সংকটে বৈদেশিক বাণিজ্য

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ২৬, ২০২১, ০৩:১০ পিএম

ঢাকা : টাকার বিপরীতে ক্রমেই বাড়ছে ডলারের মূল্য। অন্যদিকে জাহাজ ও কন্টেইনার সংকটে দফায় দফায় বাড়ছে পণ্য পরিবহন ব্যয়। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের সংকটের কারণেও বাড়ছে দাম। এসব কারণে কোনো কোনো পণ্যের দাম ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। ত্রিমুখী এই সংকটে পড়েছে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য।

ডলারের দাম বৃদ্ধিতে রপ্তানিকারকরা কিছুটা সুবিধা পেলেও আমদানিকারকরা পড়েছেন বিপাকে। এর ফলে আমদানি পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, মুদ্রাবাজারে ডলারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।  খোলাবাজারে ডলারের দাম ৯০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করছে ৮৮ টাকার ওপরে। তবে ব্যাংকগুলো সহসাই কেনা যাচ্ছে না ডলার। যদিও আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে গত এক সপ্তাহে ডলারের দর বাড়েনি; ৮৫ টাকা ৬৫ পয়সা দরেই বিক্রি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে করোনার প্রকোপ কমে আসায় ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রুতই সচল হচ্ছে। দেশে বিপুল পরিমাণে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর। এর ফলে রিজার্ভেও টান পড়েছে। বাজার স্বাভাবিক রাখতে ডলার বিক্রি করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দাবি, আমদানি বাড়ায় ডলারের চাহিদা বেড়েছে ঠিকই কিন্তু ডলারের কোনো সংকট নেই। পর্যাপ্ত ডলার আছে। চাহিদা পূরণে বাজারে ছাড়া হচ্ছে।

এদিকে জাহাজ ও কন্টেইনার সংকটের কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে দেশের আমদানি রপ্তানি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্বজুড়েই এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। রপ্তানিকারকরা দ্রুত পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং আমদানিকারকদের বিদেশ পণ্য আনতে বেগ পেতে হচ্ছে।

আমদানিকারকরা জানান, জাহাজ ও কন্টেইনার সংকটে অনেক দেশে আটকা পড়েছে তাদের পণ্য। এতে ব্যাংক ঋণের সুদসহ আমদানি খরচ বাড়ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ ফুড স্টাফ ইমপোর্টার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফিসা) সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ইকুয়াল মার্কেটিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুহ আজম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমরা থাইল্যান্ড থেকে বিভিন্ন ফুড আইটেম আমদানি করে থাকি। আগে যে কন্টেইনার ভাড়া ছিল ৭০০ ডলার সেটা এখন ৩ হাজার ডলারে পৌঁছেছে।

এছাড়া, আমাদেরকে যেহেতু ডলারে পেমেন্ট করতে হয়, এ কারণে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণেও পণ্য আমদানির খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়া, বিভিন্ন প্রোডাক্টের সংকট রয়েছে। পেলেও দাম বেড়েছে ১৫-২০ শতাংশ দাম বেড়ে গেছে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি স্লো হয়ে যাওয়ায় শিপিং এজেন্সিগুলো তাদের কন্টেইনারবাহী জাহাজের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছিল। সেই জাহাজগুলো এখনো তারা অপারেশনে আনেনি। তারা ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনার আগে যেসব কন্টেইনারের ভাড়া তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার ডলার ছিল সেগুলো এখন ১৫ হাজার ডলারে পৌঁছেছে।

জাহাজ ও কন্টেইনার সংকট প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সংকট থেকে উত্তরণে আমাদের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা রাখতে হবে। তাদেরকে এ নিয়ে বসা দরকার।

আমরা সরকারকে বলেছি যে, আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনে বাংলাদেশের নিজস্ব জাহাজযুক্ত করার বিষয়ে। যাতে যে কোনো দেশে বাংলাদেশের পতাকাবাহী নিজস্ব জাহাজে আমরা পণ্য পরিবহন করতে পারি এবং সেটা সম্ভব। এ ব্যাপারে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। হয়তো দ্রুতই সমাধান হবে।’

সিদ্দিকুর রহমান আরো বলেন, ‘জাহাজের ভাড়া বাড়লেও আমাদের পণ্যের দাম সেভাবে বাড়েনি। পণ্যের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। হয়তো কেউ পাচ্ছে আবার কেউ পাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি সমস্যা সমাধানে।’

পণ্য পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে অনেক ক্ষুদ্র রপ্তানিকারক সাময়িকভাবে বিদেশে পণ্য পাঠানো কমিয়ে দিয়েছেন কিংবা বন্ধ রাখছেন। কিন্তু বিদেশে যাদের নিজস্ব শো-রুম রয়েছে তাদেরকে বাধ্য হয়ে বেশি খরচেই পণ্য পাঠাতে হচ্ছে।

শাকিল এন্টারপ্রাইজ-এর স্বত্বাধিকারী কে এস শাকিল জানান, কানাডার টরেন্টোয় তাদের পারিবারিকভাবে পরিচালিত একটি সুপারশপ রয়েছে। যেটি তার ছোট ভাই পরিচালনা করছেন।

বাংলাদেশ থেকে তিনি সেখানে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য পাঠান। গত জুলাইয়ে পণ্য পাঠানোর চেষ্টা করলেও পরিবহন খরচ তিন-চারগুণ বেড়ে যাওয়ায় তিনি সাময়িকভাবে তা স্থগিত রাখেন ভাড়া কমলে পাঠাবেন এই আশায়। কিন্তু কমার বদলে উল্টো আরো বেড়েছে ফ্রেইট। তাই এখন তাকে বর্ধিত ভাড়ায় পণ্য পাঠাতে হচ্ছে।

শাকিল বলেন, ‘চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৪০ ফুটের কন্টেইনারের ভাড়া ছিল ৭ হাজার ডলার। বর্তমানে সেটির ভাড়া ১৪ হাজার ৭০০ ডলার।’

অন্যদিকে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণেও জাহাজের ভাড়া বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কয়লা তোলা বন্ধ আছে অ্যামোনিয়ার অভাবে। জাহাজের অভাবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেনা এই গ্যাস আনা যাচ্ছে না।

এছাড়া,  বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি আমদানিতেও বিপাকে পড়তে হচ্ছে সরকারকে। এলএনজি কেনা হলেও দেশে আনতে মিলছে জাহাজ। একই ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে কয়লা পরিবহনের  ক্ষেত্রেও।

সরকারের জ্বালানি বিভাগ বলছে, তেল, গ্যাস, কয়লার মতো জ্বালানি পরিবহনকারী সমুদ্রগামী জাহাজগুলো বিশেষভাবে তৈরি। করোনার প্রকোপ কমে আসার পর চীনসহ বিশ্বের বড় দেশগুলো জ্বালানি মজুত ও ব্যবহারে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র ও দরিদ্র দেশগুলো পড়েছে সংকটে।

এছাড়া জাহাজ সংকটে ব্যহত হচ্ছে দেশে খাদ্যপণ্য আমদানিতেও।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘সেপ্টেম্বরে আমরা রাশিয়া থেকে ২ লাখ টন গম সরকারিভাবে ক্রয় করি। তখন টন প্রতি দর ছিল ২৫০ ডলার। এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা আরো ২ লাখ টন গম আনার সিদ্ধান্ত জানাই। কিন্তু তখন জাহাজ মিল ছিল না।

দুই সপ্তাহ পর যখন জাহাজ মিলল, তখন দর বেড়ে দাঁড়িয়েছে টন প্রতি ৩৬৬ ডলার। আমরা তখন ইউক্রেনে যোগাযোগ করি। তারা কিছুটা কম দরে আমাদের গম দিতে রাজি হলেও শর্ত হিসেবে নিজেদের জাহাজে করে তা পরিবহনের কথা বলে। কিন্তু আমরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি।’

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ভাড়া নির্ধারণ করে ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। বিভিন্ন খাতে তাদের খরচ বেড়েছে। জ্বালানি তেলসহ নানা খরচ বাড়ায় গত কয়েক মাসে ভাড়া বেড়েছে চার থেকে ছয় গুণ।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে জাহাজ-জট এবং খালি কন্টেইনারের ঘাটতির কারণে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ভাড়া (ফ্রেইট চার্জ) বাড়িয়েছে শিপিং লাইনগুলো। এতে আমদানি-রপ্তানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই