• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

চতুর্মুখী সংকটে বিএনপি


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ১, ২০১৬, ১০:০২ এএম
চতুর্মুখী সংকটে বিএনপি

বিএনপি এখন রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পর দীর্ঘ নয় বছরেও নাজুক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারছে না বৃহৎ এই দলটি। দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের 'ভুল' সিদ্ধান্তে প্রধান বিরোধী দলের 'মর্যাদা' হারিয়েছে বিএনপি। মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি আদায়ের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। নাশকতা-বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় রাজপথেও কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অনুমতি দিচ্ছে না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। বিএনপি প্রতিষ্ঠার ৩৮তম বার্ষিকীতে এসে এমন চরম রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে দলটি। বিএনপির রাজনৈতিক ইতিহাসে আগে কখনো এমনটি দেখা যায়নি।

দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আপদকালীন সময়ে হাল ধরা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই বিএনপি এখন চরম বৈরী সময় পার করছে। দলটির ৩৮ বছরের মধ্যে প্রায় ৩৩ বছর ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তিনিই।

দলের দুই শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের নামে অসংখ্য মামলা মোকাবিলা, দলে অসন্তোষ দূরীকরণসহ একাদশ নির্বাচন পর্যন্ত রাজনীতির মাঠে টিকে থাকাই- বিএনপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের হাতে জিয়াউর রহমান নিহত হলে দলটি প্রথমবারের মতো সংকটে পড়ে। তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার সাময়িক সময়ের জন্য সরকার ও দলের হাল ধরলেও ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদের হাতে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। বিচারপতি সাত্তারের ক্ষমতাচ্যুতির পর বিএনপি প্রকৃত অর্থেই অস্তিত্ব-সংকটের মুখে পড়ে। মওদুদ আহমদসহ বিএনপির অনেক নেতাই জেনারেল এরশাদের সরকারে যোগ দেন। দলের সেই সংকটকালে ১৯৮৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিএনপির হাল ধরেন খালেদা জিয়া।

জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন’ ভূমিকা দলটিকে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আনে বলে মনে করা হয়। এরপর ২০০১ সালে আবারও ক্ষমতায় আসে দলটি। রাজনীতিতে আসার পর খালেদা জিয়া মোট চারবার গ্রেপ্তার হলেও ১/১১ এর মতো সংকটে পড়েনি বিএনপি। সর্বশেষ ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতির অভিযোগে পুত্রসহ গ্রেপ্তার হন তিনি। তবে সেই সময়ে চাপের মুখেও সংকট সামাল দিতে পেরেছে দলটি।

বিএনপির বর্তমান দলীয় কর্মকাণ্ড এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজনীতির মাঠে এর আগে কখনো এমন কোণঠাসা পরিস্থিতিতে পড়েনি দলটি। বর্তমানে দলটির চেয়ারপারন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট ৩০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি দুদকের করা মামলা, বাকি মামলাগুলোর মধ্যে হত্যা, নাশকতা ও পুলিশের কাজে বাধা দেওয়াসহ রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ রয়েছে।

এ ছাড়া দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৩০টির বেশি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৭টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। মানহানির একটি মামলায় লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। এরই মধ্যে সম্প্রতি অর্থ পাচারের এক মামলায় তারেক রহমানকে ৭ বছরের কারাদণ্ড ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এভাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের নামে অসংখ্য মামলা রয়েছে। খালেদা জিয়াসহ দলের শীর্ষ নেতারা আগামী একাদশতম নির্বাচনে অংশ নিতে পারেবন কি না- সেই বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন দলটির দায়িত্বশীলরা।

তবে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমদ আযম মনে করেন এই সংকট শুধু বিএনপির নয়, পুরো বাংলাদেশের। তিনি বলেন, ‘এই সময়টি শুধু বিএনপির জন্য নয়, স্বাধীনতার পর থেকে বিএনপি এবং বাংলাদেশ এতটা কঠিন সময় আর পার করেনি।’‘রাজনীতিকভাবে বিএনপিকে কোণঠাসা করার, তছনছ করে দেওয়ার এবং ধ্বংস করে দেওয়ার সব রকমের ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীরা অনেক অত্যাচার-নির্যাতন, হামলা-মামলা, গুম-খুনের শিকার হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত শক্তিশালী আছে।’

তিনি বলেন, ‘সংকটকালীন সময়ের মধ্যেও বিএনপি বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক ইস্যুতে ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও সুশাসনে ভূমিকা আছে। ৩৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে এসেও বিএনপির শপথ হচ্ছে, এ দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়া।’

বিএনপি বড় ধরনের ক্রাইসিসের (সংকট) মধ্য দিয়ে যাচ্ছে স্বীকার করে দলটির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমরা অনেক ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তবে বিএনপি তার লক্ষ্যে অভীষ্ট আছে। বিএনপির আদর্শ হচ্ছে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার।’

তিনি বলেন, ‘একটি মানুষের জীবনে যেমন উত্থান-পতন থাকে, তেমনি বিএনপির ওপর দিয়ে বিরাট চ্যালেঞ্জ যাচ্ছে। জাতি হিসেবেও আমরা একটি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।’

দলের এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি নতুন কমিটি ঘোষণা করেছে বিএনপি। এতে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি এবং বিভাজন ভুলে ঐক্য সৃষ্টি হবে বলে মনে করা হলেও কার্যত হয়েছে উল্টোটা। কমিটি নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে নির্বাহী কমিটি থেকে দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামেও। এই অবস্থায় দলের পারস্পরিক বিভেদ দূর করে রাজনীতির মাঠে ঘুরে দাঁড়াতে নেতা-কর্মীদের মাঝে আত্মবিশ্বাস ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিএনপির সামনে।

দলের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে সদ্য কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যানের পদ পাওয়া একজন নেতা বলেন, আগামী দুই বছরে বিএনপির আন্দোলনে যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই। সাংগঠনিক সেই শক্তিও দলের নেই। সেজন্য বিএনপি এখন আগামী নির্বাচনের দিকে টার্গেট করেই এগোচ্ছে। ‘গণতন্ত্র ফেরাতে’ বিএনপি এখন আন্দোলনের এমন পর্যায়ে আছে, যেখানে খুব বুঝে শুনে পা ফেলতে হচ্ছে। কারণ সরকারের চাপ তো আছেই, সেই সঙ্গে কমিটি গঠন নিয়ে দলের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্যের জায়গাটিও বেশ নড়েচড়ে গেছে।

দু’দফায় আন্দোলন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে ব্যর্থ বিএনপি শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সম্প্রতি সময়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন খালেদা জিয়া। তার ওই ডাকে বিভিন্ন দল জামায়াত ত্যাগের শর্ত দিলেও সেই বিষয়ে বিএনপির স্পষ্ট কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে সরে দাঁড়ায়। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী তার সঙ্গে বৈঠক করলেও সেই প্রক্রিয়া বেশি দূর এগোয়নি। বিএনপি দলে বহুমতের সম্মিলন ঘটানোর সামর্থ্য তো হারিয়েছেই, সেই সঙ্গে দলের ঐক্য বা অভ্যন্তরীণ সংহতি এখন বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে।

তবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পরামর্শক হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ মনে করেন বিএনপির মূল সমস্যা কনফিডেন্সের (আত্মবিশ্বাসের) অভাব। তিনি বলেন, বিএনপির কোনো সংকট নেই। যেটি আছে সেটি হচ্ছে, সেল্ফ কনফিডেন্সের অভাব। দলের মধ্যে আত্মবিশ্লেষণ করা দরকার। আত্মবিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হওয়া দরকার। বৃহৎ কোনো সংকটের মধ্যে নেই বিএনপি। সাহস করে শুধু উঠে দাঁড়ানো দরকার।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!