জৌলুশ হারিয়েছে ২০০ বছরের পুরোনো রানীর মা’র দিঘি

  • ঈশ্বরগঞ্জ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৪, ২০২৫, ০৬:০৮ পিএম

ঈশ্বরগঞ্জ : রহস্যঘেরা একটি নাম 'রানীর মা'র দিঘি'। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার অন্যতম প্রাচীনতম নিদর্শন।  ২৮৬.১৯ বর্গ কিলোমিটারের উপজেলার সবাই কমবেশি পরিচিত 'রানীর মা'র দিঘি' নামটির সাথে। ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটারের পথ হাঁটলেই দেখা মিলবে রানীর মায়ের দিঘির। তবে কালের বিবর্তনে এটি এখন ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। 

এক সময়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ও ১২ মাস পানিতে টইটম্বুর থাকা দিঘিটি হারিয়েছে তার আপন রূপ। অনেকেই জানে না কেন এটির নাম 'রানী মার দিঘি' রাখা হয়েছিল। এই দিঘিটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অবাক করা কাহিনী। কবে এই দিঘি খনন করা হয়েছে, তা নিয়ে দালিলিক প্রমাণ না থাকলেও দিঘি সৃষ্টির ইতিহাস নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন লোকগাঁথা।

জনশ্রুতি রয়েছে, বর্তমান ঈশ্বরগঞ্জ পৌর এলাকার শিমরাইল গ্রামে রাজচন্দ্র বিশ্বাস নামে একজন বাস করতেন। তিনি পার্শ্ববর্তী বর্তমান গৌরীপুর উপজেলার তৎকালীন জমিদার বাড়িতে  (সম্পত্তি দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত) রাজ কর্মচারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সে সময় রাজচন্দ্র বিশ্বাস ছিলেন এলাকার অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি। কথিত আছে, আনুমানিক ১৮২০-২৫ সালের দিকে গৌরীপুরের তৎকালীন জমিদার রাজচন্দ্র বিশ্বাসকে ১০০ শতাংশ জমির ওপর দিঘিটি খনন করেন। যার ৯০ শতাংশে দিঘি বাকি ১০ শতাংশে দিঘির পাড়। 

[242462]

সরেজমিন পরিদর্শন করে জানা গেছে, বর্তমানে ক্রয়সূত্রে মালিক হিসেবে দুইজন ব্যক্তি এই দিঘিতে মাছ চাষ করেছেন। তাদের একজন মো. শিমুল মিয়া (২৫)। তিনি বলেন, আমার বাবা আজিম উদ্দিন  এই দিঘির ২৫ শতাংশ ক্রয় করেছেন। এখন আমরা দিঘিতে যৌথভাবে মাছ চাষ করেছি।

যেভাবে নামকরণ হয় রানীর মা'র দিঘি : এলাকার প্রবীণ ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সূত্রে জানা গেছে, রাজচন্দ্র বিশ্বাস বিয়ে করেছিলেন স্ব-রজনী বিশ্বাসকে। তাদের একমাত্র মেয়ে ছিল রানী। রানীর বিয়ে হয়েছিল ত্রিশাল উপজেলার বালিপাড়া এলাকায়। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তের সময়ে রানীর স্বামী রানীকে নিয়ে ভারতে চলে যান। ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর ১৯৫৭ সালের জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির মধ্য দিয়েই জমিদার বাড়ির জমিদারীর সমাপ্তি ঘটে। এতে রানীর বাবা রাজচন্দ্র বিশ্বাস দীর্ঘদিন জমিদারের বাড়িতে কাজ করার সুবাদে তৎকালীন সময়ে অনেক ধনসম্পদের মালিক বনে যান। ফলে একদিন রামচন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে ডাকাত দল হানা দেয়।  

নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে আহত ২,  একজনের পা বিচ্ছিন্ননাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে আহত ২,  একজনের পা বিচ্ছিন্ন
পূর্বপুরুষদের বরাত দিয়ে স্থানীয়দের ভাষ্য, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার আনুমানিক ৫-৬ বছর পর রানীর মা স্ব-রজনী বিশ্বাসকে ডাকাত দল মেরে ফেলে। তখন থেকেই এলাকাবাসী স্ব-রজনী বিশ্বাসের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দিঘিটির নাম রাখেন 'রানীর মা'র দিঘি'।

স্থানীয় আব্দুর রাশিদ (৭০) বলেন, ‘রানীর মায়ের দিঘি এতোটাই গভীর ছিল যে, কখনও এই দিঘির কূল-কিনারা কেউ পায়নি। এখন আর সেই গভীরতা নেই।’ তিনি আরও বলেন,  ‘বাপ-দাদার মুখ থাইক্যা হুনছি (শুনছি) এলাকায় কোনো মেজবানি হইলে এই পুসকুনির (পুকুর) সামনে আইয়া চাইলে থালা-বাসন পাওয়া যাইত (যেত)।’

[242457]

এই দিঘিটি পরিচিত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো— আগে এই দিঘিতে আশেপাশের বিভিন্ন উপজেলার মানুষ ভাড়ায় বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে আসতো।’ 

দিঘির পাশেই বাড়ি মানিক দত্তের। তিনি বলেন, ‘ছোট বেলায় দেখছি এই দিঘির একটা মাছ দিয়ে একটা বিয়ের লোকজন খাওয়ানো যেত।

রিদওয়ান আহমেদ রিজন (২৮) জানান, বাপ-দাদা ও এলাকার মুরুব্বিদের মুখে শুনেছি এই দিঘিতে নাকি স্বর্ণের বড় বড় ডেগ ভেসে উঠতো। প্রাচীন এই দিঘির পানি শত চেষ্টা করেও কেউ শুকাতে পারতো না। তবে এসব কথাকে সচেতন মানুষেরা গুজব বলে উড়িয়ে দেন। 

স্থানীয় নিবেদন দত্ত (৭০) বলেন, অনেক ইতিহাস রয়েছে দিঘির পিছনে। আমাদের গ্রামে আগে নলকূপ ছিল না। মানুষ এই পুকুরের পানি সকল কাজে ব্যবহার করতো। অনেকেই এখানে পূণ্যস্নান করতো। এই দিঘির বয়স ২০০ বছরেরও বেশি হবে।

দিঘি নিয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম লিংকন বলেন, রানীর মা’র দিঘি অনেক পুরোনো একটি দিঘি। মুরুব্বিদের মুখে এই দিঘি নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। কিন্তু বর্তমানে দিঘিটি তার পুরোনো ঐতিহ্য হারিয়েছে।  

উল্লেখ্য, এমন শতশত গল্পগাঁথা নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে টিকে রয়েছে জৌলুশ হারানো ঈশ্বরগঞ্জের রানীর মার দিঘি। প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে উল্লেখ করে বর্তমান মালিকদের তত্ত্বাবধানেই এই দিঘিটির সৌন্দর্য ও ইতিহাস সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

এমটিআই