ঢাকা : বাংলাদেশ ব্যাংককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। স্বাধীনভাবে পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বায়ত্তশাসন থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণে জাতীয় সংসদের অনুমতি লাগবে। আর্থিক খাত ও ব্যাংকিং বিষয়ে জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালিত হবে। পর্ষদে সরকারি কোনো আমলা রাখা যাবে না। এ রকম বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ২০২৫ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২-এর মাধ্যমে। জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে যা অধ্যাদেশ বা আইন আকারে জারির লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। এর পর থেকে এ অধ্যাদেশের আলোকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠন, গভর্নর-ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও নির্বাহী পরিচালক পদোন্নতি হবে। ব্যাংক খাত তদারকি, বৈদেশিক মুদ্রার অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে।
সরকারি সিদ্ধান্তের আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশের একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে। খসড়াটি শিগগিরই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হবে। খসড়া প্রস্তুতের কাজ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক কর্মকর্তা সাকের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের অভাবেই ব্যাংক খাতে বড় জালিয়াতি হয়েছে বলে আলোচনা রয়েছে। সরকারি ব্যাংকে দ্বৈতশাসন নিয়েও নানা সমালোচনা রয়েছে। নতুন অধ্যাদেশ কার্যকর হলে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংক পরিচালনার একক ক্ষমতা থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে।
অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদমর্যাদা হবে মন্ত্রীদের সমান। পদক্রম অনুযায়ী যা চার নম্বরে। বর্তমানে গভর্নরের পদমর্যাদা ১৪ নম্বর ক্যাটেগরিতে, যা মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবের নিচে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে আট সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ থাকবে। যেখানে কোনো সরকারি কর্মকর্তা থাকবে না। গভর্নরের দেওয়া তালিকা থেকে সরকার পরিচালক নিয়োগ দেবে। পরিচালকদের মধ্যে গভর্নর মনোনীত দু’জন ডেপুটি গভর্নর থাকবেন। এ ছাড়া বাকি পরিচালক নিয়োগের জন্য গভর্নর একটি তালিকা দেবেন। অধিক সংখ্যক ব্যক্তির তালিকা এমনভাবে দিতে হবে যেন সরকার সেখান থেকে বাছাই করে পরিচালক নিয়োগ দিতে পারে। গভর্নরের দেওয়া তালিকার বাইরে কাউকে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া যাবে না। পরিচালক পদে যাদের নাম দেওয়া হবে, তাদের অবশ্যই অর্থনীতি, ব্যাংকিং, হিসাবরক্ষণ, অর্থ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং, বাণিজ্য, শিল্পঝুঁকি ব্যবস্থাপনা অথবা আইনের মতো ক্ষেত্রে দক্ষতা এবং কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ ৯ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে। সেখানে একজন ডেপুটি গভর্নর পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। এ ছাড়া অর্থ সচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব পদাধিকারবলে পরিচালক।
খসড়ায় বলা হয়েছে, মন্ত্রীর মর্যাদায় গভর্নর নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ এবং সংসদের অনুমোদনক্রমে উপযুক্ত ও যথাযথ মানদণ্ড বিবেচনা করে এ পদে নিয়োগ দিতে হবে। আর গভর্নরের সুপারিশ এবং সংসদের অনুমোদন নিয়ে ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে কমপক্ষে চারজন ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ দিতে হবে। গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নররা নিয়োগের আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সামনে শপথ নেবেন। গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর উভয়ে ছয় বছরের জন্য পদে নিয়োগ পাবেন। একবারের জন্য তাদের পুনর্নিয়োগ দেওয়া যাবে। উভয় ক্ষেত্রে অর্থনীতি, ব্যাংকিং, কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং ও আইন বিষয়ে অন্তত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে চলবে।
খসড়া অনুযায়ী চাইলেই গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর এবং পরিচালকদের অপসারণ করা যাবে না। কেউ যদি নিয়োগের শর্ত লঙ্ঘন করেন, আস্থা ভঙ্গ করেন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বার্থ পরিপন্থি কোনো কাজ করেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ এবং সংসদের অনুমোদন নিয়ে অপসারণ করতে পারবেন রাষ্ট্রপতি। এর আগে অবশ্যই তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হবে এবং শুনানি করতে হবে। অবশ্য গভর্নর বা ডেপুটি গভর্নর রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ করতে পারেন। পরিচালকরা সরকারের কাছে পদত্যাগপত্র দিতে পারবেন।
এএইচ/পিএস