি লাভ করে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মোট ডাল উৎপন্ন হয় ৯ লাখ ৩১ হাজার ২১০ টন। এর মধ্যে খেসারি দুই লাখ ৯৬ হাজার ৯৮১ টন, মসুর দুই লাখ ৫৮ হাজার ৪৬২ টন ও মুগ দুই লাখ ৫২ হাজার ২৬৭ টন। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ডাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ লাখ দুই হাজার ৮৭ টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, মসুর, অ্যাংকর, ডাবলি ছোলাসহ সব ধরনের ডাল মিলিয়ে দেশে মোট বার্ষিক চাহিদা ২৬ থেকে ২৭ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে গড়ে উৎপাদন হয় ৯ থেকে ১০ লাখ টন। ফলে প্রতি বছর চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ ডালের ঘাটতি থাকে। এই ঘাটতি পূরণে ১৭ লাখ টনের মতো ডাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

এদিকে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে ডাল ও ছোলার দাম বস্তাপ্রতি ৩৫০-৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সেখানে অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা উন্নতমানের ছোলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি বস্তা তিন হাজার ১৫০ টাকা থেকে তিন হাজার ২০০ টাকায়। গত সপ্তাহে এ ছোলা বিক্রি হয় তিন হাজার টাকায়। অস্ট্রেলিয়ার মাঝারি মানের ছোলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি বস্তা তিন হাজার টাকার বেশি দামে। কয়েকদিন আগে তা বিক্রি হয় দুই হাজার ৬০০ টাকায়।

একইভাবে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ডালের দামও বাড়ানো হয়েছে। গত সপ্তাহে ভালোমানের মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৯৫ টাকা করে। প্রতিবস্তা (৫০ কেজি) বিক্রি হয় চার হাজার ৭৫০ টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১০৮ টাকা করে। আর প্রতিবস্তা বিক্রি হচ্ছে পাঁচ হাজার ৪০০ টাকায়। খেসারির ডাল প্রতি কেজি ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, রমজান সামনে রেখে কিছু পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বিভিন্ন উপজেলার পাইকারি ব্যবসায়ীরা ভোগ্যপণ্য মজুত করায় বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে চললে রমজানের আগে অনেক পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। তাই সরকারের উচিত এখনই বাজার তদারকির ব্যবস্থা করা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ইতোমধ্যে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করেছে। আমদানিকারকদের কারসাজিতে চিনির দাম বেড়েছে। সংকট দেখিয়ে সুপারপাম ও পামওয়েলের দামও বাড়ানো হয়েছে। অবৈধভাবে অধিক মুনাফার আশায় ছোলাসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীচক্র। প্রশাসন এ সিন্ডিকেট ভেঙে না দিলে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ট্যারিফ কমিশন ও সরকারি হিসাবে দেশে প্রতি মাসে ছোলার চাহিদা গড়ে ১২ হাজার টন। বছরের চাহিদা এক লাখ ৪৪ হাজার টন। তবে রমজানে চাহিদা দু-তিন গুণ বেড়ে যায়।

ইতোমধ্যে দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণে ছোলা আমদানি করা হয়েছে। দুবছর ধরে আমদানিকারকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ছোলা আমদানি করে আসছে। এতে কয়েক বছর ধরে দেশে ছোলার সংকট থাকছে না। এবারও স্থানীয় আমদানিকারক ছাড়াও দেশের কয়েকটি শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ ছোলা আমদানি করেছে। এসব ছোলা ইতোমধ্যে বাজারে প্রবেশ করেছে।

তবে দুদিনে বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ ছোলা কিনে নিয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ছোলার দাম বাড়ানো হচ্ছে।

এদিকে সরকার নির্ধারিত দামে চট্টগ্রামের কোথাও ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দামে ভোজ্যতেল বিক্রি করছে।

নগরীর পাইকারি বাজারগুলোয় নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে ভোজ্যতেল বিক্রি হতে দেখা গেছে। প্রতি লিটার খোলা পামসুপার তেল ১০৬-১০৮ টাকা ও খোলা সয়াবিন তেল ১১৫-১১৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার সাত টাকা বেশি দামে খোলা সয়াবিন ১২৭-১৩০ টাকা ও পামসুপার ১১২-১১৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!