সাধারণ সভা নিয়ে উৎকণ্ঠায় ইসলামী ব্যাংক

  • শেখ আবু তালেব, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ২২, ২০১৭, ০৩:৫১ এএম

ঢাকা: মতিঝিলের ব্যাংকপাড়া ও অর্থমন্ত্রণালয়ে এখন আলোচনার মূল ইস্যুতে পরিণত হয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনায় পরিচালকদের দ্বন্দ্ব। দিন যত যাচ্ছে ততোই ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ভাইস-চেয়ারম্যানের মধ্যে দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পাচ্ছে। দুই জনের নেতৃত্বে দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে পরিচালক ও ব্যাস্থাপনায় থাকা কর্মকর্তাদের।

একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন প্রকাশ্যে। ক্ষমতার প্রভাব দেখাতে সরকরি দল আওয়ামী লীগের কে কতটা কাছের তার মহড়া দেখিয়ে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর পর্যন্ত গড়িয়েছে এ ঘটনা। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দ্বন্দ্ব নিরসনে এখন পর্যন্ত কোন ভূমিকা নেয়া হয়নি।

সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড সভায় বিশৃংখলা দেখা দিয়েছে- এ কথা স্বীকার করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড সভায় তো এখন মারামারি চলছে। তবে এটা বোর্ডের বিষয়। এ ব্যাপারে সরকার কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না। তবে এর বিদেশি পার্টনার আইডিবি যদি সরকারের কাছে অভিযোগ করে, সেক্ষেত্রে সরকার হস্তক্ষেপ করবে বলে জানান তিনি। সৌদি আরবের জেদ্দায় আইডিবির সম্মেলন থেকে ফিরে এসে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক প্রশ্নের জবাবে রোববার (২১ মে) সচিবালয়ে একথা বলেন।

সূত্র জানিয়েছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত ব্যাংকটি থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ শেয়ারের মধ্যে ৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইডিবি। বিষয়টি  ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সর্বশেষ বৈঠকে তা অনুমোদনও করা হয়েছে। সে হিসেবে বিদেশি ব্যাংকটি ইসলামী ব্যাংকে থাকা ১২ কোটি ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৫৮৫টি শেয়ারের মধ্যে ৭২ ভাগ তথা প্রায় ৩০০ কোটি টাকার শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছে।

ইসলামী ব্যাংকের পরিচালকদের পরিস্থিতি যখন এমন উত্তেজনাকর তারই মধ্যে আগামীকাল মঙ্গলবার (২৩ মে) অনুষ্ঠিত হবে ব্যাংকটির বার্ষিক সাধারণ সভা-এজিএম। আর সুষ্ঠুভাবে তা বাস্তবায়ন নিয়ে ব্যবস্থাপনার মধ্যে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। জানা গেছে, এখন ব্যাংকের সব কাজই এজিএম কেন্দ্রীক। ব্যাংকের অন্যান্য সব কাজ বাতিল করে দেয়া হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, বার্ষিক সাধারণ সভায় কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এরাতে সভার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে আর্মি গল্ফ ক্লাবের মিলনায়তনে। পুজিঁবজারের তালিকাভূক্ত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় শেয়ারহোল্ডারদের নিয়ে প্রতিবছর বার্ষিক সাধারণ সভার আয়োজন করতে হয়। সেখানে ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্ট পেশ ও অনুমোদন, আয়-ব্যয়ের হিসাব, মুক্ত আলোচনা, প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও পরিচালক নিয়োগের বিষয়টি শেয়ারহোল্ডারদের কাছে উপস্থাপন ও অনুমোদন নিতে হয়।

প্রতিবারই সুষ্ঠুভাবে এজিএম সম্পন্ন হলেও এবার অপ্রীতীকর ঘটনা ঘটতে পারে বলে চিন্তিত হয়ে পড়েছে ব্যাংকটির কর্তৃপক্ষ। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের পরিচালক ও ভাইস-চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহসানুল আলম পারভেজ ব্যাংকটিতে দুই ডজনের বেশি রাষ্ট্র ও স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকর্তা রয়েছেন বলে ফেসবুকে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

এরপরেই গত ১৩ মে গোয়েন্দা ও আইন-শৃঙ্খলা রাক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতে বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরে ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান গত ১৮ মে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, আহসানুল আলম মিথ্যাচার করেছেন। সর্বশেষে ২০ মে আহসানুল আলম ব্যাংকের নয় পরিচালকের স্বাক্ষরযুক্ত বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে বলেছেন, পরিচালক পদ থেকে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করলে আরো নয় পরিচালক ব্যাংক ছেড়ে চলে যাবেন। 

সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খানের নেতৃত্বে পরিচালকদের একটি অংশ আহসানুল আলমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এজন্য এজিএমে হট্টগোল হতে পারে বলে আশঙ্কা করা করছেন অনেকেই।

ব্যাংকটির কয়েকজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তারা এজিএম এ না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এজিএমে সব ধরনের শেয়ারহোল্ডারার আসবেন। ব্যাংকের অভ্যান্তরীণ এ দ্বন্দ্বের বিষয়টি অবশ্যই সেখানে আলোচনায় উঠবে। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এমনকী হাতা-হাতি থেকে বড় ধরণের হট্টগোল বেধে যেতে পারে। তাই অপমানজনক অবস্থা থেকে বাঁচতে সাধারণ সভায় যোগ না দেয়াই উচিত বলে মনে করছি।

অবশ্য ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডির সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে সার্বক্ষণিক যোগযোগ রাখছেন। ব্যাংকের পক্ষ থেকেও পরিচালকেেদর আস্থস্ত করা হচ্ছে সভায় অংশগ্রহণের জন্য। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকানোর জন্য রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে ইসলামী  ব্যাংকের পক্ষ থেকে। এজিএমের সময় গলফ ক্লাবের মিলনায়তনে প্রয়োজনীয় পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হবে। এজিএমে অংশগ্রহণকারী শেয়ারহোল্ডারদের প্রত্যেককে তল্লাশি করে সভাস্থলে ঢুকতে দেয়া হবে। 

সূত্র জানিয়েছে, সাধারণ সভা যতদ্রুত সম্পন্ন করা যায়, সেজন্য এজেন্ডা ও আলোচনার সময় কমিয়ে আনা হয়েছে। পুরো মিলনায়তন জুড়ে কয়েকটি ক্যামেরা বসানো হবে পুরো অনুষ্ঠানের ভিডিও করার জন্য। ব্যাংকের সিকিউরিটি গার্ড ও কর্মচারিদের বড় একটি অংশকে উপস্থিত রাখা হবে।

এজিএমে কোন সমস্যা হবে না বলে মনে করছেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এজিএমে কত শতাংশ ডিভিডেন্ট দেয়া হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত তো বেশ আগেই হয়েছে। আর কবে কোথায় এজিএম হবে সেটিও আগেই ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ নিয়ে কোন সমস্যা হবে না।

এবছর ইসলামী ব্যাংক ২০১৬ সালের জন্য নগদ ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ২০১৫ সালে ২০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছিল। ব্যাংকটি থেকে গত এক বছরে প্রায় চার শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক ছেড়ে চলে গিয়েছে। বিষয়টির প্রতি নিজের সমর্থন জানিয়ে ইসলামী ব্যাংকের ভাইস-চেয়ারম্যান বলেন, এজিএম নিয়ে আমরা মহা চিন্তিত আছি। এবার শেয়ারহোল্ডারদের জন্য মাত্র ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়া হয়েছে। যা শেয়ারহোল্ডারা মেনে নিতে পারেনি। এরপর ব্যাংকের শেয়ার যড়যন্ত্রভাবে ৪৮ টাকা থেকে ৩২ টাকা করা হয়েছে। যাতে শেয়ারহোল্ডারদের ৫০ শতাংশ পুঁজি হাওয়া হয়ে গেছে। ব্যাংক দুই হাজার কোটি মুনাফা করেছে অথচ ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়া হয়েছে। সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের তোপের মুখে পড়ব কি-না সে বিষয়ে চিন্তিত আছি।

দ্ব›েদ্বর বিষয়ে তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংক বেসিক ব্যাংকে পিরণত হতে যাচ্ছে এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি বলে আমরা মুখ খুলছি। তিনি বলেন, এখন পরিচালকরা আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ। এছাড়াও বেশকিছু বিষয় নিয়ে ব্যাংকটির পরিচালকদের একাংশ চিন্তিত বলে জানিয়েছেন সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ। 

তিনি বলেন, চেয়ারম্যান বলে বেড়াচ্ছেন  পরিচালকরা ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এটা নিয়মে আছে সেটা ঠিক কথা। তিনি বলেন, আমরা যদি পরিচালকদের গোপনীয়তার নিয়ম লঙ্ঘন করে থাকি তাহলে চেয়ারম্যান রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার নীতি ভঙ্গ করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কি কথা বলেছেন তা পাবলিক প্লেসে বলে তিনি অন্যায় করেছেন। তাকে আমি আদালতে নিয়ে দাঁড় করাবো।

প্রসঙ্গত, গত ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানকে সরিয়ে দেওয়া হয়। একইসঙ্গে চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মুস্তাফা আনোয়ার এবং ভাইস চেয়ারম্যান মো. আজিজুল হককেও সরানো হয়। ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত করা হয় আরাস্তু খানকে।

নতুন ভাইস-চেয়ারম্যান হিসাবে অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলমকে নির্বাচিত করা হয়। পরে এমডি হিসাবে যোগ দেন মো. আব্দুল হামিদ মিঞা। পরিচালক সংখ্যা ২১ এ উন্নীত করা হয়। নতুন পরিচালনা পরিষদ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চার মাস যেতে না যেতেই পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/তালেব