• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘মনপুরার পর শ’খানেকের বেশি ছবিতে প্রস্তাব পেয়েছি’


মিতুল আহমেদ, বিনোদন প্রতিবেদক নভেম্বর ১৬, ২০১৬, ০৮:২৩ পিএম
‘মনপুরার পর শ’খানেকের বেশি ছবিতে প্রস্তাব পেয়েছি’

থিয়েটার, ছোটপর্দা ও সিনেমায় সমানতালে দাপট দেখিয়ে চলা ক্যারেক্টার আর্টিস্টের নাম চঞ্চল চৌধুরী। থিয়েটার ও ছোট পর্দায় নিয়মিত অভিনেতা হিসেবে তার উপস্থিতি দেখা গেলেও বাংলাদেশের গত এক দশকের সবচেয়ে আলোচিত এবং একইসঙ্গে সুপারহিট সিনেমাগুলোর সাথেও জড়িয়ে আছে তার নাম। মনপুরা, মনের মানুষ, টেলিভিশন এবং সর্বশেষ আয়নাবাজি দিয়ে মাৎ করেছেন সিনেমা অঙ্গণ। প্রচলিত অর্থে নায়কের কোনো দর্শনধারি তার মধ্যে না থাকলেও শুধু তার অভিনয় দেখার জন্য আকালের দিনেও সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে হাজারও মানুষ। সব মাধ্যমেই অভিনয়ে সাবলিল এই জনপ্রিয় অভিনেতার সাথে ছবির জগৎ নিয়ে কথা বলেছেন মিতুল আহমেদ-

আপনি একজন নামকরা থিয়েটার কর্মী। টিভি নাটকেও দুর্দান্ত জনপ্রিয়। আবার সিনেমায়ও সুপার হিট। অভিনয়ের এই তিন মাধ্যম থেকে সবচেয়ে বেশি স্বস্তি কোথায় পান আসলে?
সব মাধ্যমেই সমান স্বস্তি পাই আমি। কম্পেয়ার করতে চাই না। তিনটা মাধ্যই আসলে আলাদা আলাদা মিডিয়া। থিয়েটারের হিসাবটা একেবারে সরাসরি। মঞ্চে এবং মঞ্চের সামনের মানুষের সাথে একেবারে মুহূর্তেই ভাব বিনিময় হতে পারে। যা অন্য দুই মাধ্যমে নাই। এখানে আমি আমার দর্শকের রিয়েকশনটাও সাথে সাথে পেয়ে যেতে পারি। আর টেলিভিশনটাও দুর্দান্ত। ড্রয়িং রুমে বসে মানুষ আমার নাটক দেখে এটাতো আমার জন্য সৌভাগ্যের। কখনো কখনো কোনো নাটকের জন্য অনেকে অপেক্ষাও করেন। আর ফিল্মের ক্ষেত্রে বলবো এটাতো বিশাল মাধ্যম। প্রত্যেক অভিনেতারই ফাইনাল ডেস্টেইনেশন থাকে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার। স্বভাগতভাবে তিন মাধ্যমেই ভিন্নতা আছে, কিন্তু আমি এগুলোকে আলাদাভাবে দেখি না। কারণ শেষ পর্যন্ত আমি অভিনয় করতেই ভালোবাসি।  

টিভি নাটক আর সিনেমার জনপ্রিয়তা কি থিয়েটার কর্মী হিসেবে চঞ্চল চৌধুরিকে ভাবায়?
কখনো কখনো ভাবায়। আসলে আমি থিয়েটার করতে চাই। সময়ের জন্য পারছি না। টিভি নাটকে এতো সময় দিতে হয় যে, সবকিছু একসাথে কন্টিন্যু করা যায় না। এর জন্য খারাপ লাগা কাজ করে। কিন্তু  থিয়েটার করে যদি জীবন চালানো যেতো, খেয়ে পরে বাঁচা যেতো তাহলে হয়তো আমি থিয়েটারটাই ঠিকঠাকভাবে করতাম। যেহেতু থিয়েটার করে জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা নেই, তাই আমাকে এক প্রকার বাধ্য হয়েই টিভি বা সিনেমায় অভিনয় করতে হয়।  

মনপুরা, টেলিভিশন এবং আয়নাবাজি; গত এক দশকের সবচেয়ে আলোচিত এবং সুপারহিট বাংলা সিনেমা। যেগুলোর প্রত্যেকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র আপনি। এই সফলতা কীভাবে এনজয় করেন?
সফলতা বলতে আমি প্রত্যেক বছর ভালো গল্পের, ভালো নির্মাণের ছবি করতে চাই। আর সেটা করার জন্য আমি বছরের পর বছর অপেক্ষা করি। এই যেমন মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর টেলিভিশনের পর চার বছর আমাকে অপেক্ষা করতে হলো ‘আয়নাবাজি’র জন্যে। এই যে অপেক্ষা এইটা মধুর। একটা ভালো গল্পের ছবির জন্য আমি আরো বেশিদিন অপেক্ষা করতে পারবো। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন যেসব ছবিকে সুপারহিট বলছেন বা জনপ্রিয় বলছেন আমি কিন্তু সেগুলো আমার ভালোলাগা থেকে করেছি। কারণ এই কাজগুলোই আমি আসলে করতে চাই। আর আমার সাথে যায় বলেই কিন্তু অন্যদিকে সুযোগ থাকলেও নিজেকে বেচে দেইনি। জনপ্রিয়তাটা আমি টাকা কামানোর জন্য ব্যবহার করিনি। মনপুরা’র জনপ্রিয়তা বেচে দেইনি। বা অন্য ছবিতে অভিনয় করে যে দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছি তা যেথায় সেথায় বিকিয়ে দেইনি। মনপুরা, টেলিভিশন বা আয়নাবাজি ছবিতে অভিনয়ের পর বহু সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছি। কিন্তু তা করেনি।    

আপনিতো মিডলরোড বা একটু ভিন্নধর্মী সিনেমায় অভিনয় করে অভ্যস্ত। কিন্তু ধরেন একেবারে ফরমুলা টাইপ ছবিতে আপনাকে প্রস্তাব করা হলো, তখন কি সেগুলো অভিনয় করতে রাজি হবেন?
প্রথমত আমি কোনো ধারায় বিশ্বাস করি না। আমার কাছে দুইটা জিনিষ মনে হয়। একটা ভালো ছবি, আরেকটা মন্দ ছবি। গল্প নির্ভর বাস্তবধর্মী সিনেমাগুলোকে আমি ভালো ছবি মনে করি। একেবারে নিজেদের তৈরি করা টাটকা গল্প। আমাদের প্রচুর ভালো গল্প ছবিতে দেখানোর মানুষ আছে চারদিকে। তরুণ গল্পকার নির্মাতাদের মাথায় চমৎকার আইডিয়া আছে। এছাড়াও আমাদের মাটির গল্প, ফোক, মুক্তিযুদ্ধ কতোসব অসাধারণ বিষয় আছে এইগুলো বাদ দিয়ে আমি কেন হলিউড-বলিউডের নকল করা ছবিতে অভিনয় করতে যাবো। আর ওইগুলোতে অভিনয় করলে ‘আমি’র সত্ত্বাটাই বা কোথায় থাকে! এইসব কারণেই আসলে আমি বরাবরই ভালো আর বাস্তবধর্মী গল্পে অভিনয় করতে চাই। আর তার জন্য যদি বছরের পর বছর আমার অপেক্ষা করতে হয় তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু কখনোই এটা কল্পনাতেও আনতে পারি না কোনো একটা সিনেমায় রাস্তায় নায়িকার সঙ্গে নেচে গেয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করবো। আসলে আমার টার্গেটটা হচ্ছে সারা বাংলাদেশের মানুষ। যারা সিনেমায় নিজেদের গল্প দেখে হাসবে কাঁদবে, অভিনয় খারাপ হলে আমাকে গালি দেবে। ভালো হলে প্রশংসা করবে। আমি এরমধ্যেই থাকতে চাই।  

চঞ্চল চৌধুরী

তার মানে আপনি নাচা-গানা নির্ভর সিনেমাতেও অফার পেয়েছেন?
অবশ্যই পেয়েছি। আয়নাবাজি করার পরইতো এরকম অন্তত আট থেকে দশটা সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব পেলাম। আর গিয়াসউদ্দিন সেলিমের মনপুরা করার পর প্রায় একশো সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলাম। কিন্তু আমিতো জানি আসলে আমার ভালো লাগাটা কোথায়!

দীর্ঘদিন পর পর হঠাৎ হঠাৎ একটা ছবি দেখতে সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ। তো আপনি কি মনে করেন বিস্তর গ্যাপে গ্যাপে একটা হিট ছবি দিয়ে বাংলা ছবির পরিবর্তন সম্ভব?
সম্ভব। তবে গ্যাপটা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা জরুরি। অন্তত যাদের ছবি দেখতে মানুষ সিনেমা হলে যায় তাদের বছরে দুইটা ছবি করা উচিত। সেগুলো হবে সুস্থ ধারার ছবি। আমাদের অনেক মেধাবী নির্মাতা আছেন, সিনেমাটোগ্রাফার আছেন। ভালো গল্প বলার মতো অনেক মেধাবী তরুণ গল্পকারও আছেন। এখন শুধু শিক্ষিত প্রডিউসার দরকার। কারণ ইন্ডাস্ট্রির ভালো মন্দের বেশির ভাগটাইতো আসলে নির্ভর করে অর্থ লগ্নিকারের ওপর। এখন সেই মানুষটার যদি শিল্পবোধই না থাকে তাহলে কীভাবে তরুণ নির্মাতা, গল্পকাররা সিনেমায় ভালো গল্প বা আইডিয়া নিয়ে আসবেন? বাংলা ছবিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হলে আগে যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষিত প্রডিউসার আসা জরুরি। পয়সা থাকলেই যে সবকিছু হয় না এটাও অনেকের বুঝতে হবে। যদি এই বোধ বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে আসে তাহলে আলু পটল বিক্রেতার আর ছবি প্রডিউসারের সুযোগ থাকবে না। কাড়ি কাড়ি টাকা দিলেই আর প্রডিউসার হতে পারবে না। শিল্পসমঝদার মানুষের প্রযোজনায় এগিয়ে আসা উচিত। আর তাহলেই মান সম্মত প্রচুর ছবি আমাদের নির্মাণ হওয়া সম্ভব। আর এমনটা হলে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায়শই যে নকল ছবির অভিযোগ পাওয়া যায় সেগুলোও আর থাকবে না।

আর একটা কথা। এখানেতো একটা ভালো ছবি বানাইলেই হয় না। প্রচুর সিন্ডিকেশন আছে। আমরাতো প্রথমে ‘আয়নাবাজি’র জন্য মাত্র কুড়িটার মতো সিনেমা হল পেয়েছিলাম। ফলে বাংলা ছবির ভালোর জন্য এগুলো নিয়েও ভাবাটা জরুরি। আর দর্শক শ্রেণিরও এগিয়ে না আসা ছাড়া ভালো কিছু সম্ভব না। কারণ শেষ পর্যন্ত তারাই একটা সিনেমার শক্তি। দর্শক সিনেমা হলে না গেলে একটা সিনেমা যতো ভালোই হোক তা চালানো সম্ভব না। এইতো ‘আয়নাবাজি’ পাইরেসিতে কতো মানুষকে অংশ নিতে দেখলাম। অনেকে অতি উল্লাসে নিজের ফেসবুকে ছবিটি শেয়ার দিয়েছেন। এটা কাম্য নয়। আমরা কিন্তু টাকা নিয়ে কেউ ‘আয়নাবাজি’ সিনেমাটি করেনি এই অর্থে যে, যদি নিজের পারিশ্রমিক নিতাম তাহলে টানা ত্রিশ-চল্লিশ দিন যে কাজ করেছি সেটার পারিশ্রমিক কতো হতো হিসেব আছে! আমরা এমন ছাড় দিয়েছি সবাইকে একটা ভালো ছবি উপহার দেয়ার জন্যই। এখন যদি দর্শক সিনেমা হলে না গিয়ে ইন্টারনেটে বিনা পয়সায় ছবিটি দেখে তাহলে কি আবার সেই প্রযোজক একটা ভালো গল্পের ছবিতে টাকা লগ্নি করার মানসিকতা পাবেন? ফলে সবার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে বাংলা সিনেমার সুদিন ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। 

ছবি নকলের বিষয়টি যেহেতু আসলো, তাহলে বলেই ফেলি। আপনার ‘আয়নাবাজির বিরুদ্ধেওতো একটা কোরিয়ান সিনেমার নকলের অভিযোগ আনলেন অনেকে...? 
কেউ ঈর্ষাকাতর হয়ে অপপ্রচার চালিয়েছে। একজন মানুষের ভাবনার সাথে অন্যের ভাবনা একটু আধটু মিলে যেতেই পারে। এই মুহূর্তে আমি যা চিন্তা করছি, হয়তো একই চিন্তা বহু দূরে বসে কেউ করছে। এমনটা কি হতে পারে না? কিন্তু সেটাকেই অনেকে ইন্টেনশনালি আয়নাবাজির বিরুদ্ধে অপপ্রাচারের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। সবারই আসলে শত্রু, মিত্র আছে। হয়তো কেউ আমাদের শত্রু ভেবে এমনটা করতে পারে। এইসব বিষয় নিয়ে আমার বলার কিছু নাই। সোশাল সাইটে এই বিতর্ক আমি দেখেছি খুব খেয়াল করে। তবে আশার ব্যাপার হচ্ছে মানুষ আমাদের ওপর আস্থা রেখেছে। হয়তো দেখা গেল পাঁচশো কমেন্টের ভেতর মাত্র দুইটা কমেন্ট নেগেটিভ। যারা বিতর্ক তৈরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। এখনও যেসব সিনেমা হলে ‘আয়নাবাজি’ চলছে সেগুলোতে মানুষ যাচ্ছে। তৃপ্তি নিয়ে ছবিটি দেখছে।   

চঞ্চল চৌধুরী

যাই হোক, ‘আয়নাবাজির আয়না চরিত্রটির সমাজ বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এক হিরো। আয়না হিসেবে তার প্রশ্নের ব্যাখ্যা কীভাবে দিবেন?
তারা কি বলছে, বা কারা বলছে আমি সেদিকে যাচ্ছি না। শুধু এটুকু বলি, যারা চরিত্র বিশ্লেষণে বসেছেন তাদের সেইটুকু যোগ্যতা আসলে নেই। পৃথিবীতে কোনো শিল্প সৃষ্টি হয় নাই যার সমালোচনা হয়নি। কিন্তু সেই সমালোচনাটা যোগ্য মানুষ করলে মেনে নেয়া যায়। যারা আয়না চরিত্রের সমাজ বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আমিতো মনে করি তাদের সেই যোগ্যতাই এখনও তৈরি হয়নি। আমিতো তাদের একেবারে সাধারণ কাতারে ফেলতে চাই এবং বিশ্বাস করি, এগুলো তারা নিজেকে শুধুমাত্রই জাহির করার জন্য করছেন। সতেরো বছর ধরে আমি এই লাইনে আছি, কার কতোটুকু যোগ্যতা তা আমি টের পাই। সিনেমা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে বা কোনো অসঙ্গতি খুঁজে পেলে তাদের যদি সেই যোগ্যতা থাকতোই তাহলে পারসোনালি অমিতাভকে প্রশ্ন করতে পারতো। আমাকেও বলতে পারতো। হয়তো আমরা তার প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারতাম। এই পরিমিতিবোধ যে কারো থাকা উচিত!

মনপুরা, টেলিভিশন এবং আয়নাবাজি। তিনটা সিনেমায় বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আপনাকে যদি বলা হয় তিনটা ছবির মধ্যে একটা বেছে নিতে, তখন কোনটা আপনি বেশি গুরুত্ব দিবেন? এখানে আশা রাখি আপনি ডিপ্লোমেটিক উত্তর দিবেন না। সরলভাবে বলেন...
ডিপ্লোমেসির কিছু নাই। আমি যে সিনেমায় নাম লেখাই সেগুলো একেবারে ভালো লাগা থেকেই। ফলে এইদিক থেকে সব ছবিই আমার কাছে প্রিয়। কিন্তু বেস্ট অ্যাক্টিং যদি বলি তাহলে সন্দেহাতীতভাবে‘আয়নাজি’। মনপুরা সুপারহিট ছবি হিসেবে ঠিক আছে। ওই সময়ে মানুষের মধ্যে ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল। সবই ঠিক আছে, কিন্তু তার চাইতেও আয়নাবাজি ছবিটি আমার কাছে বেশি গুরুত্বের।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিএল

Wordbridge School
Link copied!