• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপিকে চাপে রেখে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আ.লীগ


নিজস্ব প্রতিবেদক মার্চ ১৮, ২০১৭, ১১:৪১ এএম
বিএনপিকে চাপে রেখে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আ.লীগ

ঢাকা : ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়’, ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন দিতে হবে’ কিংবা ‘প্রয়োজনে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাব না’- বিএনপি নেতারা এরকম নানা কথা বললেও এগুলো পুরোপুরি বিশ্বাস করছেন না ক্ষমতাসীনেরা।

আওয়ামী লীগের ধারণা, মুখে এখন যাই বলুক না কেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো বিএনপি আগামী নির্বাচন বর্জন করবে না। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদের বেশিরভাগেরও অভিন্ন বিশ্বাস। ১৪ দল ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বাইরে থাকা নিবন্ধিত দলগুলোও মনে করে, আর যাই হোক, যে কাঠামোয়-ই হোক না কেন-বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে। বিএনপি একাদশ সংসদ নির্বাচনে আসছে, এমনটা ধরে নিয়েই আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, জাতীয় পার্টি (জাপা) এবং ২০ দলের বাইরের উল্লেখযোগ্য দলগুলো আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এদিকে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপিকে চাপে রেখে নির্বাচনমুখী করার কৌশল হাতে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ জন্য কিছু ছকও কষছে ক্ষমতায় থাকা এ দলটি। তারই অংশ হিসেবে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় দুই বছর আগ থেকেই নির্বাচনী প্রস্তুতির ঢাকঢোল পেটাচ্ছেন ক্ষমতাসীনেরা। কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনী বার্তা নিয়ে তৃণমূলে ছুটছেন। গ্রামাঞ্চলে উঠোন বৈঠকের মাধ্যমে নির্বাচনী আমেজ তৈরি করছেন।

ইতোমধ্যে নির্বাচনী মাঠ গরম করতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করছেন। ওই সমাবেশে আগামী নির্বাচনে নৌকায় ভোট চাচ্ছেন তিনি। সামনে আরো বেশ কয়েকটি সমাবেশে অংশগ্রহণ করবেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। নেতারা মনে করছেন, ‘আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে এবং অস্তিত্ব রক্ষার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে’। এই ইস্যুকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে বিএনপিকে বাগে আনার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীনেরা। ইতোমধ্যে সেভাবেই আটঘাট বেঁধে প্রচারণায় নেমেছে আওয়ামী লীগ।

গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি-নেতৃত্বাধীন জোট অংশগ্রহণ না করায় দেশ-বিদেশে নানা সমালোচনার মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ। ১৫৩ জন এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে অংশগ্রহণমূলক আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ এখনো রয়েছে। এবার সেই বিতর্ক এড়িয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য কাজ করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।

জানা গেছে, বিএনপির বিকল্প হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন নতুন জোটকে শক্তিশালী করার জন্য সরকারি দলের তৎপরতা থাকলেও কোনোভাবেই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না তারা। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক মহল থেকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল উপাধি পেয়েছে জাতীয় পার্টি। ফলে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে হলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে সরকারি দলকে। এটা বুঝতে পেরে তারা আগে থেকেই জাতীয় নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু করেছে এবং বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য রাজপথে বেশ কয়েকটি ইস্যু নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যেমন কারো জন্য থেমে থাকেনি, এবারো যদি বিএনপি না আসে, নির্বাচন থেমে থাকবে না। আমরা আশা করছি, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে। নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়ার মতো ঝুঁকি বিএনপি নেবে বলে আমরা মনে হয় না। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন বক্তব্যকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে বিএনপি।

সম্প্রতি দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো একই কায়দায় ছলচাতুরী করে, প্রতারণা করে সরকার গোল করতে চায়।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) আইনের ৯০ এইচ (১) (ই) ধারা অনুযায়ী বিএনপি এবার নির্বাচনে আসতে বাধ্য। ওই ধারা বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করবে। কেননা এ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো দল যদি পরপর দুইবার নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে ওই দলটিকে শুনানিতে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে। কমিশনের কাছে দলটির বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না হলেই কেবল তারা নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এ অবস্থায় দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি নিবন্ধন বাঁচাতে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য লে. জেনারেল (অব:) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হবে কি হবে না, এটা আওয়ামী লীগ বলার কে। তিনি বলেন, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল, গণমানুষের দল, মুক্তিযুদ্ধের দল। গণতন্ত্রের প্রয়োজনেই বিএনপির প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ফলে নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে, নিঃশেষ হবে এমন বক্তব্যের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। মাহবুবুর রহমান বলেন, অতীতের সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনেও বিএনপি অংশগ্রহণ করবে, তবে এ জন্য সরকারকে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে হবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম মুখপাত্র ড. হাছান মাহমুদ এমপি  বলেন, আমরা চাই সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হোক। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র আরো সুসংহত হবে। বিএনপি গত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে যে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আমরা আশা করি এবার সেই রকম সিদ্ধান্ত নেবে না। নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতন্ত্রের ভিতকে আরো মজবুত করার জন্য বিএনপি কাজ করবে।

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যে করেই হোক আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনটা জিততে হবে। কারণ, গত দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগকে নানা ঝড় সামলাতে হয়েছে। পরের মেয়াদে নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন করা যাবে। ওই নেতা বলেন, এখন আওয়ামী লীগের মূল সমস্যা অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও হানাহানি। সারা দেশে কর্মী সমাবেশ করার মূল লক্ষ্য হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে নির্বাচন প্রস্তুতির কাজ শুরু করা।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও অস্তিত্ব নির্ভর করে সেই দলে জনগণের অংশগ্রহণ, আস্থা ও ভালোবাসার ওপর। বিএনপি দীর্ঘ দিন ধরে এ দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এখনকার বিএনপি অনেক শক্তিশালী।

তিনি বলেন, ১৯৮৬ ও ’৮৮ সালে যখন নির্বাচন করেনি তখনো এই রকম বক্তব্য উঠেছিল, বিএনপি নির্বাচনে না গেলে নিঃশেষ হয়ে যাবে, অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে; কিন্তু ১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিএনপি শুধু একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, ক্ষমতায়ও এসেছে। আজকেও যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে বৈধতার ক্ষেত্রে হয়তো নিবন্ধন বাতিল হয়ে যেতে পারে, এটা আওয়ামী লীগ করতেও পারে। তবে বিএনপি একটি বড় দল, নির্বাচনে অংশ না নিলেও অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে এটা গ্রহণযোগ্য কোনো মত নয়। আওয়ামী লীগের চেষ্টা হচ্ছে ছলে বলে কলে কৌশলে, দ্বিধা বিভক্ত করে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো।

ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, দেশে যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় আর ওই নির্বাচনে বিএনপি যাবে না এ ধরনের চিন্তা করে, এটা যুক্তিসঙ্গত হবে না। তবে কোনোভাবেই সরকারের পাতা ফাঁদে বিএনপির পা দেয়া উচিত হবে না।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!