ঢাকা : ঢাকার বুড়িগঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে জাল ফেললেই ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে রাক্ষুসে সাকার মাছ। জালে আসা সাকার মাছ আগের মতো আর ফেলে না দিয়ে বিক্রি করে আসছেন জেলেরা। স্বাস্থ্যগত বা ক্ষতিকর দিক না জেনেই এ মাছ রান্না করে খাচ্ছেন মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীক্ষা-নিরাক্ষা ছাড়া এ মাছ খাওয়া ঠিক নয়। এ অবস্থায় বিভিন্ন মহল সাকার মাছ নিয় উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। রাক্ষুসে এ মাছটির আমদানি, প্রজনন ও বিক্রি নিষিদ্ধেরও দাবি ওঠে কারো কারো পক্ষ থেকে। শেষ পর্যন্ত সরকার ক্ষতিকর এই সাকার মাছ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি সাকার মাছ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাকার মাছের প্রকৃতি ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিসহ নানা দিক নিয়ে গবেষণা এখনো শেষ হয়নি। এই মাছটি দেখতেও কদাকার। অন্যান্য মাছ এমনকি ডিমও খেয়ে ফেলে। রাক্ষুসে মাছ হিসেবেই এটি পরিচিত। তাই এই মুহূর্তে যতটা না স্বাস্থ্যগত তার চেয়ে বেশি দেশীয় প্রজাতির মাছের জন্য হুমকী হয়ে দাড়িয়েছে সাকার। এ কারণেই সরকারের নিষিদ্ধের এই উদ্যোগ।
সাকার মাছটি নিষিদ্ধ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কেউ সাকার মাছ আমদানি, প্রজনন, চাষ, পরিবহন, বিক্রি, গ্রহণ বা প্রদান, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও মালিক হতে পারবেন না। এতে আরো বলা হয়েছে, এ বিষয়ে কারো কোনো আপত্তি বা পরামর্শ থাকলে, তা লিখিতভাবে প্রজ্ঞাপন জারির দিন থেকে অনধিক দুই মাসের মধ্যে দেয়া যাবে।
গত ৫ জুন মৎস্য ও প্রণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সভায় মৎস্য অধিদফতর ও বিএফআরআইয়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সাকার মাছ ছড়িয়ে পড়া নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। মাছটি যেন দেশে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে না পারে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। ওই সভার প্রেক্ষিতে গত ২৮ জুন মৎস্য অধিদফতরের উপপরিচালক (মৎস্য চাষ) মো. খালেদ কনক একটি নির্দেশনা জারি করেন। এরপর গত ২৭ জুলাই সাকার মাছ আমদানি, প্রজনন, চাষ, বিক্রি ও পরিবহন নিষিদ্ধের প্রস্তাব দেয় মৎস্য অধিদফতর।
যেভাবে এলো সাকার : বিশেষজ্ঞরা জানান, সাকার ফিশের আসল নাম ‘সাকার মাউথ ক্যাটফিশ’। আশির দশকে অ্যাকুয়ারিয়ামের শেওলা ও ময়লা পরিস্কার করতে এ মাছ বিদেশ থেকে আনা হয়। দক্ষিণ আমেরিকায় এই মাছ দেখা যায় ব্যাপকভাবে। তবে কয়েক বছর ধরে তা ভারত, চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের জলাশয়ে দেখা যাচ্ছে। সাধারণত জলাশয়ের আগাছা, জলজ পোকামাকড় ও ছোট মাছ এদের প্রধান খাবার। মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, সাকার মাছ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করায় এখন চাইলে মানুষ আর মাছটি আমদানি, অ্যাকুয়ারিয়ামে পালন বা বিক্রি কিংবা প্রজনন কিছুই করতে পারবেন না। এ আইনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মৎস্য অধিদফতর বলছে, সাকার মাছ অবৈধভাবে দেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এ মাছ বুড়িগঙ্গার মতো দূষিত পানিতেও টিকে থাকতে পারে। দ্রুত প্রজননও ঘটায় মাছটি। পাশাপাশি মানুষ এই মাছ না খাওয়ায় এটি দ্রুত বাড়ছে ও ছড়িয়ে পড়ছে। সাকার দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু খেয়ে মাছের বংশবিস্তারে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এ মাছ যেকোনো পরিবেশে বাঁচতে পারে এবং দ্রুত বংশবৃদ্ধির কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছের সঙ্গে খাদ্য ও বাসস্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। মাছটি খাওয়া যায় না। সর্বোপরি সাকার মাছ জলজ জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অ্যাকুয়ারিয়াম ব্যবসায়ীরা দেশে মাছটি এনেছেন। এ মাছ ময়লা খেয়ে অ্যাকুয়ারিয়াম পরিষ্কার রাখে। সেখান থেকে এটি কোনোভাবে উন্মুক্ত জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ে। বদ্ধ জলাশয়ে থাকলে জাল দিয়ে কিংবা শুকিয়ে ধরে ফেলতে হবে। আর উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাকার ধরে পুরুষ বানিয়ে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। সাকার মাছ ধরে দিলে মানুষকে প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে, তাহলেও কমবে।
না জেনেই খাচ্ছেন মানুষ : রাজধানীর বুড়িগঙ্গাসহ আশেপাশের নদী এমনকি পদ্মা মেঘনা যমুনার মতো প্রধান নদীতেও গত কয়েক বছর হলো মিলছে এই সাকার মাছ। কেউ কেউ একে ‘চগবগে মাছ’ও বলে থাকেন। আগে এই মাছ বেশি দেখা না গেলেও এখন জাল ফেললেই ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে। এই মাছ খাওয়া যায় কিনা, কিংবা খেলে ক্ষতি কী, তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অনেকে একে বাগাড় মাছের ছোট জাত বলেও প্রচারণা চালিয়ে বাজারজাত করেন। এ দিকে বাজারে বিক্রির পাশাপাশি ফেসবুক ও ইউটিউবে সাকার মাছ রান্নার রেসিপিও দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। ঢাকা ফিস লাভারর্স, ফিস সেলফ বিডি, দয়াল এগ্রো, টেক টিউটোরিয়াল, ট্রাস্ট বিডি ইনফো, কুকু কিচেন ও কুকিং ফিস বেশ কয়েকটি ফেসবুক এবং ইউটিউব চ্যানেলে সাকার মাছ কাটা ও রান্নার পদ্ধতি শেখানো হচ্ছে। কেউ কেউ সাকার মাছের বারবিকিউয়ের রেসিপিও দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) ড. আনিছুর রহমান বলেন, সাকার মাছ নিয়ে আসলে গবেষণাটা আসলে এখনো শেষ হয়নি।
স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুরোপুরি গবেষণা ছাড়া এটা বলা যাচ্ছে না। এটা যাতে এই মুহূর্তে পুরোপুরি ছড়িয়ে না যায় সেটা দেখা উচিত। যতটা না স্বাস্থ্য ঝুঁকি তার চেয়ে বেশি হুমকী দেশীয় মাছের জন্য। এটাই এই মুহুর্তের বাস্তবতা। এই বিজ্ঞানী বলেন, প্রকৃতিতে সাকার মাছ কতটা প্রভাব ফেলবে, এ নিয়ে যদিও নানা প্রশ্ন উঠছে। সাকা মাছ দিয়ে ফিস মিল করা যায় কিনা, খাদ্য হিসেবেও ব্যবহারের সুযোগ আছে কিনা। ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ আছে কিনা, এই সমস্ত বিষয় ক্ষতিয়ে দেখার সময় হয়েছে এখন।
সাকার মাছ নিয়ন্ত্রণে মৎস্য অধিদফতর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গত বছরের ডিসেম্বরে কিছু নির্দেশনা দেয়। তাতে বলা হয়, ‘দেশের উন্মুক্ত জলাশয়ে ও চাষের পুকুরে সাকার মাছ পাওয়া যাচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। মাছটি যাতে কোনোভাবেই উন্মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে প্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। চাষ করা ও উন্মুক্ত জলাশয়ে পাওয়া গেলে, তা জলাশয়ে ছেড়ে না দিয়ে ধ্বংস করতে হবে। চাষ করা জলাশয় শুকিয়ে বা পুরোপুরি পানি সেঁচের মাধ্যমে সাকার মাছ ধরে তা মাটিচাপা দেয়া বা বিনষ্ট করতে হবে। তাছাড়া শোভাবর্ধনকারী মাছ হিসেবে বাজারজাতকরণের জন্য হ্যাচারিতে প্রজনন বা লালন-পালন বন্ধ করতে হবে।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ