লোকজ গীত: জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে বেদনার সুরে

  • হৃদয় আজিজ, নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ১৪, ২০১৭, ০২:৫২ পিএম

ঢাকা: বাঙালির ঐতিহ্যের হাজারো সংস্কৃতি, পালা-পার্বন আমরা লালন করে আসছি হাজার বছর ধরে। এই ঐতিহ্যের বিশাল এক সম্পদ গীত। যেকোনো অনুষ্ঠান কিংবা বিয়েতে এই গীত মা-বোনদের কণ্ঠে মধুর সুরের আবেশ ছড়ায়। এর সঙ্গে তালে তালে নাচও চলে। তবে কালের পরিবর্তনে আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখের এই সুরের কাব্য হারাতে বসেছে তার চিরন্তন ঐতিহ্য।

তবে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে আজও বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া হয় এই গীত। আজ থেকে দেড় দুই যুগ আগে কোনো বাড়িতে বিয়ের আয়োজন হলেই নারীরা দলবেঁধে রাতভর গীত গাইতো। উপস্থিত নারী-পুরুষরা গীতের সুরে হারিয়ে যেতো অন্যলোকে। সেই গীতের কথা আর সুরের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেত জীবনের হাসি-কান্না, রাগ-অনুরাগ। জন্ম থেকে মৃত্যু সবকিছুই যেন উঠে আসতো গীতের মধ্যে।

সাধারণত বিভিন্ন বয়েসের একদল নারী গোল হয়ে বসে একসঙ্গে খালি গলায় একের পর এক গেয়ে যায় গীত। কখনও এইসব গীতের সঙ্গে একজন বা দুজন মিলে পরিবেশন করে নাচ।

গ্রামীণ নারীরা বিয়ের কদিন আগে থেকেই দল বেঁধে হাজির হতো বর ও কনের বাড়িতে। এক পর্যায়ে কনের বাড়িতে উপস্থিত হতো বরযাত্রী। আর সেই বিয়ের আসরেই বর-যাত্রী বা ডুলিবিবিদের উদ্দেশ করে গেয়ে উঠতো-

‘ডুলিবিবি আইসাছে পান খাইবার লালচে..।

চলছে গীত গাওয়া

যখন সেই বিয়ের আসরে বর বা কনেকে কিছু খাওয়ানো হতো তখনও গীতের ভাষা বদলে
যেতো। সবাই কোরাস গেয়ে উঠতো-

‘বসবো না, বসবো না
ছিঁড়া ছোপে আমরা বসবো নারে,
আরশের বাবা কি জানে নারে...।’

বরযাত্রীদের বসার জন্য দেয়া মাদুর বা পাটি ছেঁড়া বলে উল্লেখ করায় পাল্টা জবাব দেয় বরের শ্যালিকারা। তারা গেয়ে ওঠে-

‘দুলাভাই গিয়েছে শহরে
আনবে নাকের নথরে
সেই নথ নাকে দিয়ে 
নাক ঘুরিয়ে নাচবো রে..।’

শুধু কি বিয়ের আসরেই এমন গীতের পাল্লাপাল্লি হয়। ঢেঁকিতে ধান ভানার সময়ও নারীরা জুড়ে দিতো বিভিন্ন ধরনের গীত। ধান ভানার পর বর বা কনের জন্য তৈরি করতো ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘থুবড়া’। ধুবড়া’র তালিকায় থাকতো রসগোল্লা, অন্ধাসা, ক্ষীর, ফিরনি, ভাপা পিঠা।

বর ও কনেকে আদর করে খাওয়ানোর সময় আইওরা গীত শুরু করে দিত। পাশের গ্রাম থেকেও শোনা যেত গীতের সেই সুর। ওইসব গীতের সুর এতো মধুর আর হৃদয়স্পর্শি ছিল যে, শ্রোতাদের চোখ ভিজে যেতো অনেক সময়। বরের আগমন, তার আগে কনেকে গোসল বিদায় জানানোর সময় যেসব গীত গাওয়া হয় তা আজও মানুষের প্রাণমন আকুল করে দেয়। নারী হৃদয়ের আবেগ-উৎকণ্ঠা, দুঃখ-কষ্ট, হাসি–কান্না, আনন্দ-বিরহের প্রকাশ ঘটে এসব বিয়ের গীতে।

গ্রামীণজীবনে বিয়ে বা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য ডাক পড়ে ‘গীত গাওয়ানি’ মধ্যবয়সী নারীদের। যাদের নাই কোনো শিক্ষা কিংবা অন্যকোনো প্রশিক্ষণও। অথচ তারাই ছিলেন গীতিকার সুরকার।

‘কন্যা ডাক দেও তোর জননী না মাইরে
মাও দিয়া যাওক সোনা মুখে হলদিরে
হলুদা, ডাক দেও তোর জনমদাতা বাপেরে
বাবা দিয়ে যাউক তোর সোনা মুখে হলদিরে..।’

এই গীত শোনার পর বরের বোনেরা গেয়ে উঠতো-

‘হামার ভাইয়ের হলদি মাখিবার
মনে নাহি ছিলরে
জোর বেজোর হলদি মাখলে
জোনাকু শালার বহিনরে..।’

বর বা কনেকে থুবড়া হিসেবে ক্ষীর খাওয়ার সময় দলবেঁধে গাওয়া হতো-

‘আলুয়ার চালে কাঞ্চন দুধে ক্ষীরোয়া পাকালাম, 
সেই না ক্ষীরোয়া খেতে গরমি লেগেছে।
কোথায় আছ বড়ভাবি পাক্কা হিলোয়রে..।’

ঢেঁকি পাড়ে গীত

বিয়ে শেষে নিজ বাড়িতে ফিরে আসার সময় বরের প্রতি ইঙ্গিত করে গাওয়া হতো-

‘কী গহনা আনিছেন দুলামিয়া
দেখানতো হামাকে 
সবই জিনিসি আনিছি গুলজান বিবি
নথুয়া ছাড়িছি দেশে...।’

বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় কনেকে হাজারো সুখ-স্মৃতি, আনন্দ হাসি ভুলে যেতে হচ্ছে। বাবা-মা ভাইবোন ছেড়ে চিরজীবনের জন্য যেতে হচ্ছে বরের বাড়িতে। নতুন করে গুছিয়ে নিতে হবে সংসার। এই প্রসঙ্গে গীতের মাধ্যমে বলা হতো-

‘মন বিন্দাইলাম বনে বনে
আরো কান্দন কান্দে গো মায়-ও 
বনে বনে আরো কান্দন কান্দে 
গো মায়-ও নিরলে বসিয়া..।’

শুধু কি বিয়েতেই এসব গীত গাওয়া হতো? না, গ্রামের সহজ সরল মানুষের ভালোবাসাও এতে প্রকাশ পেত। মেয়েরা যেমন গাইতো-

‘ওরে ছেলে কার ছেলে
পথে বসে কাঁদছিলে 
যদি তোমার মা থাকত
কোলে তুলে কি লইত না..?

সোনালীনিউজ ডটকম/ঢাকা/এআই