নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতা গণপরিবহনে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ১১, ২০১৬, ০২:০৭ পিএম

নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতায় নেমেছে গণপরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা। পরিবহন মালিকদের টার্গেট পূরণ, যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা, অতিরিক্ত যাত্রীবহন, সড়কে পেছনের বাসকে কৌশলে আটকে রাখা এসব কারণে রাজধানীতে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা দুর্ভোগ। এ নিয়ে অভিযোগের শেষ যাত্রীদের মাঝে। এমনকি পথচারীদেরও ভোগান্তিতে পড়তে হরহামেশা।

শনিবার সকাল ৯টায় আনন্দ পরিবহনের একটি বাস নারায়ণগঞ্জ থেকে দোলাইরপাড় স্ট্যান্ডে এসে থামে। কাউন্টারের সামনে থেকে কয়েকজন যাত্রী নিয়ে রওনা হয় গুলিস্তানের দিকে। ‘সিটিং সার্ভিস’-এর কথা বলে প্রায় পাঁচ কিলোমিটারের জন্য ভাড়া নেওয়া হয় ১৩ টাকা। কিন্তু পথিমধ্যে যেখানে সুযোগ পেলো, সেখানেই প্রধান সড়কের ওপর বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হলো। পেছনে অন্যান্য যানবাহন আটকে পড়লেও ভ্রুক্ষেপ নেই চালকের। শেষপর্যন্ত বাদুর ঝোলা করে যাত্রী নিয়ে ছুটে চলে ‘সিটিং সার্ভিস’বাসটি।

বাসের ভেতরের অধিকাংশ সিট ভালো নয়। কোনোটা ভাঙা, লোহা বেরিয়ে আছে; কোনোটার সিট ছেঁড়া। সামনের সিটের সঙ্গে পেছনের সিটের দূরত্ব একেবারেই কম। ফলে যাত্রীদের হাঁটু লেগে যায় সামনের সিটের সঙ্গে। এ কারণে অনেকে বাঁকা হয়ে বসে হাটু নিরাপদ রাখার চেষ্টা করেন। বাসের জানালার কাঁচ ভাঙা। বৃষ্টি নামলে জানালার পাশের যাত্রীদের সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

গুলিস্তান যেতে বাসটি কোনও লেন মানেনি। যখন যেখানে সুবিধা হয়েছে, ইচ্ছামতো লেন পরিবর্তন করে, অন্যের অসুবিধা হলেও, এগিয়েছে। যানজট ঠেলে প্রায় চল্লিশ মিনিট পর গুলিস্তান কমপ্লেক্সের সামনে যাত্রীদের নামিয়ে বাসটি দাঁড়ালো মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের প্রবেশমুখে। এভাবে একটার পর একটা বাস বিশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে ফ্লাইওভার সংশ্লিষ্ট সড়কের একাংশ দখল করে নেয়। এতে বাধাগ্রস্ত হয় ফ্লাইওভার ব্যবহারকারী যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচল।

গাড়ি চালানোর সময় আইন মানেন না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে আনন্দ পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-৪৪৬৯) ওই বাসচালক বলেন, ‘আমি সবসময় আইন মানার চেষ্টা করি। কিন্তু অন্যরা মানে না বলে আমাকেও মাঝে মধ্যে দ্রুত যাওয়ার জন্য নিয়ম ভাঙতে হয়। কেননা মালিকরা প্রতিদিন যে টার্গেট দেয়, তা পূরণ করতে যেখান-সেখান থেকে যাত্রী তোলা, অতিরিক্ত যাত্রীবহন, পেছনের বাসকে কৌশলে আটকে রাখা, একটু নিয়ম ভেঙে চলা- এগুলো না করলে ভাই পোষাতে পারব না।’

শুধু আনন্দ পরিবহনই নয়, সিটি সার্ভিসের প্রায় সব বাসই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। দেখা গেছে, গন্তব্যে রওনা হওয়ার পর চালকরা কে কার আগে যাবেন, তা নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামেন। এরা কোনও আইন মানেন না। যাত্রীদের জন্য মোড়ে-মোড়ে স্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। এ কারণে মতিঝিল, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, পল্টন মোড়, শাহবাগ, মালিবাগ, সাইন্সল্যাব মোড়, মিরপুর রোড, ফার্মগেট, মহাখালী, গুলশান, বনানী, রামপুরা, বাড্ডা, মিরপুর প্রভৃতি এলাকায় দিনভর যানজট থাকে।

অন্যদিকে ‘সিটিং সার্ভিস’ নামেও যাত্রীদের সঙ্গে চরম প্রতারণা চলছে। যদিও মোটরযান অধ্যাদেশে ‘সিটিং সার্ভিস’ বলতে কিছু নেই। দেখা গেছে, পিক আওয়ারে যখন যাত্রী বেশি হয়, বাসগুলো তখন তথাকথিত ‘সিটিং সার্ভিস’ হয়ে যায়। অফ-পিক আওয়ারে চলে লোকাল হিসেবে।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘গণপরিবহনের কেউ আইন মানতে চান না। দুর্ভোগ ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আমরা কার্যকর অভিভাবক পাচ্ছি না। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে নানা আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। এই অরাজক অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে ডেডিকেটেড নেতৃত্ব প্রয়োজন।’

গুলিস্তান এলাকার ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মোস্তফা বলেন, ‘আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে। এ জন্য নিয়মিত মামলা হচ্ছে।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘গুলিস্তান হয়ে ৩৭টি রুটের বাস চলাচল করে। প্রতি রুটে বাস আছে ৩০ থেকে ৪০টি। এসব বাস প্রতিদিন গুলিস্তানের রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘সিটি সার্ভিসের বাসগুলোর রুট পারমিট সায়েদাবাদ পর্যন্ত। কিন্তু বাসগুলো সায়েদাবাদে যাত্রা শেষ না করে গুলিস্তান চলে আসে। কেননা শহরের বাইরের যাত্রীদের সায়েদাবাদ নামিয়ে দিলে সেখান থেকে গুলিস্তানে আসতে আরেক ভোগান্তি পোহাতে হবে। এ ছাড়া সায়েদাবাদ টার্মিনালের ভেতর এত গাড়ি রাখারও জায়গা নেই। তাই আমরা কিছু বলি না।’

একই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক সার্জেন্ট মেহেদী হাসান বলেন, ‘বাস চালকরা সহজে আইন মানতে চান না। তাদের অনেকে আইন সম্পর্কে জানেন না। তারা শুধু বাস চালাতে জানেন। পরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে সবার আগে চালকদের সচেতনতা প্রয়োজন।’

সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ঢাকার ভেতরের সড়কগুলো দেখেন দুই মেয়র। পরিবহনে ‍শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তারা বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘যতই মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার কিংবা ওভারপাস নির্মাণ করি না কেন, পরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা না হলে কোনও লাভ হবে না। পাশাপাশি ফুটপাতও পথচারীদের ফিরিয়ে দিতে হবে। চালকদের প্রশিক্ষণও জরুরি। দেশে এখন অদক্ষ চালকের সংখ্যাই বেশি।’

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমএইউ