শিল্পের ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে দক্ষতা ও সংরক্ষণ সক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ২৮, ২০২৫, ০৫:৫৪ পিএম

ঢাকা:  ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) যৌথভাবে আয়োজিত “বাংলাদেশের শিল্পখাতে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি” বিষয়ক ফোকাস গ্রুপ আলোচনা সোমবার (২৮ জুলাই) ঢাকা চেম্বার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। 

বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল (বিইপিআরসি)’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন এনডিসি উক্ত সভায় অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বার সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, জ্বালানী সক্ষমতা বাড়াতে আমাদেরকে সামগ্রিকভাবে অভ্যাসগত পরিবর্তন আনায়ন করতে হবে। 

তিনি বলেন, সমসাময়িক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত বিবেচনায়, দেশের বেসরকারিখাত যথেষ্ট চাপের মধ্যে রয়েছে, সেই সাথে শিল্পে নিরবিচ্ছিন্ন মানসম্পন্ন জ্বালানি সরবরাহ না থাকার কারণে আমরা পণ্য উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ছি, ফলে আমাদের প্রতিযোগিত সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। শিল্প-কারাখানায় নিয়মিতভাবে ‘এনার্জি অডিট’ বাস্তবায়নের উপর তিনি জোরারোপ করেন। এছাড়াও তিনি শিল্পের খাত-ভিত্তিক গবেষণায় শিক্ষাখাতকে সম্পৃক্তকরণ এবং প্রয়োজনীয় ‘ইন্ডাস্ট্রি ম্যাপিং’-এর আহ্বান জানান।          

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, জ্বালানি দক্ষতা বিষয়ে ২০১৬ সালে একটি এনার্জি এফিশিয়েন্সি অ্যান্ড কন্সারভেশন মাষ্টারপ্ল্যান এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে ২০২৩ সালে ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান করা হলেও কোন জ্বালানি দক্ষতা নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা নেই, তাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। 

তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্বালানি দক্ষতার সংজ্ঞাগত ও ধারণাগত পার্থক্য রয়েছে। এছাড়া দেশের জ্বালানীর উৎস ও সরবরাহে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, জ্বালানি দক্ষতার বিষয়ে গৃহীত পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা এবং শিল্পখাতে এ বিষয়ে কী ধরনের প্রনোদনা দেয়া হয়েছে এবং কতটা কার্যকর হয়েছে সেটি অনুসন্ধান করে দেখা উচিত।  সেইসাথে এখাতে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের উপর তিনি জোরারোপ করেন।

বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল (বিইপিআরসি)’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন এনডিসি বলেন, জ্বালানি ভিত্তিক তথ্য প্রচার ও পাপ্তিতে একটা গ্যাপ রয়েছে, যার ফলে এবিষয়ক অনেক সরকারি সেবা সম্পর্কে দেশের বেসরকারিখাত অবগত নয়, এটি দূর করতে হবে। 

[253565]

তিনি বলেন, আমাদের বেসরকারিখাতের আর্থিক সক্ষমতা বেশ বেড়েছে, তাই জ্বালানি বিষয়ক গবেষণা কার্যক্রমের অর্থায়নে বেসরকারিখাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান, যার মাধ্যমে এখাতের নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, ভোক্তাদের সচেতনা বৃদ্ধি সহ সর্বোপরি একটি টেকসই ব্যবসা বান্ধব জ্বালানি পরিকল্পনা প্রণয়নে সক্ষম হবে।   

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও ভাইস চেয়ারম্যান, নিউএইজ গ্রুপ আসিফ ইব্রাহীম বলেন, দেশের বৃহৎ শিল্প-কারখানাসমূহে জ্বালানি সরবরাহ থাকলেও, বিশেষকরে এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা জ্বালানি স্বল্পতার কারণে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনায় মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এছাড়াও ঋণ প্রাপ্তি প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে তারা অর্থায়ন সমস্যায় মুখোমুখি হচ্ছেন, যার আশু সমাধান প্রয়োজন। 

তিনি বলেন, বিশেষকরে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও জ্বালানী ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানিতে বিদ্যমান উচ্চ শুল্ক হার হ্রাস করা গেলে শিল্পখাতে জ্বালানি সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হবে। 

তিনি জানান, বর্তমানে প্রায় ২৫০টি তৈরি পোষাক খাতের কারাখানায় সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে, যা এখাতের শিল্পে বিকল্প জ্বাালানি ব্যবহারে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। সেই সাথে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, জমি অধিগ্রহণ প্রভৃতি বিষয়ে পিপিপি মডেল অনুসরণের উপর তিনি জোরারোপ করেন।       

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অপারেশন) মোঃ রফিকুল আলম বলেন, প্রতি কিউবিক এলএনজি আমদানিতে ৬৫-৭০ টাকা ব্যয় হলেও সরকার বিক্রি করছে ৩০ টাকায়, ফলে এখানে সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, সকল স্তরের ভোক্তাদের জ্বালানী ব্যবহারের জনসচেনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ৫-১৫% জ্বালানী সাশ্রয় সম্ভব, সেই সাথে এখাতে গবেষণা কার্যক্রম বাড়নোর পাশাপাশি নবায়যোগ্য জ্বালানি বিশেষকরে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারের বৃদ্ধির উপর জোরারোপ করেন।     

বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম সচিব (প্রশিক্ষণ শাখা) মোঃ জাহিদুল ইসলাম জানান, আমাদের মোট উৎপাদিত জ্বালানির ২৭% শিল্পখাতে ব্যবহৃত হয় এবং ২০৫০ সালে এ চাহিদা ৪০% উন্নীত হবে। তিনি বলেন, জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহারে আমরা সাশ্রয়ী হলে তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে শিল্প-কারখানা সহ জনগনকে জ্বালানি সেবা প্রদান সম্ভব হবে।

পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (উৎপাদন ও বিপণন) মোঃ ইমাম উদ্দিন শেখ জানান, প্রতিদিন আমাদের গ্যাসের চাহিদা ৩৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট, যদিও আমরা ২৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে পারছি, ঘাটতি রয়েছে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট। প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ প্রাপ্তির লক্ষ্যে শিল্পাঞ্চলসমূহে কারখানা স্থাপনের জন্য উদ্যোক্তাদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।  

বিকেএমইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি মনসুর আহমেদ বলেন, প্রতিনিয়ত আমাদের প্রাকৃতি গ্যাস আহরণের হার হ্রাস পাচ্ছে, বিষয়টি উদ্বেগজনক, এমতাবস্থায় তিনি জ্বালানি আমদানি উৎসের বহুমুখীকরণের উপর জোরারোপ করেন। একই সাথে সবুজ অর্থায়নের ব্যাপ্তি বাড়ানোর আহ্বান জানান, তবে এলএনজি নির্ভরতা হ্রাস করতে হবে বলে মত প্রকাশ করেন।     

বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, নতুন শিল্প স্থাপনে জ্বালানির উচ্চ মূল্য দেশের শিল্পায়ন বিকাশে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। তিনি জানান, বৃহত্তর গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে প্রতিদিন ৬-৮ ঘন্টা লোডশেডিং চলেছে, ফলে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে ৪-৫ লক্ষ টাকা। 

এছাড়াও পণ্য উৎপাদনে সময়ক্ষেপনের কারণে রপ্তানি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে, ফলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। তিনি জানান, শিল্প-কারখানায় ১০% নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করা গেলে ২২০ মেগাওয়াট জ্বালানি সাশ্রয় সম্ভব হবে, তবে সোলার প্যানেল আমদানি শুল্ক সুবিধা না থাকায় উদ্যোক্তাদের বেশি দাম প্রদান করতে হচ্ছে।

এআর