সৈকতে বাড়ছে অপমৃত্যু দুর্ঘটনা

  • কক্সবাজার প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২১, ০২:০১ পিএম

কক্সবাজার : করোনা মহামারির কারণে সাড়ে চার মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর খুলে দেওয়া হয়েছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত।

দীর্ঘ সময় বিনোদন থেকে বঞ্চিত থাকা পর্যটকদের অনেকেই বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে এসে ওয়াটর বাইক, স্পিডবোট ও সাঁতারো টায়ারে চড়ে বল্গাহারা হুল্লোড়ে মেতেছেন। ফলে অসাবধানতায় সৈকতে বাড়ছে অপমৃত্যু ও নানা দুর্ঘটনা।

গতকাল শনিবার কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেকস্থ সমুদ্র মোহনা থেকে মেহের ফারাবি অভ্র নামের এক পর্যটকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। গত এক সপ্তাহে সৈকতে নেমে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।

হোটেলে উঠে অতিরিক্ত মদপানে আরেক পর্যটকের মৃত্যু এবং শখের প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে নারী পর্যটক মারাত্মক আহত হয়েছেন।  এসব অপমৃত্যু ও দুঘর্টনায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সচেতন মহল। পর্যটন সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব ও নজরদারিকে আরো গুরুত্বসহকারে দেখছেন তারা।

তবে পর্যটকদের অসাবধানতা ও লাইফগার্ডের দেওয়া নির্দেশনা যথা-জোয়ার-ভাটার সময়সূচি, হুঁশিয়ারি বাঁশি, বিভিন্ন সংকেত ও লাল পতাকার সংকেত অমান্য করাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত ৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে কক্সবাজার সমুদ্র  সৈকত থেকে তৌনিক মকবুলের (২৩) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি ব্র্র্যাক ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তৌনিক ঢাকার শ্যামলীর আদাবর এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলামের ছেলে।

১৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার সময় দরিয়া নগর এলাকায় নিয়ম ভেঙে সন্ধ্যায় প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে ঢাকার খিলক্ষেত এলাকার তারিকুল ইসলামের স্ত্রী তিন্নি আক্তার (২৬) মারাত্মক আহত হন। নিয়ম হচ্ছে প্যারাসেইলিংয়ের শেষ সময় বিকেল ৩টা পর্যন্ত। এই নিয়ম করে জেলা প্রশাসন সৈকতের পয়েন্ট নির্ধারণ করে বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু সেই নিয়ম ভেঙে ৫ মিনিটে ২ হাজার টাকা করে লোভে সন্ধ্যা হয়ে গেলেও প্যারাসেইলিং চালু রাখা হয়।

সন্ধ্যার অন্ধকারে ঠিকমতো ঠাওর করতে না পেরে ভুল ল্যান্ডিংয়ে পায়ে মারাত্মক চোট পান তিন্নি আক্তার। কক্সবাজার বেড়ানো মাঝপথে বন্ধ করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা ফিরে যান তিনি।

১৭ সেপ্টেম্বর দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার ব্যবধানে সমুদ্র থেকে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দুপুর ১টায় সীগাল পয়েন্টে ভেসে আসে ১৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইমন নামের কিশোরের লাশ। এর দুই ঘণ্টা পর একই পয়েন্টে বিকেল ৩টায় উদ্ধার হয় আরো এক অজ্ঞাত যুবকের লাশ। ওইদিন সকালে হোটেলে চট্টগ্রাম কোতোয়ালী থানার সৈয়দুল হকের ছেলে রাফসানুল হক (৩২) নামের এক পর্যটকের অতিরিক্ত মদপানে মুত্যু হয়।

গত এক সপ্তাহে পানিতে ডুবে ৩ জনের মৃত্যু, অতিরিক্ত মদপানে ১জনের মৃত্যু আর প্যারাসেইলিং থেকে ছিটকে ১ জন আহতসহ ছোট-বড় নানা দুর্ঘটনা ঘটছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে।

এ ব্যাপারে সী সেইফ প্রোগ্রাম ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সমুদ্র সৈকতের পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে সমুদ্রের অবস্থা যেরকম ছিল এখন ঠিক সেরকম নেই। প্রাকৃতিক নিয়মে সাগরের তলদেশ দিন দিন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। সাগরে এখন বড় বড় গুপ্তখালের সৃষ্টি হচ্ছে। এটি একটি পরিবেশগত কারণ।

এছাড়া আগে এক জায়গার মধ্যে অনেক মানুষ দেখা যেত, কিন্তু এখন সমুদ্রসৈকত সোজা হয়ে যাওয়ায় মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা সমুদ্রসৈকত সোজা কিংবা প্রসার পেয়ে অনেকদূর পর্যন্ত চলে যায়। লাইফগার্ডের সংকেত মানে না। লাল পতাকা দিলেও তারা সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পানিতে নেমে গোসল করে। সৈকতে আমাদের লাইফগার্ড কর্মী আছে মাত্র ২৭ জন। সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে আসা এতোগুলো মানুষকে অল্প সংখ্যক লাইফগার্ড কর্মী দিয়ে নজরদারি রাখাটা খুব জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাছাড়া আমাদের সংগঠনের অর্থনৈতিক সংকটে আমরা আরো বেশি লাইফগার্ড নিয়োগ দিতে পারছি না। এই ডিসেম্বরেই প্রজেক্ট শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মূলত লাইফগার্ড কম থাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটছে।

তিনি আরো বলেন, আমদের লাইফগার্ড কর্মীরা সবসময় সজাগ ও সচেতন। সার্বক্ষণিক পর্যটকের সেবায় নিয়েজিত তারা। সমুদ্রসৈকত খুলে দেওয়ার পর থেকে সী সেইফ লাইফগার্ড পানিতে ভেসে যাওয়া ৩১৫ জনকে রক্ষা করেছে। আমরা পর্যটকের সেবা নিশ্চিতে সবসময় আন্তরিক ও প্রস্তুত রয়েছি।

গত শুক্রবার সকালে সমুদ্র সচেতনায় ১০ দিনের ক্যাম্পেইনের উদ্বোধন করেছেন জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ। ‘সতর্কতাই নিরাপত্তার পূর্বশর্ত’ এই প্রতিপাদ্যে সমুদ্রের পানিতে নামার আগে করণীয় ও সতর্কতার ব্যাপারে সচেতনতামূলক বক্তব্য রাখেন তিনি।

জেলা প্রশাসক বলেন, সমুদ্রের পানিতে নামার আগে কিছু সতর্ক বার্তা এই ১০ দিন আমরা প্রচার করতে চাই।  পর্যটক যারা আসবেন তাদের তো জানা নেই যে এখানে লাইফগার্ড আছে। এখানে  সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে।  কোন চিহ্ন দিয়ে কি অর্থ প্রকাশ পায়, লাল পতাকার অর্থ কী—সেগুলোর বর্ণনা আছে।  

আত্মীয়-স্বজন, পরিবার পরিজন নিয়ে যারা কক্সবাজার সৈকতে বেড়াতে আসেন তারা অনেক সময় সিগনালগুলো খেয়াল করতে পারে না। তাদের অবগতির জন্য এই আয়োজন করা হয়েছে। তাদের সহায়তার জন্য এখানকার বিচকর্মীরা সার্বক্ষণিক সজাগ রয়েছেন।

ওইদিন জেলা প্রশাসক জানান, আগামী দশদিন পর্যন্ত কলাতলী, সুগন্ধা এবং লাবণী বিশেষ করে এই তিনটা পয়েন্টে এরকম প্রচার অভিযান চালানো হবে। এখন থেকে পর্যটকরা সমুদ্রস্নান কিংবা পানিতে নামার আগে প্রশাসনের দেওয়া নির্দেশনা ও সময়সূচি মেনে সমুদ্রসৈকতে নামবেন। এসময় তিনি পর্যটকদের সহযোগিতার আহ্বান জানান।

সোনালীনিউজ/এমটিআই