বাজার থেকে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে নিন্ম গ্রেডের কর্মচারীদের

  • নিজস্ব প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২১, ১২:৪৭ পিএম
ফাইল ছবি

ঢাকা : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে নিন্ম গ্রেডের কর্মচারী সুমন হাসান (ছব্দনাম)। স্ত্রী পূত্র নিয়ে বাস করেন খিলগাওয়ের সরকারী বাসায়। গত সপ্তাহে অফিসের বেতন পেয়েছেন। এরপর ছুটির দিন ছিল শুক্রবার। ছেলে মেয়েদের জন্য সপ্তাহের বাজার করতে এসেছেন। বাড়ীভাড়া কেটে নেওয়ার পর প্রতিমাসে যা বেতন পান তাতে খাসি আর গরুর গোশত কেনার সামর্থ নেই তার। এজন্য সন্তানদের আমিষের চাহিদা মেটাতে মুরগিই তার প্রধান ভরসা। 

আরও পড়ুন: সরকারি চাকরিজীবীদের আবাসন ও গৃহ নির্মাণ ঋণ

দফায় দফায় বাড়তে থাকা ব্রয়লার মুরগি গতকাল বিক্রি হয়েছে ১৭০ থেকে ১৮০টাকা। এক মাসে আগে যা তিনি কিনেছেন ১২০ টাকায়। আর সোনালি মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। গতকাল এটি বিক্রি হয়েছে ৩২০ টাকা কেজি। মুরগির বাজারের এমন উর্দ্ধগতি দেখে তার মুখে বিষন্নতার ছাপ দেখা যায়।

আরও পড়ুন: বাজার থেকে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে নিন্ম গ্রেডের কর্মচারীদের

সোনালীনিউজের প্রতিবেদককে তিনি বলেন, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করি। করোনায় বেতন-ভাতা কমে গেছে। কোন মতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় টিকে আছি। আমাদের কপাল থেকে গরু, খাসির মাংস অনেক আগেই উঠে গেছে।  মাসে এক-দুদিন পরিবার নিয়ে মাংস-ভাত খাবো এখন তার উপায়ও নেই। সোনালী মুরগির কেজি ৩২০ টাকা হয়ে গেছে। এতদাম দিয়ে সন্তানদের মুরগি কিনে খাওয়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে। এজন্য খালি হাতেই বাসায় ফিরতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন: সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন হিসাব ও অন্যান্য সুবিধাদি

নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় গত বুধবার থেকে আবারো রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে টিসিবির ট্রাকসেল কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য যে পরিমাণ নিত্যপণ্য প্রয়োজন তা সরবরাহ করতে পারছে না টিসিবি। তাই টিসিবির ট্রাকের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ।

আরও পড়ুন: সরকারি চাকরিজীবীদের ‘বিশেষ ইনক্রিমেন্ট’ ও ‘নবম বেতন কমিশন’

স্বল্প আয়ের মানুষেরা বলছেন, কম দামে পাই বলে নিয়মিত টিসিবির ট্রাকে পণ্য কিনি। কিন্তু দিনদিন ক্রেতার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে। টিসিবির ট্রাক থেকে আমাদের মতো অল্প আয়ের মানুষরা বাজারের চেয়ে কম দামে তেল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ কিনতে পারতাম। সারা বছর এটা চালু রাখলে আমরা বাঁচতে পারি। বাজারে জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে, ওই দামে কেনার ক্ষমতা আমাদের নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার মূল বেতন ৮২ হাজার টাকা। এছাড়াও তিনি বাসা ভাড়া হিসেবে পাচ্ছেন ৪১ হাজার টাকা। গাড়ী রক্ষণাবেক্ষনের জন্য পাচ্ছেন ৫০ হাজার টাকা। রান্না করার জন্য বাবুর্চির বেতন এবং দারোয়ানের জন্য পাচ্ছেন ১৬ হাজার করে। টেলিফোন বিল এবং সভার সম্মানিসহ মাসে কমপক্ষে ২ লাখ টাকা পাচ্ছেন তিনি। বছরে তিন থেকে পাঁচটি বিদেশ সফরে পান অতিরিক্ত কয়েক লাখ টাকা।

অথচ ২০ তম গ্রেডের একজন কর্মচারী সর্বসাকুল্যে বেতন পাচ্ছেন মাত্র ১৫ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়েই তাকে বাড়ীভাড়া, খাবারসহ সব ব্যয় মেটাতে হচ্ছে। এ ছাড়াও বিদ্যুৎবিল, গ্যাসবিলসহ সব মিলিয়ে চলে যাচ্ছে ৭ হাজার টাকা। এর পর পুরো মাসের খরচ চালানোর জন্য তার হাতে থাকে মাত্র ৮ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে তাকে পুরো মাসের সংসারের খরচ, পরিবারের কাপড়সহ যাবতীয় খরচ বহন করতে হয়। এর বাইরে তার আয়ের আর কোনো উৎস নেই। বেতনের আকাশ পাতাল বৈষম্য থাকলেও দৈনন্দিন খরচে নেই খুব বেশি পার্থক্য। ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের মাসের ১৫ দিন না অতিবাহিত হতেই শুরু হয় টানাটানি। 

সূত্র জানায়, বিদ্যমান বৈষম্যের অবসান ঘটাতে ২০১৩ সালে সকলস্তরের কর্মচারীদের জন্য একটি সুষম পে-স্কেল ঘোষণার উদ্দেশ্যে কমিশন গঠন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনরকে প্রধান করে গঠিত কমিশন মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই বাছাই করে একটি সুষম পে-স্কেল প্রস্তাব করে। সেখানে সর্বনিম্ন বেতন স্কেল ১১২০০ টাকা এবং গ্রেড সংখ্যা ২০ থেকে কমিয়ে ১৬ করার প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তীতে সচিব কমিটি গ্রেড পূর্ণগঠন করে ২০ গ্রেড করে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলের গেজেট প্রকাশ করে।
 
পে-স্কেল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০ থেকে ১১তম গ্রেডের কর্মচারীদের মূল বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকায় শুরু হয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকায় শেষ হয়। এই ১০টি গ্রেডের বেতন স্কেলের মোট পার্থক্য ৪২৫০ টাকা। পাশাপাশি ১০ থেকে প্রথম গ্রেডের কর্মকর্তাদের মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা থেকে শুরু হয়ে ৭৮ হাজার টাকায় শেষ হয়। এই ১০টি গ্রেডের পার্থক্য ৬৫ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া কর্মকর্তাদের জন্য রয়েছে গাড়ি, আবাসনসুবিধা, সুদমুক্ত গাড়ির ঋণসহ নানাবিধ সুবিধা। অথচ প্রত্যেকে একই বাজারব্যবস্থার কাঠামোর আওতায় জীবন ধারণ করেন, এতে শ্রেণীবৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে।

এই বৈষম্যের অবসান চেয়ে নানাভাবে আন্দোলন করছেন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সরকারি কর্মচারীরা। তারা পদবি ও গ্রেড পরিবর্তনের জন্য প্রধানমন্ত্রী, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন বহুবার। মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন দীর্ঘদিন।এমন প্রেক্ষাপটে এ বছরের শুরু থেকে সারা দেশের কর্মচারীরা ১১-২০ গ্রেডের সরকারি চাকরিজীবীদের সম্মিলিত অধিকার আদায় ফোরাম, বাংলাদেশ কালেক্টরেট সহকারী সমিতির (বাকাসস) ব্যানারে টানা আন্দোলন করেন। 

১১-২০ গ্রেডের সরকারি চাকরিজীবীদের সম্মিলিত অধিকার আদায় ফোরামের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি মিরাজুল ইসলাম বলেন, ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছি। বেতনবৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সদস্যদের দফতরেও স্মারকলিপি দিয়েছি। এরপর ৫০ এর অধিক মন্ত্রী ও এমপির দফতরে এ সংক্রান্ত স্মারকলিপি দেয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখছি না। বেতনবৈষম্য নিরসনসহ নতুন পে-স্কেল সংশোধন করে গ্রেড অনুযায়ী বেতন স্কেলের পার্থক্য সমাহারে নির্ধারণ ও গ্রেড সংখ্যা কমানোর জোর দাবি জানান তিনি।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ