বাঙালি জাতিরাষ্ট্র হয়ে ওঠার পথে

  • সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ২, ২০২১, ১১:২৮ পিএম

ঢাকা : পাকিস্তান যে মুক্তি আনবে না মানুষের— এই কথা যারা বুঝতেন তারা কেউ কেউ নির্বাসিত হয়েছিলেন কারাগারে, অন্যদের মুখ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল হুমকি ও প্রলোভনের অস্ত্র দিয়ে। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হঠাৎ করে বড় আন্দোলন গড়ে উঠবে এমন শক্তি বা অবস্থা কোনোটাই দেশে ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাঙালির ভাষা আন্দোলন সেই পথ তৈরি করে দিল মাত্র পাঁচ বছরের মাথায়।

বায়ান্ন

সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের বিজয় পতাকা; প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রবৃত্তির ওপর মানুষের জয়ের চিহ্ন। কিন্তু কেবল চিহ্ন বললে কিছুই বলা হয় না। কেননা সংস্কৃতি সবসময়ই অত্যন্ত জীবন্ত ও পরিব্যাপ্ত। অনেকটা পানির মতো, সহজ কিন্তু শক্তিশালী, থাকলে বোঝা যায় না, না থাকলে প্রাণ সংশয় দেখা দেয়। তাই বলা যায়, সংস্কৃতি শিক্ষার চেয়েও ব্যাপ্ত ও জরুরি। সংস্কৃতির স্তর দেখে মানুষের স্তর জানা যায়। এও জানা যায় যে মানুষের সংস্কৃতি আছে; পশুর নেই।

বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ছিল একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। এ ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের অভ্যুত্থান। মানুষ তার অধিকার চেয়েছে, ভাষার অধিকারই আপাতত, কিন্তু ডালিমের ভেতর যেমন অনেকগুলো কোষ থাকে, ওই দাবির অভ্যন্তরে তেমনি অনেক দাবি ছিল। মূল বিষয়টি ছিল সংস্কৃতি; সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশের জন্যই রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে। শুধুই যদি রাজনৈতিক আন্দোলন হতো তবে সরকার পরিবর্তন কিংবা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে পরিসমাপ্তি ঘটতে পারত। ঘটেনি। অন্যতম নয়, একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হওয়ার পরও একুশের আন্দোলন থামেনি। থামেনি, কেননা সংস্কৃতি এখনো মুক্ত ও উন্নত হয়নি, মনুষ্যত্ব আজো নিরাপদ নয়। আন্দোলন প্রতীক্ষা করেছে একটি সামাজিক বিপ্লবের।

সংস্কৃতির মুখ্য শত্রু কে ছিল সেদিন? ছিল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র একগুচ্ছ শক্তি সমষ্টি; সে ছিল ভয়াবহ, ভয়ঙ্কর। সম্পূর্ণ তৈরি। জিন্নাহ সাহেব বলেছিলেন— উর্দু, কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আর বাঙালি ভক্তদের কেউ কেউ এখন বলেন দেখছি, পরে নাকি তিনি দুঃখ করেছিলেন এ কথা বলার জন্য। তা তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাও ভুল হয়েছে— অন্তিম শয্যায় শায়িত অবস্থায় মন্তব্য করেছিলেন বলে শোনা যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা অবশ্য অন্য ব্যাপার, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে উর্দু এবং কেবল উর্দু হবে, এই বক্তব্য ভ্রান্তি কোথায়! পাকিস্তান ছিল একটি শোষণভিত্তিক অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সেখানে ক্ষমতাসীন অবাঙালিরা বাঙালিদের নিগৃহীত করবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। মোড়কটা ছিল ধর্মীয়, অভিপ্রায়টি ছিল নিষ্ঠুররূপে বৈষয়িক। শোষণের প্রয়োজনেই উর্দুকে চাপাতে চেয়েছে, পিষ্ট করতে চেয়েছে বাঙালির সংস্কৃতিকে। সংস্কৃতিকে কাবু করতে পারলে মানুষকে বশে রাখা যায়।

এদেশের মানুষের জন্য রাষ্ট্র কখনোই মিত্রপক্ষ ছিল না, সব সময়ই ছিল শত্রুপক্ষ। রাষ্ট্রের সেই বৈরী চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে ভাষার মধ্য দিয়েই। জনগণের ভাষা সবসময়ই বাংলা, শাসকের ভাষা কখনো সংস্কৃত, কখনো ফারসি, দীর্ঘকাল ছিল ইংরেজি, পাকিস্তানিরা চাইল, চাপাবে উর্দু। উর্দুর পক্ষে কেবল করাচির জিন্নাহ বলেননি, ঢাকার নাজিমুদ্দিন বলেছেন, এমনকি সোহরাওয়ার্দীও বলেছিলেন একটি বিবৃতিতে, কোনো কোনো বাঙালিও বলেছে, বলতে হয়েছে, কেননা এরা সবাই ছিলেন পাকিস্তানি রাষ্ট্রের আদর্শে বিশ্বাসী।

জনগণ মানেনি। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টায় রাষ্ট্রের চেহারাটি প্রকাশ্য হয়ে গেল, ধর্মের পোশাক আর কাজে দিল না। বাঙালি বিদ্রোহ ঘোষণা করল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। বায়ান্নতে শুরু, তারপর ধাপে ধাপে এগিয়েছে, এসেছে ঊনসত্তর, এলো একাত্তর। একাত্তরের যুদ্ধ অনেক বেশি প্রচণ্ড ও রক্তাক্ত, কিন্তু সূচনা বায়ান্নতেই, একাত্তর বায়ান্নরই স্বাভাবিক পরিণতি।

ভাষা আন্দোলনের শক্তি এলো কোথা থেকে? এলো তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা থেকে। ভাষা শ্রেণি মানে না, সম্প্রদায়ের বেষ্টনীতে আবদ্ধ থাকে না, অঞ্চল পার হয়ে যায়। হয়েছিল, যাদের ওপর নৃশংসরূপে আক্রমণ করেছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু সে আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করেনি। এখানে সেখানে ধর্মঘটও হয়েছে, সীমান্ত এলাকায় কৃষকদের ছোট ছোট অভ্যুত্থান ঘটেছে, কিন্তু কোনোটিই ভাষা আন্দোলনের মতো সাড়া জাগায়নি। কারণ অন্য কোনো আন্দোলন দেশের সব মানুষের অভ্যুত্থান ছিল না, যেমনটি ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। এতে যে প্রাণ ছিল সে-ই বা এলো কোথা থেকে? এলো এর আপসহীনতা থেকেই। মুক্তিযুদ্ধের মতোই এই আন্দোলনে পরাজয়ের কোনো স্থান ছিল না। পরাজয় মৃত্যু— মনুষ্যত্বের জন্য, মানবিক সংস্কৃতির জন্য। সংস্কৃতির শক্তি প্রমাণিত হয়েছে, পুরাতন রাষ্ট্র পরাভূত হয়েছে সংস্কৃতির কাছে।

ঊনসত্তর

গণঅভ্যুত্থানের স্বভাব আগুনের মতো। সে ছড়িয়ে পড়ে, ভয় পাইয়ে দেয়। শত্রুদেরকে শুধু নয়, মিত্রদেরও। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানেও ওই ঘটনা ঘটেছে। আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। প্রথমে ছিল ছাত্র আন্দোলন, পরে তা হয়ে দাঁড়ালো জনগণের অভ্যুত্থান। কার্ফু ভেঙে বের হয়ে এসেছে লোকে নাখালপাড়ায়, রামপুরায়। তারপর সারা পূর্ববঙ্গ গর্জে উঠল, একই সঙ্গে। তছনছ হয়েছে থানা, আগুন জ্বলেছে তহশিল অফিস। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনতার এমন বিদ্রোহ এর আগে কেউ কখনো দেখেনি পূর্ববঙ্গে।

ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ তখন আত্মগোপন করেছিলেন, পুলিশের ভয়ে নয়, জনতার ভয়ে। জনতা নির্দেশ চেয়েছে। এগুবে। অনেক দূর যাবে। দৈত্য ছাড়া পেয়েছে ছিপির বন্ধন থেকে, কে তাকে ফেরত পাঠায়! তফাৎ এই যে, এ দৈত্য ভাঙতে চায় ভাঙার জন্য নয়, গড়ার জন্য।

ফেরত পাঠানোর চেষ্টা হয়েছে। উদ্বিগ্ন শাসকেরা করেছে। শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে তারা— প্রথমে প্যারোলে, পরে নিঃশর্তে। তড়িঘড়ি মামলা তুলে নিয়েছে আগরতলার। গোলটেবিলে বসতে চেয়েছে বড় বড় নেতাদের ডেকে। নির্বাচন দিয়েছে। সবকিছুই উপশমের চেষ্টা। রাষ্ট্র যাতে বাঁচে তার বন্দোবস্ত।

নির্বাচন ছিল একটা গলি বিশেষ। আশা ছিল ওই কানাগলিতে একবার ঢোকাতে পারলে শান্ত হবে জনসাধারণ। কিন্তু গলি গলি রইল না, গণরায় বেরিয়ে এলো, মুক্তির পক্ষে। শেখ মুজিব সামনে ছিলেন, আপাতদৃষ্টিতে রায় তাঁর পক্ষেই; কিন্তু প্রকৃত ঘটনায় কেবল তার পক্ষে নয়, পাঞ্জাবিদের শাসনের বিরুদ্ধে এবং বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে। ওই রায়কে নাকচ করার জন্য পাঞ্জাবিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল অস্ত্রহাতে। প্রশ্নটা যদি শুধু শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী করা না করাই হতো তবে তা মীমাংসা সম্ভব ছিল; কিন্তু প্রশ্নটা যখন হয়ে দাঁড়াল পাকিস্তানের টেকা না টেকার, তখন শাসকরা উন্মাদ হবে না কেন?

নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ থেকে আভাস দেওয়া হয়েছিল যে, ছয় দফা কোরআন-বাইবেল নয়, দরকষাকষি অসম্ভব হবে না। কিন্তু নির্বাচনের পরে কে করে আপস, কে যায় দরকষাকষিতে। সাত মার্চের সেই অসম্ভব বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবের ঘোষণা ওই গণঅভ্যুত্থানেরই আরেক প্রকাশ। চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে কয়েকদিন পরে, প্রকাশ্যে যুদ্ধে।

একাত্তর

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সমাজ যেমন স্পষ্ট ও গভীরভাবে দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল, তেমন বোধহয় আর কখনো হয়নি। শত্রু-মিত্রের পক্ষে ও বিপক্ষের বড় দুই ভাগ। কিন্তু এই বড় দুই ভাগের মধ্যেও ছোট ছোট ভাগ ছিল। সে ভাগগুলো সামাজিক সত্য।

হানাদারদের পক্ষে যারা গেছে, তাদের কেউ কেউ ছিল নিরূপায়। সব রাজাকারই যে বিশেষ রাজনৈতিক সংগঠনের ছিল তা তো নয়, প্রাণভয়ে যোগ দিয়েছে কেউ, কেউ গেছে ধর্মীয় উন্মাদনায় কিংবা উন্মাদদের প্ররোচনায়। একটা বড় অংশ গেছে লাভের আশায়। তাদের যোগ ছিল পাকিস্তান শাসন, অর্থাৎ শোষণ ব্যবস্থার সঙ্গে। সেই যে শোষণ, যাকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য নাম দেওয়া হয় শাসন, তার উচ্ছিষ্ট পেত যারা তারা ওই পাওয়াকে হারাতে চায়নি এবং আরো পাবে এমন আশা মনের মধ্যে পুষেছিল।

বিপরীত পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেও উদ্দেশ্য ও আশার বিভিন্নতা ছিল বৈকি। প্রাণভয়ে কেউ কেউ এসেছে। কেউ এসেছে জাতিসত্তার নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের আশা ছিল তারা উচ্চবিত্ত হবে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া জায়গাগুলো দখল করবে এবং নির্বিঘ্নে বাঙালি ভাইদের শাসন, অর্থাৎ শোষণ করবে। সাধারণ, শ্রমজীবী মানুষের কিন্তু এই স্বপ্নটা ছিল না। তারা আশা করেছে স্বাধীনতা তাদের খাবার দেবে। রুজি দেবে, বস্ত্র ও বাসস্থান দেবে, তারা স্বপ্ন দেখেনি অন্যের শ্রমশক্তি শোষণের, তারা স্বপ্ন দেখেছে নিজেদের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। দেশ স্বাধীন করবে এমন কথা আওয়ামী লীগ ছাব্বিশে মার্চের আগে বলেনি। স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববঙ্গের আওয়াজ ঊনসত্তরের পরে উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু সে আওয়াজ পূর্ববঙ্গের সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক শক্তিশালী এবং সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশরূপে বিজয়ী আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ওঠেনি। না, স্বাধীনতার কথা পঁচিশে মার্চের সেই অবিশ্বাস্য রাতের আগে সাধারণভাবে কল্পনাও করেনি এদেশের মধ্যবিত্ত। শেখ মুজিব ছিলেন এদেশের মধ্যবিত্তদের সাহসী ও অনমনীয় নেতা। এবং এই যুদ্ধের নেতৃত্ব যে তিনিই দেবেন তাও ইতিহাস নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

নব্বই

ঘটনাটা অনেকটা একাত্তরের মতোই, কিন্তু একাত্তর অবশ্যই নয়। একাত্তরে একটি রাষ্ট্রের পতন ঘটেছিল, এবার পতন ঘটল একটা সরকারের। কিন্তু একাত্তরের সঙ্গে নব্বইয়ের সাদৃশ্যটা বড় কম নয়। জয় হয়েছে জনগণের, জয় হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ততার, পরাজয় হয়েছে স্বৈরশাসনের।

একাত্তরের স্বতঃস্ফূর্ততা এবং ঐক্য এবারো আমরা দেখলাম। সংগঠন তেমন শক্তিশালী ছিল না, প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বেও ছিল প্রয়োজনের তুলনায় দুর্বল; কিন্তু জনগণ এগিয়ে গেছে, নিপীড়নের কাছে পরাভব মানেনি এবং শেষ পর্যন্ত বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। শত্রুর আত্মসমর্পণের ঘটনা আবারো ঘটল, এই বাংলাদেশের মাটিতে। যেমন ঘটেছিল একাত্তরে। তবে একাত্তরে মিত্রবাহিনী ছিল, এবার বাইরের কেউ ছিল না, সবাই ভেতরকার।

এই প্রথম বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের একটি ঘটনা ঘটল, যার সঙ্গে গোপন হত্যা বা সামরিক অভ্যুত্থানের কোনো সম্পর্ক ছিল না। পরিবর্তন ঘটল মানুষের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, যে অভ্যুত্থান সম্ভব বলে এরশাদ তো মনে করেইনি, এরশাদ-বিরোধীদেরও অনেকে এত দ্রুত ঘটবে বলে আশা করেনি। দোদুল্যমানেরা ভেবেই পাননি কেমন করে এ সম্ভব, যেমনভাবে একাত্তরে তাঁরা বুঝে উঠতে পারেনি কীভাবে ইয়াহিয়া বাহিনীর পতন ঘটবে এবং পাকিস্তান ভাঙবে। জনগণের শক্তি কত বড় তা অনেক সময়ই বুঝে ওঠা কষ্টকর বৈকি।

পতিত, স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার শুরু থেকেই অধঃপতিত ছিল। এ কীর্তিগুলোর মধ্যে কোনটা বড় কোনটা ছোট তার পরিমাপ করা মোটেই সহজ নয়। এ সরকার সব প্রতিষ্ঠানকেই নড়বড়ে এবং অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাসের অযোগ্য করে দিয়েছে। নির্বাচন থেকে শুরু করে শিক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ আর অক্ষত নেই। আগেও এরা ভালো ছিল না, পরে ভয়ানকভাবে বিপদগ্রস্ত হয়েছে। এ সরকার দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। বিশেষভাবে সম্পদ পাচার ও চোরাচালানের যুগল দৈত্যের যুগপৎ আক্রমণ সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে দেশের দুর্বল অর্থনীতির পক্ষে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি এই সরকার যার কাছে করেছে সে প্রতিষ্ঠানও নয়, অর্থনীতিও নয়, যদিও উভয় ক্ষেত্রেই পরিমাণ ভয়াবহ, সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে নৈতিকতার— প্রসারিত অর্থে সংস্কৃতির। এত ক্ষতি পাকিস্তানের দুঃশাসনও করতে পেরেছে কি না সন্দেহ।

সরকার একটি সংস্কৃতি কমিশন গঠন করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল সংস্কৃতির গণতান্ত্রিক উপাদানগুলোর বিকাশকে অবরুদ্ধ করে দিয়ে অভ্যন্তরস্থ প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাৎপদ শক্তিগুলোকে উৎসাহিত করা, যাতে তারা প্রবল হয় এবং জনগণকে পিছিয়ে দিতে পারে। ঘটনাটি ছোট, কিন্তু তাৎপর্যটি বড়। কেননা এর ভেতর দিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটা উন্মোচিত হয়ে গেছে। তবে সংস্কৃতি কমিশন না গঠন করলেও সরকারের জন্য ক্ষতি ছিল না, কেননা সংস্কৃতির ক্ষতি শতসহস্র দৃশ্য-অদৃশ্য পথে সংঘটিত হচ্ছিল। রাজনীতি ও সমাজের সর্বত্র নীতিহীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সরকার নেতাকে দুর্বৃত্ত এবং দুর্বৃত্তকে নেতায় পরিণত করেছে শুধু টাকার জোরে। এই সরকার যে টিকে ছিল সেও গণসমর্থনের ওপর নির্ভর করে নয়, এমনকি বিভিন্ন বাহিনীর ওপর ভরসা করেও নয়, টিকে ছিল মানুষকে নষ্ট করার দক্ষতার ওপর ভরসা করে। এমন জনসমর্থনহীন সরকারের এত দীর্ঘ সময় টিকে থাকার নজিরবিহীন ইতিহাস প্রমাণ করে কতটা নীতিহীন ছিল তার চরিত্র। সরকারপ্রধান কবিতা লিখেছেন, সংগীত রচনা করেছেন এবং সেই সমস্ত সমস্যার হাস্যকর কাণ্ডকারখানার প্রশংসা করার মতো ভাড়াটে সংস্কৃতিসেবীও সংগ্রহ করা হয়েছে। স্বৈরাচারের অবশ্য কৌতুকবোধ থাকতে নেই, থাকাটা তার নিজের জন্য বড়ই বিপজ্জনক। মিথ্যাচার ও লাম্পট্যকে সরকার কেবল যে প্রশ্রয় দিয়েছে তা তো নয়, তাকে আদর্শায়িত করেছে বৈকি। যেসকল মূল্যবোধের অনুপ্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, এই সরকার রাষ্ট্রকে নিয়োজিত করেছিল তাদেরকে যতভাবে সম্ভব লাঞ্ছিত এবং পারলে পদদলিত করতে। তাই দেখা যায়, দেশপ্রেমের বিপরীতে উচ্চমূল্য পেয়েছে লুণ্ঠন। সম্পদ পাচার, বিদেশে সন্তান প্রেরণ সর্বক্ষণ উৎসাহিত হয়েছে। এদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই— এই ধারণা প্রচার পেয়েছে নানাভাবে। বাংলার প্রচলনকে সম্ভব করে তোলার পরিবর্তে ইংরেজি মাধ্যমের এবং মাদরাসা শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় এসেছে রাষ্ট্রধর্ম। স্বৈরাচার সরকার সর্বক্ষেত্রে আয়োজন করেছিল পরাজয়ের।

আমাদের জয়ের সমস্ত প্রত্যয় তৈরি করে দিয়েছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। আমাদের ওই পথ ধরে এগুবার কথা। এগিয়েছিও। আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। এই চলার পথে শহীদেরা আমাদের সঙ্গী, বন্ধু ও পথপ্রদর্শক। তাঁরা গতকালের মানুষ নন, তাঁরা আগামীকালের। সেই রক্তশোণিত বেয়ে দেশ এগুচ্ছে, দেখা দিয়েছে আশার আলো, এমনটা ভাবা অমূলক নয় হাজার বছরের নিপীড়িত বাঙালির।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়